ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকির মুখে নতুন প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ৩০ জুলাই ২০১৭

ঝুঁকির মুখে নতুন প্রজন্ম

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ শিক্ষানগরী বলে পরিচিত বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ এখন মাদকে সয়লাভ হয়ে পড়েছে। সীমান্ত গলিয়ে বানের পানির মতো ইয়াবাসহ মাদক আসছে ময়মনসিংহে। হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। ফলে মাদকের ভয়াল থাবায় ডুবতে বসেছে এখন ময়মনসিংহ। এ অবস্থায় মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে শিক্ষার্থীসহ যুব ও তরুণ প্রজন্ম। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি মেধাবী শিক্ষার্থীরাও জড়িয়ে পড়ছে এ মরণ নেশায়। ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন মাদকের সহজলভ্যতা ও ভয়াবহ বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনের যে চিত্র সেটি কম হলে স্বস্তি ছিল। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ময়মনসিংহের নাগরিক নেতৃবৃন্দসহ অভিভাবকরাও। এ রকম পরিস্থিতিতে সচেতনতা বাড়াতে আজ রবিবার ময়মনসিংহ আসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি। স্থানীয় টাউন হলের এ্যাডভোকেট তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত মাদকবিরোধী বিভাগীয় সমাবেশে যোগ দেবেন মন্ত্রী। স্থানীয় সূত্র জানায়, সীমান্তজুড়ে অর্ধশত কারবারির সিন্ডিকেট মাদক নিয়ন্ত্রণ ও পাচারে সক্রিয় রয়েছে। শহর ও শহরতলীর শতাধিক স্পটে চলছে মাদক বেচাবিক্রি। শহরের রমেশ সেন রোডে প্রতিদিন শত শত গ্যালন মদসহ নানা মাদক বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। আর শহরের প্রতিটি অলিগলি ও পরিত্যক্ত বাসাবাড়িতে দিনরাত চলছে মাদক বেচাকেনা ও সেবন। শহর ও শহরতলীতে অর্ধশত স্পটের কথা বলা হলেও মূলত মাদকের কারবার ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত এর বিস্তার লাভ করেছে। পুরনো চিহ্নিত স্পটগুলোতে হানা দিয়ে তছনছ করে দেয়া হলেও মাদক কারবারিরা গড়ে তুলেছে অসংখ্য নতুন স্পট। এসব স্পটে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, হেরোইন, প্যাথেডিন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ নানা মাদক। চট্টগ্রাম ও আখাউড়া থেকে ট্রেনসহ ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন রুটে আসছে এ মাদক। স্থানীয় বেসরকারী তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থার মতে, ইনজেকটিক ড্রাগে ময়মনসিংহের স্থান এক নম্বরে। আর দেশে মাদক সেবন ও গ্রহণের জরিপে ময়মনসিংহের অবস্থান শীর্ষ ১০-এর ঘরে- এমন দাবি এ এনজিওর নির্বাহী পরিচালক ও এডাব সভাপতি খন্দকার ফারুক আহমদের। মাদকাসক্তদের ওপর ভর করে শহরে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত মাদক নিরাময় কেন্দ্র। অভিযোগ রয়েছে, এসব কেন্দ্রে মাদক সেবন চলে ফ্রি স্টাইলে। এর বাইরে এসব কেন্দ্রে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নাশকতাকারীরা নিরাপদ আস্তানা গড়ে তুলেছে। এ রকম অভিযোগে পুলিশ শহরের কাচিঝুলি এলাকায় সেতু নামের একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্র ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে। নেশার টাকা না দেয়ায় শহরের ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় আদরের সন্তানের হাতে মাকে প্রাণ দেয়ার ঘটনা রয়েছে ময়মনসিংহে। নেশার টাকার জন্য খুন-খারারি এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকের ভয়াল থাবায় অকালে জীবন দিতে হয়েছে মেডিক্যালশিক্ষার্থীসহ অসংখ্য মেধাবী ও সম্ভাবনাময় তরুণকে। সহজলভ্যতার কারণে ময়মনসিংহের কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজসহ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়ছে মাদকের সঙ্গে। নীরবে নিভৃতে মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে ঘরে ঘরে। শহরের সানকিপাড়া এলাকার ব্যাংকার হাবিবুর জানান, মাদক বিক্রেতা ও সেবীরা এতটাই সংঘবদ্ধ ও বেপরোয়া যে, প্রতিবাদ করলেই নাজেহাল নিশ্চিত। