ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মামলাকারী সাজু আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কার

ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২২ জুলাই ২০১৭

ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করে কার্ড ছাপানোর অভিযোগে একজন ইউএনও গ্রেফতারের ঘটনায় খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিস্মিত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার পত্র-পত্রিকায় এই খবর দেখে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কর্মকর্তারাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। এ ঘটনায় প্রশাসনের মধ্যেও তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ ও বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতেই কিছু অতিউৎসাহী ও চাটুকাররা এ কর্মকা- ঘটিয়েছে। এদিকে শুক্রবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক থেকে ইউএনও’র বিরুদ্ধে মামলাকারী বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীসহ দলের প্রায় সব সিনিয়র নেতাই এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। বৈঠকে থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ওবায়েদ উল্লাহ সাজুকে কেন দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না এ বিষয়ে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস প্রদানেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ, কাজী জাফর উল্লাহ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, রাশেদুল হাসান, মাহবুবউল আলম হানিফ, ডাঃ দীপু মনিসহ বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন। বরগুনার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে মামলা ও তার জামিন বাতিলের ঘটনা নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নাজেহালের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে সরকারী কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির মহাসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ারের সভাপতিত্বে এক জরুরী সভা থেকে এ নিন্দা জানানো হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। বৃহস্পতিবার পত্র-পত্রিকায় এই খবর দেখে প্রধানমন্ত্রী দফতরের কর্মকর্তারাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান এবং তারা বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনেন। ছবিটি দেখে প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বৃহস্পতিবার রাতে বিবিসি বাংলার রাতের অধিবেশন পরিক্রমায় এক সাক্ষাতকারে বলেন, আমরা সবাই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আজ যত কর্মকর্তা ছিলেন, এটি দেখে আমরা সকলেই বিস্মিত হয়েছি। যে ব্যক্তি এই মামলা করেছেন, আমরা মনে করি তিনি অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ করেছেন। তিনি জানান, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে একজন ইউএনওকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার এই ছবিটি দেখান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্ধৃত করে এইচ টি ইমাম বলেন, ছবিটি দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ক্লাশ ফাইভের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এই অফিসার সুন্দর একটি কাজ করেছেন এবং সেখানে যে ছবিটি আঁকা হয়েছে, সেটি আমার সামনেই আছে, আপনারা দেখতে পারেন। এই ছবিটিতে বিকৃত করার মতো কিছু করা হয়নি। এটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। আর এই অফিসারটি রীতিমতো পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। আর সেখানে উল্টো যা করা হয়েছে সেজন্য জড়িতদের তিরস্কার করে তিনি বলেন, এটি রীতিমতো নিন্দনীয়। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীকে কিভাবে গ্রেফতার করা হলো কোনরকম অনুমোদন ছাড়া এমন প্রশ্নের উত্তরে এইচ টি ইমাম বলেন, এটি করা যায় না। কারণ ইউএনও হচ্ছেন উপজেলা পর্যায়ে সরকারের সবচেয়ে উর্ধতন কর্মকর্তা। তাকে কোন শাস্তি দিতে হলে বা তার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা কোন রকম কিছু করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। এইচ টি ইমাম এই ঘটনার জন্য বরিশালের ডিসি, এসপিকে দায়ী করে বলেন, পুলিশ যে ব্যবহার করেছে এই ছেলেটির (ইউএনও) সঙ্গে, যেভাবে তাকে নিয়ে গেছে, এ নিয়ে আমি ওখানকার ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, এদের প্রত্যেককে দায়ী করব। এদের বিরুদ্ধেও আমাদের বোধ হয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিভাবে পুলিশ এ রকম একটি মামলা নিল আর জেলা জজই কিভাবে এই মামলা গ্রহণ করলেন, সেটা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন। এইচ টি ইমাম বলেন, এই ঘটনায় মাঠপর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তিনিও তাদের সঙ্গে একমত। আমাদের অফিসারটিকে যেন হেনস্থা করার জন্য পুলিশ যেভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে, এই পুরো ঘটনায় যে রকম তীব্র ক্ষোভ ফেটে উঠেছে, আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তিনি বলেন, ঘটনাটি শোনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, যে ব্যক্তি এই মামলা করেছে, সে কে? মামলা দায়েরকারী ব্যক্তি সম্পর্কে সঙ্গে সঙ্গে তারা খোঁজখবর নেন, একথা জানিয়ে এইচ টি ইমাম বলেন, এই লোক পাঁচ বছর আগেও আওয়ামী লীগে ছিলেন না। দলের ভেতরে ঢুকা পড়া এই ‘অতি উৎসাহীরাই’ এই কা- ঘটিয়েছে, এই চাটুকাররাই আমাদের ক্ষতি করছে। তিনি বলেন, এই ঘটনার পেছনে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, এই অফিসারের বিরুদ্ধে হয়ত তাদের কোন ক্ষোভ ছিল। তাকে অপমাণিত করা ছিল তাদের লক্ষ্য। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সার্ভিসের মধ্যে একটি অসন্তোষ সৃষ্টি করা। আর তৃতীয়ত, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা। সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে এ প্রসঙ্গে কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হুবহু ছবি আজ পর্যন্ত কেউ আঁকতে পারেনি। আমরাও যেগুলো ব্যবহার করি ওইসব ছবিতেও কিছু খুঁত থাকে। হুবহু হয় না, আমি তো জানি। তিনি বলেন, শিশুদের কল্পনায় বঙ্গবন্ধু যেভাবে ফুটে উঠেছেন তা তারা প্রকাশ করেছে। আর ওই ছবি ব্যবহার করে ইউএনও’র কার্ড ছাপানোর উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এই ছবি ব্যবহার করা নিয়ে যারা এটা করেছে তারা নিশ্চয় সরকার ও দলের জন্য ভালো কিছু করেনি। শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, এ ঘটনা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির সমমনাদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেক নেতাই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এক শ্রেণীর চাটুকার বিভিন্ন সময়ই এ ধরনের মামলা করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে। বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে অনেক ব্যক্তি এবং অনেক ভূঁইফোঁড় সংগঠনের কর্মকা- তাদের দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। উল্লেখ্য, তারিক সালমান বরিশালের আগৈলঝড়ায় ইউএনও থাকাকালে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে একটি নিমন্ত্রণপত্র ছাপান। ওই নিমন্ত্রণপত্রের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করে ছাপানো হয়েছে- এমন অভিযোগে বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু গত ৭ জুন ওই ইউএনও’র বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। ওই দিনই মামলাটি আমলে নিয়ে তারিক সালমানকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে সমন জারির আদেশ দেন। গত বুধবার আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে প্রথমে তা নাকচ হলেও দ্বিতীয়বার তারেক সালমানের জামিন মঞ্জুর করা হয়।
×