ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমিনুল ইসলাম মিলন

অভিমত ॥ মান্না ভাইয়ের কেবলা বদল

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৯ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ মান্না ভাইয়ের কেবলা বদল

জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির এককালের উজ্জ্বল নক্ষত্র। চাকসুতে একবার জিএস এবং ডাকসুতে দুবার নির্বাচিত ভিপি হওয়ার অসামান্য ও বিরল গৌরবের অধিকারী। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্তির পূর্বে ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্তির পরে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতা। অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা ও তেজস্বী বাগ্মী হিসেবে ছাত্র সমাজের কাছে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। বর্তমান সরকারের সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে ডাকসুতে পরাজিত করে ছাত্র সমাজের মাঝে অসামান্য জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেছিলেন। বাংলাভাষার ওপর দক্ষতা, বাচনভঙ্গি, শব্দ চয়ন ও বাক্য বিন্যাসের দক্ষতা তাঁকে একসময় পৌঁছে দিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। মনে পড়ে ডাকসু নির্বাচনে মুজিববাদী ছাত্রলীগের কর্মী থাকলেও সুযোগ পেলে তাঁর বক্তৃতা শুনতাম। এই মান্না ভাই ছাত্রজীবন শেষে স্বাভাবিকভাবেই জাসদ রাজনীতির অংশ হয়ে পড়লেন। এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না কিছুদিন পরেই তিনি আ ফ ম মাহবুবুল হক ও খালেকুজ্জামান এদের সঙ্গে মিলে জাসদ থেকে বেরিয়ে গঠন করলেন নতুন দল-বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। ১৯৮৩ সালে বাসদ দ্বিখ-িত হলে তিনি আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে বাসদ (মাহবুব) এ যোগ দেন। কিন্তু না, এ বাসদও জনমুক্তি নিশ্চিত করবে না মনে হওয়ায় তিনি ‘জনতা মুক্তি দল’ নামে নিজেই একটি দল গঠন করলেন। মনে হয় সেখানেও দিনকাল ভাল যাচ্ছিল না, অবশেষে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলেন। যোগদান করলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন। সালটা ছিল ১৯৮৫। বগুড়া থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পান। কিন্তু দু’বারই পরাজিত হন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলে মনোনয়ন পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়! বুদ্ধিমান লোক, বুঝে গেলেন হয়ত তৃতীয়বার নমিনেশন পাবেন না। আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকার মেয়র পদে নির্বাচনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। কিন্তু কিছুতেই ব্যাটে-বল মিলছিল না। ফলে রানও হচ্ছিল না। তখনই শুরু করলেন দলের নেতা হয়ে দলের বিভিন্ন কর্মকা-ের প্রকাশ্যে সমালোচনা। টিভি টকশোতে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে থাকলেন। নাগরিকদের অধিকার আদায়ের জন্য গঠন করলেন নাগরিক ঐক্য। কোন নাগরিক তার অধিকার আদায় করিয়ে দেয়ার জন্য মান্না ভাইয়ের স্মরণাপন্ন হয়েছেন- প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার এত বিস্তৃত বাজারে একবারও তার হদিস পেলাম না। আবার বাজারে গুজব ছড়ানো হয়, তিনি নাকি একটি বড় দলে যোগদান করছেন। যোগদান করলে করবেন, তাতে অন্যের কী! এটাও যখন হালে পানি পায়নি তখন বেপরোয়া ভাবটা বেরিয়ে পড়ে। গোয়েন্দাদের কাছে তখন ঢাকা-নিউইয়র্ক দুরালাপনি ষড়যন্ত্রের সকল মাল-মসলা। আর যায় কোথায়Ñ স্বাভাবিক পরিণতি বরণ। মধ্যরাতে গ্রেফতার। কারাগার-হাসপাতাল-কোর্ট-কাচারি করে অবশেষে মুক্তি। মুক্ত হয়ে দেখলেন- না এভাবে আন্দোলন হয় না। আন্দোলন করতে দল লাগে-কর্মী লাগে, সব তো ঠিকই ছিল- তাই সম্প্রতি গঠন করলেন নতুন রাজনৈতিক দল- ‘নাগরিক ঐক্য’। কিন্তু ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু জল গড়িয়ে গেছে। এখন কোন দল একক নির্বাচন