প্রপাতের জলকণার সুরভী অন্যরকম- বহু আগে থেকেই সেটা আমি জানি।
বিশাল নদীর অনেক ওপরে ভেসে থাকা মেঘের মতো সে রাতেও মেঘ ছিল আকাশে। জোসনার রুপালি রেখা মেঘ কেটে কেটে যে রাতে দূর পাহাড়ের কোন এক জনহীন ভৌতিক উপত্যকায় কুহক চাঁদনী রাত রচনা করে সে রাত কি পাষাণফলক না হয়ে পারে!
নিরুৎসব জীবন আমার। পাহাড়ের গা ঘেঁষে চন্দ্রনীল হয়ে থাকে বিশাল উপত্যকা। কিন্তু সাধ্য কার, আলোর দাগে হাত রাখে? আমি ছুঁয়ে দেখতে পারি না। দীর্ঘতম আলোক রেখা আরও বেড়ে যায়, তবু ছুঁয়ে দেখার সক্ষমতা থেকে যায় অধরায়।
এভাবে ঘর ভরে ছড়িয়ে থাকা অন্ধকার, ছায়ার মাঝে বেজে ওঠা শব্দরাত, অথবা সমুদ্র সুরভিত বালিহাঁস কিংবা আলোকিত হলঘরে বসন্তের রতিবিলাস রোদ চকচকে জলের মতো মান্ধাতা আমলের ভেদরেখা পেরিয়ে আমাকে ব্যথা দেয়। আমি টের পাই ব্যথাগুলো যাবতীয় প্রেমের মতো শুচি। ঘাসের ভেতরে ঘাস হয়ে জন্মানোর আকাক্সক্ষার মতো আনন্দ হয়ে ধরা দেয়। অতঃপর নিজেকে আবিষ্কার করি এক আলোবিদ্ধ ককপিটে। এরপর দেহের গভীরে কোন এক প্রতিদেহে জন্ম নেয় স্বচ্ছ সুন্দর এক উজ্জ্বল প্রান্তর। যেখানে বৃক্ষেরা জীবিত, প্রাণীরা রহস্যময়। যার চারিধারে শুধুই ঝকঝকে কালো আবলুশের মতো প্রলম্বিত ছায়া।
তবু এই ছায়ার মাঝে শূন্য থেকে মহাশূন্যে, ইথার থেকে ইথারে, আলোতে, আঁধারে, কুয়াশামাখা হেলাঞ্চির প্রান্তরে, শিলা হয়ে খসে পড়া মেঘের মতো হাওয়াদের বুকে ভেসে তারার মতো অদৃশ্য হয়ে যাবার সুখ পাওয়া যায়। এভাবেই স্বরচিত শয্যায় সঙ্গীহীন হয়ে সহজেই আকাশ ভ্রমণ করি কিংবা পিলসুজ হয়ে স্বপ্ন দেখি মেঘের দীঘিতে আলেয়ার। এভাবেই পাখিদের সমস্ত বিলাপ হয়ে ওঠে জোছনার গান।
এই গানকে মনে হয় নতুনের অনুভূতি, কোথাও একটা পৌঁছতে চাওয়া। স্বপ্ন কিংবা পেশার ভেতরে বেড়ে ওঠা উচ্ছ্বসিত হলুদ কিংবা মূল্যবান অন্ধকারে দুলে ওঠা আঁধার। এই গান তৃপ্তি, উপলব্ধি, এই গান ফিরে ফিরে আসা, চূড়ান্ত মুহূর্তের গল্প, অপূর্ণতার পূর্ণতা, রোমন্থন কিংবা আপাদমস্তক জোছনার রাতে মৃত্যু না হওয়ার সৌভাগ্য। এই গান শত বিপর্যয়ের পরও জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা আলোর মতো বেপরোয়া, আশ্চর্যতম স্বচ্ছতার ভেতরেও যেখানে জন্ম নিতে পারে আত্মাদের প্রতিবিম্ব। এ যেন যতদূর ভাবা যায় ততদূর শরীরী হয়ে ওঠা আলেখ্য। কখনও সময়, কখনও দায়, কখনওবা জাম্বুরা ফুলের সম্ভাবনার মতো বেড়ে ওঠে সহসা। এ যেন সহজেই সঞ্চার করে আলো, বিস্তৃত করে আশা, বিম্বিত করে জীবনের সকল প্রতিধ্বনি, ভিন্ন ভিন্ন জীবনদর্শনের ভেতর রঙিন হয়ে ওঠে প্রতিটি সমুদ্র গোলাপের মতো।
