ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪শ’ ১৯ কোটি টাকার কাজ সাত বছরেও শেষ হয়নি

গাজনার বিল প্রকল্পে হরিলুট

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২ আগস্ট ২০১৭

গাজনার বিল প্রকল্পে হরিলুট

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ গাজনার বিল প্রকল্প দীর্ঘ সাত বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই শেষ হয়েছে মৎস্য, পশুসম্পদ, এলজিইডি এবং বন বিভাগের কাজ। বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় অর্ধশত কোটি টাকা বাড়ানোর পরও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ। জানা গেছে, সাবেক সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকারের নির্বাচনী এলাকায় (সুজানগর-বেড়া, পাবনা-২) গাজনার বিল উন্নয়ন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় তারই ইচ্ছায়। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না হলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও সরকারী কর্মকর্তারা লুটে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল গাজনা (পাবনার সুজানগর উপজেলাধীন) প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০-১১ অর্থবছরে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল তিন বছর। কাজের মূল লক্ষ্য ছিল পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে বিলের জলাবদ্ধতা এবং বন্যামুক্ত করে এক ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করা, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করে বর্ধিত ফসল উৎপাদন করা। দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি এবং বনভূমি তৈরি করা। অথচ সাত বছর অতিবাহিত হলেও বিল এলাকার অধিবাসীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৮ কিলোমিটার খাল খনন করলেও সে খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। তিন ফসল তো দূরের কথা এক ফসল আবাদ করাই এখন বিলবাসীর জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় ফসল বিনষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। বিলের মধ্যে দিয়ে আত্রাই নদী প্রবাহিত হয়েছে। ভাটশালা গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর একপাশে স্তূপাকারে মাটি রাখা হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ নদী খননের নামে এভাবে মাটি রেখে প্রবহমান নদীটির গতি রোধ করা হয়েছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকেশলী মোঃ আব্দুল হামিদ জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সুফল পাবে কৃষকেরা। তিনি কাজ বিলম্বের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ এবং নকশা সংক্রান্ত জটিলতাকেই দায়ী করেছেন। এদিকে গাজনার বিলের চরদুলাই-পোতাজিয়া বিল অংশে ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মাছের অভয়ারণ্য করেছে মৎস্য বিভাগ। সরেজমিনে গিয়ে ডাঙ্গায় একটি সাইনবোর্ড ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি। সাইনবোর্ডের পেছনে মাঠ এবং তার পাশে ছোট্ট একটি জলাশয় রয়েছে। মৎস্যজীবীরা জানায়, উল্লেখিত স্থানে এখন আর মাছের অভয়াশ্রমের অস্তিতই নেই। শুধু এখানেই নয়, অধিকাংশ অভয়াশ্রমের একই দশা। যদিও প্রকল্প এলাকায় এসব অভয়াশ্রম করার আসল উদ্দেশ্য ছিল মাছের পোনা অবমুক্ত করে এবং বাইরের নদী থেকে পোনা বিল প্রকল্পে প্রবেশের মাধ্যমে দেশীয় মাছের বংশবৃদ্ধি করা। এই অভয়াশ্রমের জন্য মৎস্য বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। জেলা মৎস্য বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ গোলাম মওলা জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করে চলে গেছেন প্রকল্প পরিচালক। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং খাল খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিলে মাছের অভয়াশ্রম এবং দেশীয় মাছের বংশ বৃদ্ধির কাজ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্প এখনও বাস্তবায়িত না হলেও ৫ বছর আগেই বনায়নের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তবে বন বিভাগের বাস্তবায়িত এই প্রকল্পে গাছের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খোদ বন বিভাগের তদন্তেই হরিলুটের চিত্র পাওয়া গেছে। প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বনায়ন। প্রকল্পের পানি নিষ্কাশন এবং সেচ খাল খননের পর এসব খালের দু’ধারের পাড়ে গাছ লাগানোর দায়িত্ব ছিল বন বিভাগের। এরজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৮৬ লাখ টাকা। চার বছর আগে সেচ খাল খনন এবং দু’পাড়ের ডাইক নির্মাণ সমাপ্ত না হলেও বন বিভাগ তার সমস্ত টাকা খরচ দেখিয়ে কাজ গুটিয়ে ফেলেছে। এ ব্যাপারে পাবনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কবির হোসেন পাটোয়ারী জানান, ‘আমি সম্প্রতি এই জেলায় যোগদান করেছি, এই প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই অবহিত নই’। তবে এই প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ উঠলে বন বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সরেজমিন তদন্ত শেষে গত ১০ এপ্রিল একটি তদন্ত রিপোর্ট মেলে। এ রিপোর্ট মোতাবেক ২০ হাজার বৃক্ষ রোপণের কথা থাকলেও গাছের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্র ৮শ ৬০টি। চারটি নার্সারি থেকে কি পরিমাণ গাছ পাওয়া এবং বিতরণ করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এভাবে তদন্ত কমিটি ১৭ লাখ ৫১ হাজার ১৯৮ টাকা লোপাটের অভিযোগ দাখিল করেন। ফরেস্ট রেঞ্জার্স ও তদন্ত কর্মকর্তা মির্জা মাহবুবুল আলম জানান, তদন্ত কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই ভেঙ্গে গেছে চলাচলের জন্য অযোগ্য গাজনার বিল সাবমারসিবল সড়ক। প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কের কাজের মান খুবই খারাপ। গাজনার বিল প্রকল্পের পর্যবেক্ষক গোলাম রসুল জানান, বর্ষা মৌসুমে বিল এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত ফসল পরিবহনের সুবিধার্থে গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্পের আওতায় এই সড়কটি নির্মাণ করা হয় দুই বছর আগে। সড়কটির পাশ ধসে গেছে, উঠে গেছে সড়কের বিভিন্ন অংশ। সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে সৃষ্টি হয়েছে খানাখন্দ। সড়কটি যেহেতু বিলের ঠিক মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে চলে গেছে এ কারণেই সড়কটি নির্মাণে পাথর ব্যবহারের কথা থাকলেও মানসম্মতভাবে যথাযথভাবে সড়ক নির্মাণ করা হয়নি। নিম্নমানের খোয়া দিয়ে সড়ক নির্মাণ করায় অল্পদিনেই এই ভগ্নদশা হয়েছে। এ সড়কটি নির্মাণের দায়িত্ব ছিল বিল প্রকল্পের অংশীদার এলজিইডি। এই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, দুই বছর আগে শেষ হওয়া এই সড়ক সংস্কার করতে হলে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। গাজনার বিল উন্নয়ন প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সেই লক্ষ্যেই এই সড়কসহ স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। নানা অজুহাতে বারবার মেয়াদ বাড়ানো এবং প্রকল্প ব্যয় প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বাড়ানোর পরেও তালিমনগর স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। এই প্রকল্পটির কাজে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ১শ ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এই স্লুইস গেট নির্মাণের জন্য। কাজ শুরু হয় ২০১৩’র জানুয়ারি মাসে। কাজটি শেষ করার সময় নির্ধারণ ছিল ২০১৫’র ৩০ জুন। পরে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৯-এর জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজ যথাসময়ে শেষ না করার ব্যাপারে বলেছে, বারংবার নকশা পরিবর্তনের কারণে বিলম্ব হচ্ছে। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের প্রকল্প প্রকৌশলী লুৎফর রহমান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এই কাজ বিলম্বের কারণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২শ’ ২৬ কোটি টাকা এই স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় মূল প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, সুনির্দিষ্ট নকশা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করায় সময় ও ব্যয় দু’টোই বেড়েছে। সুনির্দিষ্ট নকশা ছাড়াই কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্লুইস গেট নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং কাজ শুরু করা হয়? এমন প্রশ্নের সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
×