ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সমুন্নত রেখেই শৃঙ্খলাবিধি করা হবে ॥ আইনমন্ত্রী

নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধি গৃহীত হয়নি আপীল বিভাগে

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩১ জুলাই ২০১৭

নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধি গৃহীত হয়নি আপীল বিভাগে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিম্ন আদালতে বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধির চূড়ান্ত খসড়া আপীল বিভাগে নির্দেশনা অনুযায়ী না হওয়ায় তা গ্রহণ করেনি আপীল বিভাগ। বিধিমালায় খসড়ায় ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’ শব্দ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আপীল বিভাগ। ওই খসড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘এটা কিছুই হয়নি। আপীল বিভাগ থেকে যে সুপারিশ দেয়া হয়েছিল তার কিছুই সেখানে নেই। আইনমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে বৈঠকের পর পুরোপুরি ইউটার্ন করেছেন।’ রায়ের ষোলো বছরে হয়নি। আর এভাবে হলে ষোলো শ’ বছরেও গেজেট হবে না।’ তিনি এর সুরাহার জন্য বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে আইনমন্ত্রী বলেছেন, একজনের অনেক বক্তব্যে মনে হচ্ছে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের একটা বিরাট যুদ্ধ চলছে। আমি আশ্বস্ত করতে চাই, কোন যুদ্ধ চলছে না। প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সমুন্নত রেখে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা করা হবে। আমি সেই আলোচনার মধ্যেই আছি। আমি যখন খসড়া জমা দিয়েছিলাম তখনই তো বলেছি এরপরও কিছু থেকে থাকলে আলোচনা করা যাবে। এ নিয়ে বড় করে এজলাসে বসে কথা বলার কিছু নেই। অন্যদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার বিষয়ে সুরাহার জন্য প্রধান বিচারপতির বৈঠকের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। আর এ বিষয়ে আগামী ২ আগস্ট (বুধবার) বৈঠক হতে পারে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ১৮৬১ সালে কলকাতা হাইকোর্ট হয়েছে। তখন থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থা চলে আসছে। হাইকোর্ট কেন রাখবেন? হাইকোর্ট উঠিয়ে দেন। তিনি এ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমরা চাই সুন্দর একটা আইন হোক। তাই আসুন আমরা বসি। আমি এবং আপীল বিভাগের আমরা সব বিচারক, আপনি, মাননীয় আইনমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রণালয় চাইলে তাদের পক্ষ থেকে এক্সপার্ট যে কয়জন ইচ্ছা সে মিটিংয়ে রাখতে পারবে। রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার যে কোন দিন দুপুর ২টার পর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আমাদের বসতে সমস্যা নেই।’ এরপর আগামী রবিবার বিষয়টি আদেশের জন্য রাখেন আদালত। রবিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ৬ সদস্য বিশিষ্ট আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে দিন নির্ধারণ করেন। খসড়ার বিভিন্ন ধারার অসঙ্গতি তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আমার সঙ্গে আলোচনা করে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সব অসঙ্গতি দূর হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রণীত এই খসড়ায় সেটার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। কেন আপনারা পুরোপুরি ইউটার্ন নিয়ে এ ধরনের একটা খসড়া প্রণয়ন করলেন। আমরা যেটা পাঠিয়েছি তার উল্টোটা পাঠিয়েছেন। রায়ের ষোল বছরে হয়নি। আর এভাবে হলে ষোল শ’ বছরেও গেজেট হবে না।’ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে আইনমন্ত্রীর দেয়া বিধিমালার খসড়ায়। ‘তাহলে হাই কোর্টের কী থাকল? সবই তো মন্ত্রণালয়ের। ১৮৬১ সালে কলকাতা হাইকোর্ট হয়েছে। তখন থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থা চলে আসছে। হাইকোর্ট কেন রাখবেন? উঠিয়ে দেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) বিকেলে সুপ্রীমকোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে চূড়ান্ত খসড়াটি হস্তান্তর করেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের আবেদনে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ গত সপ্তাহে ওই গেজেট প্রকাশের জন্য ৩০ জুলাই পর্যন্ত সময় দিয়েছিল। সে অনুযায়ী রবিবার বিষয়টি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপীল বেঞ্চে আসে। কিন্তু খসড়া গ্রহণ না করে প্রধান বিচারপতি মতপার্থক্য নিরসনে বৈঠকে বসার কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। উনি খসড়া দিয়ে গেলেন। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। যদিও খুলে দেখিনি। কিন্তু এটা কী? এখানে বলা হলো ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’। এটার মানে কী? সব আইনে ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু এখানে কোন ব্যাখ্যা নেই। কর্তৃপক্ষ বলতে বিচার বিভাগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাখলেন। তবে তো আইন মন্ত্রণালয়ই থাকছে। এর সমাধান না হলে চলবে না।’ ওই খসড়া থেকে উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সরকার কর্তৃক নির্ধারিত তারিখ থেকে গেজেট কার্যকর হবে বলা আছে। অথচ মাসদার হোসেন মামলায় নির্দেশনা আছে, সুপ্রীমকোর্ট যে তারিখ থেকে কার্যকরের পরামর্শ দেবেন, সেই তারিখ থেকে কার্যকর হবে। আমরা যেটা পাঠিয়েছি তার উল্টোটা পাঠিয়েছেন। রায়ের ষোলো বছরে হয়নি। আর এভাবে হলে ষোল শ’ বছরেও গেজেট হবে না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে আইনমন্ত্রীর দেয়া বিধিমালার খসড়ায়। ‘তাহলে হাইকোর্টের কি থাকল? সবই তো মন্ত্রণালয়ের। ১৮৬১ সালে কলকাতা হাইকোর্ট হয়েছে; তখন থেকে হাইকোর্টের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থাই চলে আসছে। হাইকোর্ট কেন রাখবেন? হাইকোর্ট উঠিয়ে দিন।’ রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম মাননীয় আইনমন্ত্রী এসেছেন। এসে খসড়া দিয়ে গেছেন। প্রেসে বক্তব্য দিয়েছেন যে বিধিমালা হয়ে গেছে। কিন্তু এ কী রকম হলো!’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি বিদেশে যাওয়ার সময় মন্ত্রণালয় জিও দেয়। ‘তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি তাহলে এ্যাভয়েড করছেন?’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘খসড়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আমার যে আলাপ হয়েছিল, আমি যে বিষয়গুলো খসড়ায় রাখার কথা বলেছিলাম, হি ওয়াজ টোটালি স্যাটিসফায়েড। বাট তিনি সেদিন যে খসড়া দিলেন সেখানে ‘কমপ্লিটলি ইউটার্ন’। এই মতপার্থক্য দূর করে বিধিমালা চূড়ান্ত করার জন্য বৃহস্পতিবারের মধ্যে যে কোন দিন বৈঠকে বসার তাগিদ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপীল বিভাগের বিচারপতিরা রাত ১২টা পর্যন্ত আপনাদের সময় দেবে। বিচারকদের চাকরির শ্ঙ্খৃলা ও আচরণ বিধিমালা নিয়ে আর রশি টানাটানি নয়। আইনমন্ত্রীসহ সরকারের যে কোন এক্সপার্ট আসবেন, বৈঠকে বসব।’ কোন যুদ্ধ চলছে না যশোর থেকে স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের কোন যুদ্ধ চলছে না বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রবিবার যশোর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও জেলা আইনজীবী সমিতি ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। আনিসুল হক বলেন, ‘বিতর্ক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। এক্ষেত্রে কারও সঙ্গে কোন দূরত্ব সৃষ্টির সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমার অনেকদূর এগিয়েছি। আইনের শাসন শক্তিশালী করণে আরও কাজ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, অনেকবার গণতন্ত্র আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে আইনের টেম্পারিং করতে না পারে সেই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সমুন্নত রেখে বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা করা হবে। আমি সেই আলোচনার মধ্যেই আছি। আমি যখন খসড়া জমা দিয়েছিলাম, তখনই তো বলেছি- এরপরও কিছু থেকে থাকলে আলোচনা করা যাবে। এত বড় করে এজলাসে বসে বলার কিছু নেই।’ বিচারবিভাগে উন্নয়ন হচ্ছে না এর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, কেবল ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে বিচার বিভাগের উন্নয়নের মধ্যে সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতিগণের জন্য ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২ তলা আবাসিক ভবন উদ্বোধন, ময়মনসিংহে ১০তলা সিজেএম আদালত ভবন উদ্বোধন, রাজশাহীতে ৮তলা সিজেএম আদালত ভবন উদ্বোধন, চট্টগ্রামে ৬ তলা সিজেএম আদালত ভবন উদ্বোধন, হবিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ৪তলা বিশিষ্ট ৪টি সিজেএম আদালত ভবন উদ্বোধন করা হয়েছে। আজ যশোরে তিনতলা সিজেএম আদালত ভবন উদ্বোধন করা হলো। আগামী বছরে এটি ১০ তলায় পরিণত হবে। তিনি বলেন, এগুলো কি বিচার বিভাগের উন্নয়ন নয়। তিনি বলেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর স্থান সঙ্কুলানের জন্য দেশের ৬৪টি জেলায় একটি করে সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর প্রথম পর্যায়ে ২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪২টি জেলায় সিজেএম আদালত ভবন নির্মাণ চলছে। বর্তমানে এ প্রকল্পের কাজ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে ২০টি জেলায় নির্মিত আদালত ভবনে বিচারিক কাজ চলছে। ১৮টি জেলায় আদালত ভবন নির্মাণ কাজ চলছে। এর মধ্যে ১০টি জেলায় নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এগুলোর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। অন্য ৮টি জেলার আদালত ভবন নির্মাণ কাজও আগামী জুনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ৪টি জেলায় ভূমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে নির্মাণ কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। এই ৪২টি জেলা ব্যতীত অবশিষ্ট ২২টি জেলায় আদালত ভবন নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে এবং এগুলোতে ভবন নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্ম না হলে আজ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হতো না। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন না করলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো না। বাংলাদেশ থেকে বিচারহীনতার কলঙ্ক মোচন হতো না। বাংলাদেশের জেলায় জেলায় আজ সুউচ্চ আদালত ভবন নির্মাণ হতো না। কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেতো না। যশোরের জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মোঃ মনিরুল ইসলাম, স্বপন ভট্টাচার্য ও কামরুল লায়লা জলি এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক বক্তৃতা করেন। বৈঠকের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়কে জানাব নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার বিষয়ে সুরাহার জন্য প্রধান বিচারপতির বৈঠকের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়কে জানাবেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর এ বিষয়ে আগামী ২ আগস্ট বৈঠক হতে পারে বলেও জানান তিনি। রবিবার বেলা ২টার দিকে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে এমন কথা জানিয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার বিষয়ে কয়েকদিন আগে আইনমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির কাছে একটা খসড়া দিয়েছেন। রবিবার এ বিষয়ক মাসদার হোসেন মামলা তালিকাভুক্ত ছিল। প্রধান বিচারপতি ওই খসড়ার কয়েকটি ধারা সম্পর্কে ওনাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে আমাকে আদালত জানিয়েছেন, আপীল বিভাগের বিচারপতিরা আইনমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের, যাদের সরকার পাঠাতে চান তাদের সঙ্গে বসতে চান। এ ব্যাপারটা সুরাহার জন্য। এ ব্যাপারে আমি মন্ত্রণালয়কে জানাব, বৈঠকের ব্যাপারে। ওনাদের মতামত কি সেটা জানানোর জন্য। আগামী বুধবার ওনারা (আপীল বিভাগ) বসতে চান। মামলার কার্যক্রম এ পর্যন্ত শৃঙ্খলা বিধির গেজেট প্রকাশে আপীল বিভাগ ২২ বার সময় দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষকে। তবে গত ২ জুলাই রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছিলেন, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এই গেজেট চূড়ান্ত হবে। এরপর তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুদফায় বৈঠক করেন। ২০ জুলাই এক বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধিমালা নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে এবং আমরা এই শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট করার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। এইসব বিষয় নিয়ে একটু খুঁটিনাটি বোঝার প্রয়োজন ছিল এবং যেসব বিষয় নিয়ে দ্বিমত ছিল সেগুলো অনেকাংশে দূর হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই (চলতি সপ্তাহে) তা হতে পারে। কিন্তু ২৩ জুলাই সময়ের আবেদনের পুনরাবৃত্তি ঘটে; রাষ্ট্রপক্ষকে এক সপ্তাহ সময়ও দেয়া হয়। গত ২ জুলাই সরকারকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে আপীল বিভাগ বলেছিল, এটাই ‘শেষ সুযোগ’। যদিও আপীল বিভাগ এর আগে কয়েকবার ‘শেষ সুযোগ’ উল্লেখ করে সময় দেয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ দফায় দফায় সময় নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকারের প্রণীত খসড়া শৃঙ্খলাবিধি সুপ্রীমকোর্ট তাদের সুপারিশসহ আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে সময় নেয় সরকার। ২০১৬ সালের ৭ নবেম্বর বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা ২৪ নবেম্ব^রের মধ্যে গেজেট আকারে প্রণয়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। আপীল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে তলব করেছিল আদালত। তবে ওই বছর ১১ ডিসেম্বর রাতে আইন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রের মাধ্যমে জানায়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির গেজেট প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরদিন ১২ ডিসেম্বর আপীল বিভাগ দ্বিমত পোষণ করে। আদালত বলেছে, ‘রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হচ্ছে।’ বিধি প্রণয়ন সম্পর্কে আপীল বিভাগ বলে, ‘এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। এখানে কোন কম্প্রোমাইজ নেই।’তবে আপীল বিভাগের এই অভিমত সত্ত্বেও বিগত সাত মাসেও এই গেজেট জারি করা হয়নি। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। ১২ দফার মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েক দফা বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এ জন্য বার বার আদেশ দিতে হয়েছে আপীল বিভাগকে। এমনকি ২০০৪ সালে আদালত অবমাননার মামলাও করতে হয়েছে বাদী পক্ষকে। এরপর ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ আপীল বিভাগ চার সপ্তাহ সময় দেন সরকারকে। এরপর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া শৃঙ্খলা বিধি তৈরি করে সুপ্রীমকোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে না হওয়ায় সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে আলাদা একটি শৃঙ্খলা বিধি তৈরি করেন। গত ২ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপীল বিভাগে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি আপীল বিভাগ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত চারটি বিধিমালা সাতদিনের মধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশের নির্দেশ দেন। তবে এ সংক্রান্ত মামলাটি এখনও আপীল বিভাগে বিচারাধীন। ১২ দফা নির্দেশনার যেসব দফা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ রয়েছে।
×