এই গানই সকল অদৃশ্যের সৌভাগ্য।
**প্রতিহত
একটা আলো ছড়ানো বারান্দায়
রোদের দাগ কিংবা পূর্বরাগ
মুছে যাবে সহজেই,
আমি ভাবিনি।
মধ্য আকাশে আলোর অন্তরীপে
মিথ্যা বিশ্বাসের ছায়াপথে
সায়াহ্ন এসে যাবে
ভাবিনি।
কেন যে কাগুজে সম্পর্কেই
দ্রবীভূত হয়ে যাই রমণীর শরীরাধারে,
জানা হয় না।
কুয়াশামুখী কিংবা আকাশমুখী যাই হোক
ঘোমটা বৃত্তের রহস্যেই
সম্পর্ক হয়তো থাকে না।
তবু ও সৌরভের গল্প ভাসে।
অতঃপর চমৎকারভাবে গেঁথে যায়
গলে যাওয়া সময়ের প্রতিটি খ-ে।
**আপাত কুমারী
অতঃপর নদীর ধারে
কিংবা চাঁদের রাতে
আমরা যারা প্রেম করি;
বার বার মরে যেতে থাকি।
আমরা মরে যাই
জলের উপর কেঁপে কেঁপে ছায়া ফেলা
অদ্ভুত সব তাঁতমেঘ কিংবা
বর্গাকার শহরের চতুষ্কোণে,
মরে যেতে থাকি
শশীদের মিথ্যা বিশ্বাসে।
আমরা লুকিয়ে রাখা কান্না
কিংবা রক্তাভ হয়ে ওঠা লজ্জায়
অভ্যস্ত হয়ে যাই।
নদীর বুকে চকচকে আলোর বদলে,
আলোয় বোনা রাতনগরের
ঝিলিমিলি ঝালর দেখি,
দেখি মরা আলেয়া
ও তার অন্তরীপে ভাসা মৌসুমি-সূঁচ;
পাপড়িসকাল তাই রয়ে যায় অধরা।
তবু
নতুন আশায় গুছিয়ে গুছিয়ে
উন্মুখ হয়ে বসে থাকি বার বার।
যেন সবকিছু হারিয়েও
আপাত কুমারী।
**ভিন্ন আলেয়া
কবিদের এত অসুখের পরও
আবেগের রেহেলে ভেসে ভেসে
যারা ভেবেছিল নারী মানেই প্রেম,
নারী মানের ফাগুনের আকাশে
চমৎকার বসন্ত রোদ,
বৃষ্টির শহরে
আকাশমুখী জলফানুস,
যারা ভেবেছিল নারীতেই প্রাপ্তি,
নারীতেই আবছা কুয়াশার গায়ে সৃষ্টির দাগ
ফোকাস লাইটের মতো
উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,
তারা আজ জানুক; জেনে নিক-
অমাবস্যার খিড়কি খুলে
যখন নক্ষত্ররা তাকায়,
অথবা মরুপরিখার বিশাল খাদে
যখন হাজার জোনাকি ওড়ে
কিংবা টঙদোকানের ঝাঁপিটার নিচে
হেলিয়ে আসে অমল রোদ,
তখন কি এই আলোড়নে
পর্যাপ্ত দ্রবীভূত হওয়া যায়?
হতে হয়?
একটি মৃত্যু তো অসংখ্যবার আসতেই পারে।
*অথচ আমরা
জলের ভেতর বেড়ে ওঠা অন্ধকারের নাম
অজানায় রয়ে গেল চিরদিন।
অথচ যখন জাফরান রৌদ্রালোক
ধীর হতে আরও ধীরে
গাঢ় হয় আরও,
আমরা পৃথক করি বিকেল-সন্ধ্যা।
অথবা পাহাড়ের ফাঁক গলে
রোদ নামলেই
নাম হয় ঊষা।
কিন্তু যখন
প্রবল জোছনায়; শশীদের জয়ে
আকাশ নীলিকার চমৎকার দাগ
ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত আকাশের গায়ে,
পাথরের গায়ে,
জলের গায়ে,
গাছেদের পাতায় পাতায়,
কিংবা যখন অচেনা অমাবস্যায়
পৃথিবী সরে যায়
জনপদ থেকে তিমিরে; নীহারিকায়
ক্ষুদ্র আলোয় গেঁথে গেঁথে
আকাশনকশি বানায় যত নক্ষত্র,
আসলে তারা যেন থেকে যায়
একই রাতের অধিকারে,
অভিন্ন এক নামে।