করে না-১০/২০/৩০/৫০ দলের জোট হয়। মান্না ভাই কোন জোটে যায়- সেটাই এখন দেখার বিষয়। উত্তরায় জনাব আ স ম আবদুর রব ভাইয়ের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে যোগদান ইঙ্গিত দেয় সহসাই নতুন একটি জোটে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাপক সরব-‘মান্নারা ’৭৫ পরবর্তী সময়ে ডাকসুর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামরিক জান্তা জিয়ার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন হতে দেয়নি। ওদের ভয় ছিল বেনিফিশিয়ারি হবে আওয়ামী লীগ। ওদের জন্যই সামরিক শাসন দীর্ঘ হয়েছিল। জাসদের নেতারা সামরিক জান্তাদের দালালিতে ব্যস্ত ছিলেন। আ স ম রব সাহেব সামরিক শাসকদের বদৌলতে জার্মানিতে তথাকথিত চিকিৎসার নামে বিনোদন ট্যুরে যান।’ কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়। শত শত জাসদ নেতাকর্মী তখন জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। তাদের বেশিরভাগই এখন ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, কানাডায় বসবাস করে। সচ্ছল জীবনযাপন করেন। একদা ম্যাকিয়াভেলী রাজাকে সিংহের মতো শৌর্যবান এবং শৃগালের মতো ধূর্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার মতে- জীব জগতের সিংহ ও শৃগাল খুব সহজেই বিপত্তি এড়াতে পারে। এক্ষেত্রে সিংহ তার শক্তি ও সাহসের কারণে সফল হয়ে থাকে এবং শৃগাল সফল হয়ে থাকে তার ধূর্তবুদ্ধির মাধ্যমে। আমাদের মান্না ভাইরা কোন্ দলে পড়েন সেটাই বিবেচ্য। তবে ’৭৪-এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও এবং ’৭৫ এর নবেম্বরে সিপাহী জনতার ব্যর্থ বিপ্লবে সিংহের পরাক্রমের হদিস না মিললেও তাদের ধূর্তবুদ্ধির হদিস কিন্তু হরহামেশাই দেখা যায়। আজকের পত্রিকায় দেখলাম প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন- ‘বেকুব বলেই আওয়ামী লীগে গিয়েছিলাম’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদলের আরেক মহানায়ক ব্যারিস্টার মওদুদও সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে আর মন্তব্য করতে চাই না। সাবাশ মান্না ভাই, আপনি দেখিয়ে দিলেন- প্রতিভা থাকলে দল বদল-দল ভাঙ্গন-দল গঠন কোন সমস্যাই নয়। আওয়ামী লীগ (ঐক্যবদ্ধ ছাত্রলীগের কারণে)-জাসদ-বাসদ (ভগ্নাংশ)-জনতা মুক্তি দল-নাগরিক ঐক্য-সর্বশেষে নাগরিক ঐক্য নামে পৃথক রাজনৈতিক দল। নিঃসন্দেহে আপনি ৬০ পেরিয়ে গেছেন। মাশাল্লাহ্ ৬০ বছরে ৬টি দল। কেবলা বদলে এর জুড়ি নেই। রাজনীতিতে দল বদল নতুন কিছু নয়। একসময় এদেশের রাজনৈতিক নেতাগণ কংগ্রেস করতেন- পরে সবাই মুসলিম লীগ করেছেন-পাকিস্তান হওয়ার পরে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ থেকে জন্ম নেয় ন্যাপ। ন্যাপ আবার দুই ভাগ হয়। ন্যাপ মুজাফফর-মস্কোপন্থী, ন্যাপ ভাসানী-চীনপন্থী। শেরে বাংলাও কয়েকবার দল বদল করেছেন। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ- পরে নিজে গড়ে তুললেন কৃষক প্রজা পার্টি। দল বদলের খেলায় মরহুম কাজী জাফর আহমেদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ফেরদৌস আহমেদ কোরাইশীসহ অনেক নেতার নাম পাওয়া যাবে। মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত- এরা তো দল বদলের সোনালি হংস। এক্ষেত্রে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে কেউ টেক্কা দিতে পারেননি। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে তিনিও বদলে যান। হয়ে যান ক্ষমতার অংশ। এবার ব্যতিক্রম। তবে আপনিই বর্তমানে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন রাজনীতিবিদ। যিনি ৬০-৬৫ বছরে ৬-৭ বার কেবলা বদল করেছেন। ভবিষ্যতে আর কোনদিকে নতুন কেবলার খোঁজ করবেন- তা ভবিষ্যতই বলতে পারে। ৬০ বছরে যে ঈমাম ৬ বার কেবলা বদলায়- তার পেছনে আদৌ কোন মুসল্লি পাওয়া যাবে কি? হায়-রে দুর্ভাগা দেশ! রাজনীতির নামে এদেশের মেধাবী সন্তানরা কিভাবে হারিয়ে যায়। লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা
×