ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৪ জুলাই ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ হেস্তনেস্ত করে ছাড়ল চিকুনগুনিয়া। অনেক হয়েছে। আর ছড়াবে না। এমনটি, হ্যাঁ, আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি। কিছুদিন আগেও প্রশ্ন করা যেত, কার কার এই রোগ হয়েছে? এখন প্রশ্নটি- হয়নি কার? অবস্থা এত বেগতিক! শহর ঢাকার যেখানে যার সঙ্গেই দেখা হয় জানা যায়, তিনি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত অথবা রোগটি থেকে সদ্য মুক্তি লাভ করেছেন। আশ্চর্য এক রোগ! আফ্রিকা থেকে ওড়ে আসা বিষ ব্যথায় শরীর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। শিশু বৃদ্ধ নারী পুরুষ কেউ আর আস্ত নেই। মারা যাচ্ছেন না বটে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছেন। আক্রান্তদের, ইশ, কী চেহারা! তাকনো যায় না। গত বুধবার জাতীয় জাদুঘরের এক কর্মকর্তার কক্ষে বসে প্রয়োজনীয় কথা হচ্ছিল। কিন্তু প্রসঙ্গ হয়ে ঠিক এলো চিকুনগুনিয়া। কিপার স্বপন কুমার বিশ্বাস এখন মোটামুটি সুস্থ। কিন্তু যে ভুগান্তির মধ্য দিয়ে গেছেন তা তার চেহারার দিকে তাকিয়ে অনুমান করা যায়। তিনি বললেন, এত কষ্ট, এত কষ্ট, কী বলব! অফিসের চেয়ারে বসে একদিন তো মনে হচ্ছিল, আর উঠা হবে না। বসা অবস্থায়ই হয়ত পড়ে যাব। পড়ে মারা যাব। আলোচনার একপর্যায়ে যোগ দেন আলোকচিত্রী এম এ তাহের। যথারীতি আক্রন্ত হয়েছিলেন তিনিও। ডান হাতটি দেখিয়ে তিনি বললেন, মনে হয় আঙুলগুলো এখনও ভাঙ্গা। মুঠো করতে পারি না। জীবনীশক্তি অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে আমার। একদিন তো অচেতন হয়ে বিছানায় পড়েছিলাম। কীভাবে ২৪ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে টের পাইনি। ব্রেনে পর্যন্ত আঘাত করেছিল চিকুনগুনিয়া। পুরনো এয়ারপোর্ট রোডের বাসিন্দা ম্যাভিস জেসমিনের কথাটাও উল্লেখ করার মতো। গত কয়েকদিন আগে অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা। তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। চিকুনগুনিয়া নিয়ে খুব কিছু তিনি বললেন না। শুধু বললেন, আমার শত্রুরও যেন না হয় এই রোগ! এবার একটু পেছন ফেরা যাক। মনে আছে, অনেকেই একসময় চিকুনগুনিয়া নিয়ে হাসি তামাশা করেছেন? জ্বর তো জ্বর-ই। এ নিয়ে হুলুস্থূল করার কিছু নেই। মশকরা চলছিল। সবচেয়ে বেশি মশকরাটা ঢাকার দুই মেয়র করেছেন। হ্যাঁ, দুজনই কোন কোন ইস্যুতে খুব সফল। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু চিকুনগুনিয়ার মতো দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে তারা একদমই রক্ষা করতে পারেননি, এ কথা বলতে হবে। এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যাটিকে এড্রেস করতেই ব্যর্থ হয়েছেন বলে প্রতিয়মান হয়। এত বড় রাজধানী শহরের প্রায় পুরোটা এডিস মশার দখলে চলে গেছে, ভাবা যায়? অথচ তারা কেউ টের পেলেন না! মশা নিধনে কিছু রুটিন কাজ তো করে সিটি কর্পোরেশন, সেগুলোও এ বছর দেখা গেল না। অথচ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্প্রে ও ওষুধ ছিটানোর মাধ্যমে মশা ধ্বংস করতে উত্তর সিটি কর্পোরেশন নাকি ব্যয় করেছে ১৮ কোটি টাকা। ১৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু শহরের কোথাও তেমন কোন কার্যক্রম দৃশ্যমান হলো না। এখন যখন মহামারি পর্যায়ে, যখন বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, নড়েচড়ে বসেছেন সিটি কর্পোরেশনের কর্তা ব্যক্তিরা। এখানে ওখানে ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটাতে দেখা যাচ্ছে। ছিন্নমূল মানুষ যারা ফুটপাথে ঘুমান তাদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে মশারি। শান্তিনগরের একটি মার্কেটের সামনে রাতে দেখা গেল, বেশ কিছু ভ্যান পাশাপাশি রাখা। প্রত্যেকটিতে মশারি টানানো হয়েছে। এমন দৃশ্য নতুন বটে। চিকুনগুনিয়া কোন পর্যায়ে গিয়েছে দৃশ্যটি দেখে তা অনুমান করা যায়। অবস্থা যখন তথৈবচ তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতর অধিদফতরের পক্ষে কাউকে কথা বলার জন্যও পাওয়া যায়নি। চিকুনগুনিয়া নিয়ে কোন ধরনের সতর্কতা বা আগাম বার্তা দেয়নি কোন কর্তৃপক্ষ। এখন তারাও মনে হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। করলে ভাল। সকলের প্রচেষ্টায় দূর হোক চিকুনগুনিয়া। মুখের হাসিটি ফিরে পাক নগরবাসীÑ সকলের তা-ই প্রত্যাশা। কাটা-ছেঁড়া রাস্তাঘাটের কথাও বলা জরুরী। বর্ষার আগে আগে ঢাকার রাস্তা ঘাট কেটে ফেলে রাখা হয়। এবারও হয়েছে। এই অপকর্ম যেন আইনসিদ্ধ ব্যাপার হয়ে গেছে! বর্ষা শুরুর অনেক আগেই কাটা হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক। অলিগলি ফুটপাথও ল-ভ- করা হয়েছিল। সে কী ধুলো তখন উড়েছে! সবাই এরপরও সহ্য করেছেন। বর্ষায় দুর্ভোগ কমবে, এই আশায়। কমলো না। বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। টানা বর্ষণে নদী খাল বিলে পরিণত হচ্ছে রাজধানী। কোন রাস্তার উদাহরণ দেব? কয়টির কথা বলা যাবে এই ছোট্ট লেখায়? আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর যাওয়ার রাস্তাটির কথাই ধরা যাক। সেই কবে কোন কালে খুঁড়া শুরু হয়েছিল, এখনও শেষ হয়নি। গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক যাদের ব্যবহার করতে হয় তারা জানেন দুর্ভোগ কাহাকে বলে! যানজট জলযটও লেগে আছে। ভিআইপি সড়ক কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের কথাই যদি বলি, গাড়ি সেখানে চলছে কি? সামান্য বৃষ্টিতেই নদীর চেহারা। গাড়ি চলবে কী করে? যানজট বাড়ছে শুধু। পথচারীদের জলে সাঁতার কাটার অভিজ্ঞতা হচ্ছে প্রতিদিন। দেখার কেউ নেই। দুই-একদিন পর পরই অচল হয়ে যাচ্ছে রাস্তাটি। জরুরী একটা পদক্ষেপ নিতে দেখা গেল না। বৃষ্টির জল যখন আপনি গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে তখন স্বাভাবিক হচ্ছে অবস্থা। অন্যথায় গোল্লায় যাক সব, দেখার কোন কর্তৃপক্ষ নেই!
×