ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর যেন বন্দীশালা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ জুলাই ২০১৭

কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর যেন বন্দীশালা

ফিরোজ মান্না ॥ বৈধ কাগজপত্র নিয়ে গিয়েও কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে প্রতিদিন হয়রানির শিকার হচ্ছেন শত শত বাংলাদেশী যাত্রী। ছাত্র এবং টুরিস্ট এমনকি সরকারী কর্মকর্তারাও হয়রানির হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। সন্দেহজনক মনে হলেই ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের আটক করে তাৎক্ষণিকভাবে পাঠিয়ে দিচ্ছে জেল হাজতে। তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে অমানবিক আচরণ। আটককৃতদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে টাকা পয়সা, দামী ঘড়ি ও মোবাইল। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ট্যুরিস্ট বিমানবন্দরে আটক থাকার পর দেশে ফিরে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশের চরম হয়রানির বর্ণনা দিয়েছেন। সম্প্রতি পদ্মা সেতুর সিনিয়র কনসালটেন্ট প্রকৌশলী আব্দুল মজিদ মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পেনাং সেতু পরিদর্শন করবেন। ইমিগ্রেশন পুলিশ ওই কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরেই আটকে দেয়। পরে তাকে বিমানবন্দরের একটি কক্ষে দীর্ঘ সময় আটক রাখার পর রাতের ফ্লাইটে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক আলোচনা জোরদার করেছে বলে জানিয়েছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা মালয়েশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি যখন মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনে যাই তখন ভোর। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এরমধ্যে এক পুলিশ এসে আমাকে লাইন থেকে সরিয়ে একটি রুমে নিয়ে যায়। এরপর অনেক সময় পরে একজন মহিলা পুলিশ এসে আমার কাছে এক শ’ ডলার দাবি করেন। আমি জানতে চাই কেন টাকা দেব। তখন আমাকে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করেন। পুলিশের ওই গ্রুপ চলে যাওয়ার পর পুলিশের আরেকটি গ্রুপ এসে আমাকে অন্য একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে দুই বাংলাদেশিকে কান ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমার ভেতরে ভীষণ ভয় কাজ করছিল। জানতে পারলাম তাদের জেল হয়েছে। কারও ৭ দিন কারও ১৫ থেকে ২১ দিন। তাদের সবার কাজ থেকে এক শ’ ডলার করে নেয়া হয়েছে। দুই বেলা খাবারের জন্য এই অর্থ নিয়েছে। কিন্তু খাবার দিচ্ছে এক বেলা। পানি চাইলে পানি দেয় না। সারাদিনে ছোট এক বোতল পানি দেয়া হয়। এভাবে আপনাকেও এখানে থাকতে হবে। এই রুমে আসা মানেই জেল হয়ে যাওয়া। কিছু সময় পর জানতে পারলাম সত্যিই আমার ৭ দিনের জেল হয়েছে। পরে পুলিশকে কয়েক শ’ ডলার ঘুষ দেই। আমার হাতের দামী ঘড়ি ও দামী মোবাইল সেটও তারা নিয়ে যায়। পুলিশ ঘুষ নিয়ে আমাকে বিকেলের ফ্লাইটে দেশে পাঠিয়ে দেয়। এমন ঘটনার বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানলেও কোন উদ্যোগ নেয়নি। যার কারণে বিমানবন্দরে এত নির্যাতন ও অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে বাংলাদেশী নাগরিকদের। এতে কর্তৃপক্ষের কোন মাথা ব্যথা নেই। সম্প্রতি মাওলানা হাবিবুর রহমান মিসবাহ নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে লিখেছেন, ধর্মীয় মাহফিলে যোগ দিতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। বৈধ ট্যুরিস্ট ভিসা, পর্যাপ্ত ডলার আর রিটার্ন টিকেট থাকার পরও তার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক। তিনি বলেন, খুব অবাক লাগে এটা ভেবে যে, এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হাইকমিশন একেবারেই নীরব। তারা যেন এখানে একজন নিরপেক্ষ রেফারি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশীদের যা কিছুই হোক না কেন, তাদের যেন মাস শেষে বেতন তোলা আর ফিতা কেটে উদ্বোধন ছাড়া অন্য কোন দায়িত্বই নেই। তাই তাদের থেকে কিছু আশা করাটাই যেন বোকামি। হাবিবুর রহমান লিখেছেন, আমার বৈধ ভিসা রিটার্ন টিকেট থাকার পরও পুলিশ আমাকে আটক করে নিয়ে যায়। পুলিশ সেদিন আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তা