ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

আয়কর প্রদানে সরকারী ও বেসরকারী কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য থাকা কি উচিত নয়?

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ৪ আগস্ট ২০১৭

আয়কর প্রদানে সরকারী ও বেসরকারী কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য থাকা কি উচিত নয়?

একটি খবরে দেখলাম ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাড়ে ১৫ লাখ লোক আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছে। পূর্ববর্তী কয়েক বছরের তুলনায় এই সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি। জানা যায়, গত কয়েক বছর আয়কর রিটার্ন জমা পড়েছে মাত্র ১০ লাখ থেকে ১১ লাখ। এই তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংখ্যা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এর মধ্যে একটা ঘটনা আছে। বলা হচ্ছে সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে ১৬ হাজার টাকার ওপরে যারা বেতন পান তাদের রিটার্ন জমা এখন বাধ্যতামূলক। এ কারণেই হঠাৎ করে রিটার্ন জমা পড়েছে অনেক বেশি। এতে দোষণীয় কিছু দেখি না। কারণ, না চাইলে কেউ কর দিতে চায় না, বাধ্য না হলেও কেউ পারতপক্ষে কর দিতে চায় না। এমতাবস্থায় একটি আয়কে নির্দিষ্ট করে দিয়ে যদি বলা হয়, রিটার্ন জমা দিতে হবে তাহলে দোষণীয় কিছু দেখি না। তবে এর পরে আরও কর্তব্য আছে। কেমন কর্তব্য? ন্যায্যতা ও সমতার খাতিরে পরের কর্তব্যটি হলো মাসিক ১৬ হাজার টাকা আয় করে যারা বেসরকারী খাতে তাদের বাধ্য করা হয় রিটার্ন দিতে। আমি ১৬ হাজার টাকা বাদ দিলাম। সরকারের নির্ধারিত একটা করমুক্ত আয়সীমা আছে। বর্তমানে বছরে তা আড়াই লাখ টাকা। মাসিক হিসাবে তা হয় কুড়ি হাজার টাকার ওপরে। দিনে ধরা যাক ৭০০ টাকা। এখন প্রশ্নÑ দিনে ৭০০ বা মাসে কুড়ি হাজার টাকা আয় করে এমন ব্যক্তি রিটার্ন দেবে না কেন? এটা তো ন্যায্যতারই দাবি। সরকারী কর্মচারী হয়ে কেউ অপরাধ করেনি নিশ্চয়ই। বিপরীতে বেসকারী খাতে কেউ আছে বলে তিনি নিশ্চয়ই আইনের আওতার বাইরে নয়। মুশকিল হচ্ছে, এই ন্যায্যতাটুকু না থাকলে বৈষম্য তৈরি নয়। একজন কর দেয়, অন্যজন কর না দিয়ে সম্পদ গড়ে তোলে যা আইনের দৃষ্টিতে কালো সম্পদ বা কালো টাকা। যদি ধরে নিই আমরা মাসিক ২০ হাজার টাকা আয়ের লোককে কর রিটার্ন দিতে বাধ্য করব তাহলে করণীয় কী দাঁড়ায়? বাধ্য না বলে, বলি উৎসাহিত করব তা হলে কী দাঁড়ায়। ধরা যাক শহরের পাড়ায় যে সবজি বিক্রি করে ভ্যান গাড়িতে তার কথা। এই ব্যক্তির আয় কত? আমি যার কাছ থেকে সবজি কিনি সে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার টাকা কাঁচামাল আনে। তার কথাতেই সমস্ত খরচ বাদে তার দিনে থাকে কমপক্ষে হাজার টাকা। সবজি বাজারের একজন সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা, ডিমওয়ালা, ফল বিক্রেতার দৈনিক আয় কত বলে আমাদের ধারণা? একজন মাংস বিক্রেতার আয় কত? ধরা যাক, একজন শক্ত স্বাস্থ্যবান রিক্সাওয়ালার কথা। তার দৈনিক আয় কত? বলা হবে এরা গরিব শ্রেণীর লোক। কিন্তু গরিব বলে আইন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন বিধান আছে কী? ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও বরিশাল ইত্যাদি বিভাগীয় শহরে কত দোকানদার (শপস এ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্ট) আছে? এর হিসাব সরকারী দলিলে নিশ্চয়ই আছে। এই মুহূর্তে আমার সামনে নেই। আমার ধারণা, সারাদেশে ‘শপস এ্যান্ড এস্টাব্লিশমেন্ট’ আছে লাখ লাখ। উপজেলা শহরে কত দোকানপাট আছে? যে কোন দোকানই এখন তক তক, ঝক ঝক করে। বেচা-কেনার কোন অভাব নেই। গ্রামে গ্রামে ধনাঢ্য ব্যক্তির কোন অভাব আছে কী? পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, এ্যাকাউন্টেন্ট, উকিল-মোক্তার, ডাক্তার, সাংবাদিক, কস্ট এ্যাকাউন্টেন্ট ইত্যাদি থেকে শুরু করে হাজার পেশার লোক আছে দেশে। এদের কারও আয় মাসিক ১৬ হাজার টাকার কম কী? উদাহরণ আর বাড়াব না। আমার মূল বক্তব্য ‘কম্পøায়েন্স’- নতুন আইন নয়, নতুন কর নয়। বিদ্যমান আইন সমভাবে সকল শ্রেণী ও পেশার লোকদের ওপর প্রযোজ্য করতে পারলে অসম্ভব সম্ভব করা যায়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। তারা জানে কীভাবে ‘ট্যাক্সনেট’ বাড়াতে হবে। তবে তাদের দরকার রাজনৈতিক সমর্থন এবং রাজনৈতিক নেতাদের দৃঢ় সমর্থন। আমার ধারণা, সুষ্ঠু বিধান, কার্যকর পরিকল্পনা, সঠিক পরিপালন করা গেলে আয়কর থেকে সরকারের রাজস্ব যথেষ্ট বাড়ানো যায়। তবে সমদৃষ্টি থাকতে হবে, পক্ষপাতহীন হতে হবে। পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা কে খারাপ আছেন? যারা সারাদিন বলছেন তারা প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছেন। অথচ তাদের বাস্তব অবস্থা কীÑ এ সম্পর্কে অনেকেরই ব্যক্তিগত খবরা-খবর আছে। এখন এমন শ্রেণীর লোকদের যদি কর রেয়াত দেয়া হয় আর ১৬ হাজারীদের কর দিতে বাধ্য করা হয় তাহলে তো ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পায় না। দেশে শত শত কোটি টাকার মালিক কত তার হিসাব নেই। অথচ সর্বোচ্চ করদাতা হন জর্দা ব্যবসায়ী। এটা কী সহ্য করা যায়? যে দেশে কম করে হলেও ৫০ লাখ লোক হবে দৈনিক ৭০০ টাকা উপার্জনকারী সেখানে সাড়ে ১৫ লাখ লোক আয়কর রিটার্ন দেয়- এ কথা ভীষণ লজ্জার নয় কি? দ্বিতীয় যে বিষয়টির ওপর কিছু বলা দরকার তা হচ্ছে ঋণখেলাপী সমস্যা। ঋণখেলাপী তকমা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হিসেবে যে পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে ‘পুনঃতফসিলীকরণ’ (রিসিডিউলিং)। অর্থাৎ ঋণের টাকা পরিশোধে অধিকতর সময়প্রাপ্তি। পূর্বে এই পুনঃতফসিল করা যেত যতবার ইচ্ছা ততবার। এ কারণে অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তাদের ঋণ ১০-১৫ বারও পুনঃতফসিল করেন। এদের মধ্যে সিনেমার নায়কের মতো চেহারাধারী ‘এফবিসিসিআই’ নেতাও আছেন, ব্যাংকের পরিচালকও ছিলেন। এখন পুনঃতফসিল তিনবারের বেশি করা যায় না। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নতুন রাস্তা বের করে ফেলেছেন। ‘পুনঃতফসিল ‘দরকার নেই। কর এখন ‘পুনর্গঠন’ অর্থাৎ ‘লোন রিস্ট্রাকচারিং।’ এর সুবিধা আরও বেশি। ঋণ পরিশোধে সময় অনেক বেশি পাওয়া যায়। সুদ হার কমানো যায়। পরিশোধে ‘গ্রেস পিরিয়ড’ পাওয়া যায়। তবে এই সুবিধা ‘গরিবদের’ জন্য নয়। ছোট ছোট ঋণগ্রহীতার জন্য নয়। এই সুবিধা ৫০০ কোটি টাকার ওপর ঋণ যাদের তাদের জন্য। বর্তমানে দুই সুবিধাই চালু আছে। দেখা যাচ্ছে এই দুই সুবিধাতেও কোন কাজ হচ্ছে না। বড় ঋণগ্রহীতারা তাদের ‘রিস্ট্রাকচার্ড লোন’-এর টাকা অনেক ক্ষেত্রেই পরিশোধ করছেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা এত বেশি ধনী যে তাদের ‘ক্যাশফ্লো’ দিয়ে ব্যাংকের টাকা দিতে পারছেন না। এদিকে পুনঃতফসিলের খবর দেখা যাচ্ছে বেশ খারাপ। একটি খবরে দেখলাম বিগত পাঁচ বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ২০১২ সালে যত ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় ২০১৫ সালে করা হয় তার তিন গুণেরও বেশি। ২০১৪ সালে কিছু কমে। ২০১৫ সালে আবার বাড়ে। ২০১৬ সালে কিছুটা কমে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংক চায় খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রদত্ত ঋণের ১০ শতাংশে রাখতে। এই নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোও হরে-দরে পুনঃতফসিল করে। প্রয়োজনেও করে, অপ্রয়োজনেও করে, চাপে পড়েও করে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কোন কোন খাতে ঋণ খারাপ হচ্ছে। খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত হচ্ছে শিল্পের চলতি মূলধন। রয়েছে আমদানি-রফতানি খাত। রয়েছে জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙ্গা শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত এবং ভোক্তা ঋণ। দেখা যাচ্ছে কোন খাতই বাদ নেই। এই ক্ষেত্রে আমার বলার বিষয় একটি। ঋণের পুনঃতফসিলীকরণ একটি ভাল উদ্যোগ ছিল। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা নানা কারণে ঋণের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারে না। ব্যাংকাররা এদের সুযোগ দিয়ে ঋণ পরিশোধে সমর্থন করেন। এটা করার জন্যই ছিল ঋণ ‘পুনঃতফসিলীকরণ’ সুুবিধা, কিন্তু একশ্রেণীর ব্যাংকার নানা চাপে এবং কিছুটা নিজ উদ্যোগে এই সুবিধাটিকে নষ্ট করে ফেলেন। তারা হরে-দরে এই সুবিধার ব্যবহার করে ব্যাংকিং খাতকে আজ একটা দুর্যোগের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এখন ‘রিস্ট্রাকচারিং এবং পুনঃতফসিলীকরণ’ সুবিধা কার্যত ‘বিধি মোতাবেক লুণ্ঠনের’ মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যারা পারছে তারা এই সুবিধা করিয়ে নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক তার নিজের বিধি নিজেই ভাঙছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকেও তারা আরও অনেক নরম। তারা যখন শিথিল আচরণ করতে পারে তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংক পিছিয়ে থাকবে কেন? এটা এক প্রতিযোগিতা। মোদ্দাকথা, আমাদের বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের অনেকেই ‘ওভার ইনডেটেড’। তারা তাদের প্রয়োজনের অনেক বেশি ঋণ করে ফেলেছেন। সেই ঋণ ফেরত দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। অনেকেই জমিতে বিনিয়োগ করেছেন, টাকা বাইরে পাঠিয়েছেন। ‘ফান্ড ডাইভারশন’ খুবই বড় ঘটনা। ব্যবসায়িক কারণে যারা টাকা ফেরত দিতে পারছেন না তাদের কথা জানা। কিন্তু ইচ্ছাকৃত খেলাপীদের দাপটই বেশি। এর থেকে মুক্তি কী? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×