ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফরহাদ মজহার সমাচার

সাজানো নাটক

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৪ জুলাই ২০১৭

সাজানো নাটক

শংকর কুমার দে ॥ কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার অপহরণের সাজানো নাটক করতে গিয়ে ফেঁসে যেতে পারেন। তিনি গুরু বাবা সেজে তার সেবাদাসী অর্চনা রানীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে তার। আইনের চোখে গর্ভপাত ঘটানো একটি গুরুতর অপরাধ। মালিবাগের যেই ক্লিনিকে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে সেই ক্লিনিকটির খোঁজ করছে তদন্তকারীরা। ফরহাদ মজহার মাইক্রোবাসে অপহৃত হয়েছেন এবং তিনজনে তাকে অপহরণ করেছে তারও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। অপহরণের নাটক সাজিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হয়রানি ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কারণে তারা যে মামলা দায়ের করেছেন সেই কারণেও ফরহাদ মজহার ফেঁসে যেতে পারেন বলে জানা গেছে। বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনেও পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের মনে হয়েছে, ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় খুলনা গিয়েছিলেন, অপহরণের কোন ঘটনা সেখানে ঘটেনি। ফরহাদ মজহার অপহরণের মামলার তদন্ত করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে ফরহাদ মজহারকে গুরু বাবা সম্বোধনকারী অর্চনা রানী আদালত ও পুলিশের কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, একবার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর মালিবাগের একটি ক্লিনিকে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে। গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে গুরু বাবা ফরহাদ মজহারের পরামর্শে। গর্ভপাত ঘটানোর জন্য ক্লিনিকের সমস্ত টাকাও পরিশোধ করেছেন গুরু বাবাই। মালিবাগের যেই ক্লিনিকে তার গর্ভপাত ঘটানো হয়েছে সেই ক্লিনিকটির খোঁজ নিচ্ছেন তদন্তকারীরা। গর্ভপাত ঘটানোর কারণে যে গুরুতর অপরাধ করা হয়েছে সেই বিষয়েও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অর্চনা রানী জবানবন্দীতে বলেছেন, গত এপ্রিল মাসের ১৬ তারিখে আবারও গর্ভবতী হন তিনি। প্রায় তিন মাস আগে তার গর্ভবতী হওয়ার কারণেই তিনি তার গুরু বাবার কাছে টাকা চান। গুরু বাবা টাকার জন্য চিন্তায় পড়ে যান। গুরু বাবা তার জন্য টাকা সংগ্রহ করতে গিয়েই বাড়ির বাইরে বের হন গত ৩ জুলাই। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্চনার টাকা সংগ্রহ করতে গিয়েই অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন। অপহরণের নাটক সাজাতে গিয়ে এখন ফেঁসে যেতে পারেন তিনি। তিনি যে অপহৃত হননি তার মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই করেই প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঘটনার দিন ফরহাদ মজহার বাসা থেকে বের হয়ে তার সেবাদাসী অর্চনার সঙ্গে কথা বলেছেন ভোর সাড়ে ছয়টায়, বেলা এগারোটায়, সন্ধ্যা সাতটায়সহ অন্তত ছয়বার। এর মধ্যে আবার এসএমস পাঠিয়েছেন, পাঠিয়েছেন অর্চনার জন্য টাকাও। অপহৃত হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কিভাবে? তবে এখনও যেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি তার মধ্যে রয়েছে তাকে অপহরণে ব্যবহৃত মাইক্রোবাস, অপহরণকারী তিনজনের বিষয়টি। এজন্য খুব শীঘ্রই ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তার অপহরণের সাজানো নাটকটির রহস্য উদঘাটনের তদন্ত করা হচ্ছে। অপহরণের নাটক সাজাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ফরহাদ মজহার নিজেই ফেঁসে যেতে পারেন বলে তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে। পুলিশের আইজি যা বলেন ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনাটি ছিল সাজানো। মূলত একজন নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরে অপহরণ ঘটনার সূত্রপাত। ওই নারীকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতেই পরিকল্পিতভাবে অপহরণের নাটক সাজানো হয়েছিল। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সরকারকে বিব্রত করতেই এমন নাটক সাজানো হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে বিদেশে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী থেকে ফরহাদ মজহারকে দ্রুত উদ্ধারের দাবি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় পার্শ্ববর্তী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। যার আদৌ কোন সত্যতা মেলেনি। বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এমনটা দাবি করেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। আইজিপি বলেন, ঘটনার পর পরই বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়। ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ফরহাদ মজহারের কাছে একটি সাদা ঝোলা ব্যাগ ছিল। যদিও পরিবারের তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ ধরনের ব্যাগ ফরহাদ মজহার ব্যবহার করেন না। পরিবারের এমন বক্তব্য ভিত্তিহীন। ফরহাদ মজহারকে মাইক্রোবাসে করে অপহরণের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। কারণ ফরহাদ মজহার কিভাবে খুলনা গেলেন তা এখনও স্পষ্ট না। বাসে করেও তিনি খুলনা যেতে পারেন। তদন্তে জানা গেছে, ঘটনার পর থেকে ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীর সঙ্গে দশ বার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। আর এক নারীর সঙ্গে ৬ বার মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। ওই নারী রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকায় থাকতেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় চলে যান। সেখান থেকে পুলিশ তাকে ঢাকায় আনে। ঢাকায় এসে ওই নারী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে অপহরণের সাজানো নাটকের বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ প্রধান বলেন, ফরহাদ মজহারকে অপহরণের ঘটনাটি জানার পর পরই তার পরিবারের উচিত ছিল থানা পুলিশকে বিষয়টি জানানো। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। ঘটনার অনেক পরে সকাল আটটার দিকে বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হয়। পুলিশ ঘটনা জানার পর থেকেই ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করা শুরু করে। যেসব রাস্তা দিয়ে ফরহাদ মজহারের যাওয়ার বিষয়টি জানা যায়, সেসব রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্ট বসায়। পরিবারের ভাষ্য মোতাবেক মাইক্রোবাসে করে ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করা হয়েছে। প্রতিটি চেকপোস্টে সব মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালানো হয়। কোন মাইক্রোবাসেই ফরহাদ মজহারকে পাওয়া যায়নি। তদন্তে ফরহাদ মজহারের অপহরণ এবং মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। ফরহাদ মজহার কিভাবে খুলনা গেলেন তা স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, তিনি বাসে করে বা অন্য কোন উপায়ে খুলনা গিয়েছিলেন। খুলনার নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় তিনি ঘুরে বেড়ান। সেখানকার একটি দোকান থেকে এক নারীর কাছে ডাচ বাংলা ব্যাংকের রকেট সার্ভিসের মাধ্যমে একবার ১৩ হাজার আবার ২ হাজার, দুই দফায় মোট ১৫ হাজার টাকা পাঠান। যে দোকান থেকে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেই দোকানের টাকা পাঠানোর যাবতীয় প্রমাণাদিও সংগ্রহ করা হয়েছে। এরপর তিনি হানিফ পরিবহনের একটি টিকেট নিজেই কাটেন। যদিও তিনি ইতোপূর্বে আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে দাবি করেছেন, অপহরণকারীরা তার হাতে একটি টিকেট ধরিয়ে দিয়ে সোজা ঢাকা যেতে বলে। তাকে অপহরণকারীদের লোকজন অনুসরণ করছে বলে জানানো হয়। আসলে এর কিছুই হয়নি। ফরহাদ মজহার নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করে গফুর নামে হানিফ পরিবহনের একটি টিকেট কাটেন। টিকেট জব্দ করা হয়েছে। ওই টিকেট কাউন্টারের মাস্টার ইতোমধ্যেই আদালতে এসে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে বলেন, ফরহাদ মজহার নিজেকে গফুর পরিচয়ে হানিফ পরিবহনের ওই টিকেটটি ১৩শ’ টাকায় কাটেন। পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, ফরহাদ মজহারের পক্ষের আইনজীবীরা নানা অভিযোগ করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে। তাদের প্রথম অভিযোগ ফরহাদ মজহারকে আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই আদালতে হাজির করা হয়েছে। হাজির হয়ে ফরহাদ মজহার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। পুলিশ প্রধান বলেন, ফরহাদ মজহার এ মামলার আসামি নয়। ভিকটিম। তার পক্ষে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। এজন্য আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার দাবি অযৌক্তিক। তিনি সুধী সমাজের প্রতি এ ধরনের বিষয়ে আগাম কোন মন্তব্য না করতে আহ্বান জানান। পুলিশ প্রধান বলেন, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে ফরহাদ মজহারের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে অনেক আপত্তিকর মন্তব্য করেন। যা একেবারেই ভিত্তিহীন। ডাঃ জাফরুল্লাহ টকশোতে বলেছিলেন, পাশের দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করেছিল। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। যা একেবারেই ভিত্তিহীন। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় আগাম মন্তব্য না করার জন্য তিনি সুধী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। প্রসঙ্গত, ভারতে গরু জবাইয়ের সূত্রধরে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনার বিষয়ে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ঘটনার আগের দিন অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার নানা মন্তব্য করেন। তারই জেরধরে দেশটির একটি গোয়েন্দা সংস্থা ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করেছিল বলে সরকার বিরোধীরা দাবি করে আসছেন। পুলিশ প্রধান বলেন, ফরহাদ মজহারের অপহরণের সঙ্গে কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বা কারও জড়িত থাকার কোন তথ্য মেলেনি। কারণ ফরহাদ মজহার অপহৃত হননি। অপহরণের ঘটনাটি ছিল পুরোটাই নাটক। উবিনীগে চাকরি করার সুবাদে এক নারীর সঙ্গে ফরহাদ মজহারের দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। ওই নারীই আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে অপহরণের নাটকটি পরিষ্কার করেছেন। ২০০৭ সালেও একবার অবৈধ সম্পর্কের জেরে ওই নারী গর্ভবতী হয়েছিল। এবারও একই ঘটনা ঘটেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে ওই নারী ফরহাদ মজহারের কাছে টাকা চান। টাকা যোগাড় করতে ফরহাদ মজহার অপহরণ নাটক সাজান। ওই নারীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময়, ওই নারী ফরহাদ মজহার অপহৃত হয়েছেন কি না জানতে চেয়েছিল। উত্তরে ফরহাদ মজহার বলেছেন, কোন অসুবিধা নেই। তিনি ভাল আছেন। টাকা যোগাড় করার পাশাপাশি সরকারকে বিপদে ফেলতেই ফরহাদ মজহার নিজেই অপহরণ নাটকটি সাজান। এমনকি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ নাটক সাজানোর পর দেশে বিদেশে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়। বিশেষ করে লন্ডনে শহীদ মিনারের সামনে বিরাট মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়। কর্মসূচী থেকে দ্রুত ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করতে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। যা ছিল একেবারেই পরিকল্পিত। এটি ছিল মূলত সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর কৌশল। পরিকল্পিতভাবে এমন নাটক সাজিয়ে দেশ, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেশে-বিদেশে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার বিষয়ে ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ফরহাদ মজহার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীর শেষ দিকে তিনি বলেছেন, যারা এই সরকারকে পছন্দ করে না। তারা দেশের ভেতরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি করতে চায়, তারাই আমাকে অপহরণ করেছিল বলে অপহরণকারীদের কথাবার্তায় মনে হয়েছে। এটি ছিল ফরহাদ মজহারের স্ট্যান্ডবাজি। যাতে সরকার তার পক্ষে থাকে। মূলত সরকারকে খুশি করতেই তিনি এমন কথা বলেছেন। যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার প্রতি খুশি হয়ে অপহরণের ঘটনাটি নিয়ে আরও বেশি দূর না এগোয়। এ ব্যাপারে ফরহাদ মজহারকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। পুলিশ প্রধান আরও বলেছেন, ফরহাদ মজহার স্বেচ্ছায় ঢাকায় ফিরেছেন। ঘটনার দিন বিকেল প্রায় সাড়ে চারটার পর থেকে প্রায় সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ফরহাদ মজহার খুলনা নিউমার্কেটে ছিলেন। ফরহাদ মজহারের মোবাইল ফোনে দুটি সিম ছিল। একটি সিম দিয়ে স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। আরেকটি সিম দিয়ে তিনি অন্য এক নারীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ঘটনার দিন মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় তিনি তার স্ত্রীকে তার অপহরণ নিয়ে ফেসবুকে প্রকাশিত স্ট্যাটাস বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন। ফরহাদ মজহার স্ত্রীকে বলেন, অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিবে। চিন্তার কিছু নেই। প্রসঙ্গত, গত ৩ জুলাই ভোর ৫টার দিকে রাজধানীর আদাবর থানাধীন রিং রোডের হক গার্ডেনের নিজ বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। এরপর তিনি অপহৃত হন বলে পরবর্তীতে উদ্ধারের পর ফরহাদ মজহার আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে দাবি করেন। তার দাবি, একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে তাকে অপহরণ করা হয়। এ ব্যাপারে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে অপহরণ মামলাও করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় তাকে যশোরের নওয়াপাড়া থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। ৪ জুলাই ঢাকা আনার পর তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। তিনি বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। জবানবন্দীতে ফরহাদ মজহারের দাবি, অপহরণকারীদের তিনি নিজেই টাকা লোভ দেখিয়েছিলেন। প্রথমে দুই কোটি, শেষ পর্যন্ত ৩৫ লাখ টাকায় তাকে মুক্তি দেয়ার চুক্তি হয়। অবশ্য ওইদিনই সন্ধ্যা সাতটার দিকে অপহরণকারীরা তাকে কোন প্রকার টাকা না নিয়েই ছেড়ে দেয়। অপহরণের পর আমি অনেক বার স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছি। বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ফরহাদ মজহার বলেছেন, তিনি অপহৃত হয়েছিলেন। তার সঙ্গে যা ঘটেছে তা তিনি প্রকাশ করতে ভীত নন। সহসাই তিনি সব প্রকাশ করবেন। অপহরণের দিন সকালে তিনি চোখের ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। ওই সময়ই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। অপহরণকারীরা তার চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়েছিল। তারপরও তিনি স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন মোবাইল ফোনে। এদিকে অপহরণ ঘটনার নেপথ্যে থাকা অর্চনা রানী নামের এক নারী ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের আদালতে ১৬৪ ধারায় ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তাদের কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেছেন, তাকে ‘দীক্ষা’ দেন ফরহাদ মজহার। তিনি ‘ফকির ও বৈষ্ণব আদর্শে দীক্ষা দেন তাকে। ফরহাদ মজহারের কাছে দীক্ষা নেয়ার পর ‘সেবাদাসী’ হিসাবে আত্মনিয়োগ করেন এই নারী। ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনিগ এ চাকরি পাওয়ার পর টাঙ্গাইলে পনেরো দিনের ট্রেনিং নিয়ে কক্সবাজার ব্রাঞ্চে যোগদান করি। কক্সবাজার উবিনিগ এ চাকরি করাকালীন ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ফরহাদ মজহারের ভক্ত হই। তার নিকট থেকে দীক্ষা নেই। তারপর তাকে গুরু বাবা বলে ডাকতাম। তিনি আমাকে ফকির ও বৈষ্ণব আদর্শে অনুপ্রাণীত করেন। আমি তার সেবাদাসী হিসেবে আত্মনিয়োগ করি। এরপর আমি ঈশ্বরদীতে বদলি হয়ে যাই। ঈশ্বরদীতে থাকাকালীন গুরু বাবার সঙ্গে আমার দৈহিক সম্পর্ক হয়। মাসে দু-এক বার তিনি ঈশ্বরদীতে আসতেন। ঈশ্বরদীতে এলে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হতো। এরপর আমি টাঙ্গাইল বদলি হই। বদলি হওয়ার পর আমি টাঙ্গাইল চলে আসি। জবানবন্দীতে অর্চনা আরও বলেছেন, গুরু বাবা মাসে মাসে টাঙ্গাইল আসত। আমার সাথে টাঙ্গাইলে দৈহিক সম্পর্ক হতো। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আকতার আমার গুরু বাবার সঙ্গে সম্পর্ক বুঝতে পারে। আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আমার মোবাইল যোগাযোগ হতো। এরপর বর্তমান বাসায় গুরু বাবা মাঝে মাঝে আসত। আমার বর্তমান পশ্চিম নূরের চালার বাসায় খাওয়া দাওয়াসহ দৈহিক মেলা মেশা করত। গুরু বাবা মাঝে মাঝে আমার প্রয়োজন মোতাবেক ১০/১২ হাজার করে টাকা দিত। অসুখ বিশুখ হলে বেশি টাকা দিত। প্রায় দুই বছর আগে আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। গুরু বাবার পরামর্শ মতো আমি মালিবাগের একটি ক্লিনিকে গোপনে গর্ভপাত ঘটাই। সমস্ত টাকা আমার গুরু বাবা ফরহাদ মজহার পরিশোধ করেছিল। আমি সুস্থ হওয়ার পর মাঝে মাঝে গুরু বাবার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক হতো। আমি ভাটারা এলাকায় টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার সরবরাহ করেও টাকা আয় করতাম। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল আমি আবার গর্ভবতী হয়ে পড়লে গুরু বাবার কাছে টাকা চাই। গুরু বাবার কাছে টাকা না থাকায় তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। গত ৩ জুলাই সকাল ৬টা ২০ মিনিটের দিকে গুরু বাবা ফোন করে আমাকে জানায় তোমার টাকা সংগ্রহের জন্য বের হয়েছি। চিন্তা করো না। ওইদিনই বেলা এগারোটার দিকে আমি গুরু বাবাকে মোবাইল ফোনে জিজ্ঞাসা করি আপনি অপহৃত হয়েছেন কিনা? তিনি আমাকে ফোনে বলে কোন সমস্যা নাই। আমি ভাল আছি। ওইদিনই সন্ধ্যা সাতটার দিকে গুরু বাবা আমাকে মোবাইল করে। একটি এ্যাকাউন্ট নাম্বার চায়। কিছু টাকা পাঠাতে চান বলে জানান। আমি তাকে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট নাম্বার পাঠাই। আমাকে দুটি নাম্বার থেকে পনেরো হাজার টাকা পাঠায়। আমি টাকা পেয়েছি কিনা গুরু বাবা তা জানতে চান। ঘটনার আগের দিন গত ২ জুলাই গুরু বাবা ৫ থেকে ৬ বার আমাকে ফোন করে। আমি ২ থেকে ৩ বার ফোন করি। আমি গত ৪ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় আমার আত্মীয় রবি সমাদ্দারের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যাই। গত ৯ জুলাই ডিবি পুলিশ আমাকে রাঙ্গুনিয়া থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
×