জীবনে ভোলার না। আমাকে যত রকম অপদস্ত করা যায় তারা করেছে। ঠিক মতো নামাজও পড়তে দেয়নি। টেনে হিঁছড়ে আমাকে এয়ারপোর্টের একটি রুমে ঢুকিয়ে পুরো কাপড় খুলে তারা সকলের সামনে চেক করল। আমি লজ্জায় মাথা নত করে পুলিশের সব অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছি। কোন কোন পুলিশ আবার বাংলাদেশী নাগরিকদের লাঠি দিয়ে বাড়ি মারছে আবার বুট জুতা দিয়ে লাথি মারছে। এ দৃশ্য দেখে আমার মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণ পরে মনে হয় আমাকেও এ রকম কিছুর শিকার হতে হবে। সারাদিন না খেয়ে কেটে গেল। পরে নানা হয়রানি সহ্য করতে করতে হাঁপিয়ে উঠলাম। এরপর পুলিশ যে যা খুশি বলে যাচ্ছে। আমি অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখে যাচ্ছি। দুইদিন আটক থাকার পর তারা আমাকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। গত ২০ জুলাই ভোরে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে পৌঁছান ডানপন্থী মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। নিয়ম অনুযায়ী ইমিগ্রেশন ডেস্কে পাসপোর্ট দেন তিনি। তখন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ডাটাবেজ চেক করার পর দুই শব্দ লেখা একটা কাগজ দেন তাকে। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন এতে লেখা ছিল ‘সন্দেহজনক’। তার মতো অনেকের আটক হওয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। ঢাকায় ফিরে তিনি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে আটকাবস্থার এমন অনেক ঘটনা বর্ণনা করেন। মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে আটকের পর কেন তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলো তার প্রকৃত কারণ তিনি জানেন না। বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাংলাদেশীকে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরও বিমানবন্দরে আটকে রেখে দেশে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার ভাষ্য, এন্টি ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্কের (এডিপিএএন) দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গত ১৯ জুলাই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের উদ্দেশে রওনা হই। ২০ জুলাই ভোরে ওখানে পৌঁছার পর আমাকে আটক করা হয়। এরপর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে আমাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। আদিল ঢাকায় ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের অন্যপ্রান্তের কক্ষটিকে ‘বন্দীশালা’ উল্লেখ করেন। বিমানবন্দরের এই বন্দীশালা বেসরকারীভাবে পরিচালিত। দুপুরের পর একজন কর্মকর্তা এসে আমাকে ৬ ফুট বাই ১০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে আমার দেয়া অর্থের বিনিময়ে দুপুরের খাবার ও এক কাপ চা দেয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমাকে সেখানে আটক রাখা হয়। এরপর প্রথমে যে কক্ষে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল সেই কক্ষে নিয়ে হিউম্যান রাইটস কমিশনের দুই প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। তাদের পুরো বিষয়টা জানাই। এরই মধ্যে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকাগামী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে আমাকে তুলে দেয়া হয়। তবে পাসপোর্ট দেয়া হয় একজন ক্রু মেম্বারের কাছে। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছালে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা ইমিগ্রেশন পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে বিমানবন্দর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসি। চোখের সামনে আটক ব্যক্তিদের দেখেছি কি অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। তাদের বৈধ ভিসা থাকার পরও মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ভিসা থাকার পরও মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে না দিয়ে বন্দীশালায় আটকে রেখে বাংলাদেশীদের উল্টো দেশে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, ট্যুরিস্ট ভিসার আড়ালে কর্মী পাঠানোর কারণে মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে এত কঠিন অবস্থানে গিয়েছে।
×