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসন এ বিষয়ে কাউকে সহায়তা করেছে এমন নজির নেই বলে দাবি এ ব্যাংকারের। ফলে সমাজে দায়িত্ব রয়েছে জেনেও প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসছে না কেউ। সরকারী সংস্থার স্থানীয় এক কর্মকর্তা আক্ষেপ করে জানান, তার সন্তানকে অনেক কষ্ট করে শহরের নামকরা একটি স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু তার এ মেধাবী সন্তানটি এখন মাদকাসক্ত। শহরের শীর্ষস্থানীয় একটি সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাদকের ভয়াবহতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, তার স্কুলের মেধাবী ছাত্ররাও জড়িয়ে পড়ছে সহজলভ্য মাদকে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপই পারে মাদকের এ ভয়াল থাবা থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে। সক্রিয় শতাধিক কারবারি ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা ময়মনসিংহের ধোবাউড়া ও হালুয়াঘাটের পাহাড়ী সীমান্ত গলিয়ে সড়কপথে এবং চট্টগ্রাম ও আখাউড়া থেকে রেলপথে ট্রেনসহ বিভিন্ন রুটে আসছে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, নেশার ইনজেকশনসহ ভারতীয় মদ। শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনার বিভিন্ন সীমান্ত গলিয়েও আসছে মাদক। বিজিবি গত দুই বছরে সীমান্ত গলিয়ে আসা ১৯ হাজার ৯১৪ বোতল বিদেশী মদ, ৭৮৬ বোতল ফেনডিসিল ৪৮ কেজি গাঁজা ও ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য আটক করলেও বন্ধ হচ্ছে না এর পাচার ও চালান। সড়কপথে আসা মাদকের চালান বিভিন্ন সময়ে পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবির হাতে ধরা পড়লেও ট্রেনে আসা চালান ধরা পড়ার কোন নজির নেই। এমনকি স্থানীয় প্রশাসনের ট্রেনে অভিযান চালানোরও কোন ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেনি। যদিও ট্রেনে আসা মাদকের চালান বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়ার কথা দাবি করেছে র‌্যাব। স্থানীয় সূত্র জানায়, কেবল হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া সীমান্তজুড়ে অর্ধশত মাদক কারবারির সিন্ডিকেট রয়েছে। হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ায় ২২ জনের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সীমান্তের এ মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক কারবারিদের অনেকে অস্ত্র কারবারের সঙ্গেও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রচার রয়েছে, স্থানীয় থানা পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে চিহ্নিত এসব মাদক কারবারি ও পাচারাকারীর দহরম-মহরম সম্পর্ক থাকায় এরা সব সময়ই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। হালুয়াঘাটের আইলাতলী, বান্দরঘাটা, সূর্যপুর ও ধোবাউড়ার চারুয়াপাড়া, ঘোষগাঁও, বাগপাড়া, ভূঁইয়াপাড়া স্পট দিয়ে ভারত থেকে মাদকের চালান ঢুকছে দেশে। পরে সড়কপথে ময়মনসিংহ ও রাজধানী ঢাকায় যাচ্ছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ধোবাউড়ার সুব্রত চিরান, রমজান আলী, আরজ আলী, টিপু সুলতান, সুমন মিয়া, আমিরুল, রাশিদ, কালাম, রশিদ মিয়া, লাল মিয়া শিকদার, আব্দুর রশিদ, মুক্ত মিয়া, হাশেম শিকদার, আব্দুল চেয়ারম্যান, মুখলেছ, হাসু চৌকিদার; হালুয়াঘাটের নান্টু, রিপন মিয়া, সাইফুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম কাম্বু, আরিফ মিয়া, সুরুজ মিয়া, কাদের মিয়া, হুমায়ুন কবীর মানিক, রেজাউল করিম ইরান, সাগর আহমেদ ও রিপন মিয়া; গফরগাঁওয়ের মোহাম্মদ আলী মিয়া, অনিক, উজ্জল, হাসিল ও রানা মিয়া; ময়মনসিংহ সদরের রবি, শাওন, ওয়াহিদ খান আরিফ, শফিকুল ইসলাম, ফরিদ হোসেন, সেন্টু মিয়া, রুমা আক্তার, রুপা আক্তার, শুভ, মামুন, পিয়াস, শের আলী, রাব্বী, নিমাই নাপিত, সারোয়ার আলম খান, জিয়া, রানা, মোবারক, শফিকুল, আকাশ, লম্বু জুয়েল, মুক্তার মিয়া, জিসান, অন্তু, মোঃ জনি, ছানী, বেবী আক্তার, শামসু, পরিতোষ, সিদ্দিক, মোড়ল, মোর্শেদ, রেহেনা, মহিউদ্দিন বিপ্লব, কুদ্দুস; ভালুকার বিল্লাল হোসেন, বিল্লাল মেম্বার, জুয়েল, ফারুক, ফুয়াদ, হযরত আলী; ফুলবাড়িয়ার অনিল ঋষি, জামাল উদ্দিন, আবুল কালাম, সানি; গৌরীপুরের সানাউল হক, সাহাবুল আলম, প্রদীপ বাগচী, রিয়াদুজ্জামান রিয়াদ, মনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হক রাসেল; নান্দাইলের রুকন মিয়া, বাবুল মিয়া, সুজন, শাহাবুদ্দিন, লিটন, বাদশা, গোলাপ, ফিরোজ; ত্রিশালের আল-আমিন, সুমন, সাত্তার, সজিব, ফয়েজ আলী, বাবুল, ফুরকান, রফিকুল ইসলাম, শফিকুল, রাহাত; ঈশ্বরগঞ্জের লিটন মিয়া, আব্দুল কাদের, সুলতান মিয়া, পলাশ, শ্যামল, মাসুদ রানা, আবুল কাশেম, অলি; তারাকান্দার জয়নাল আবেদীন, খাইরুল ইসলাম, হুমায়ন; মুক্তাগাছার ওয়াসিম, রফিকুল, হাবিবুর রহমান হবি, কালাচান, সোহেল মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত। সরকারের স্থানীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও এসব তথ্য রয়েছে।
×