ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেঘ-বৃষ্টির খেলায় রোমান্টিকতা

ভিন্নরূপে বর্ষা, মেঘের নাচনে কত যে ব্যঞ্জনা...!

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৮ জুলাই ২০১৭

ভিন্নরূপে বর্ষা, মেঘের নাচনে কত যে ব্যঞ্জনা...!

সমুদ্র হক ॥ এই মেঘ, এই বৃষ্টি। কখনও ঝিরিঝিরি। কখনও মুষলধারায়। কিছুক্ষণের বিরতি। ফের শুরু। মেঘ-বৃষ্টির খেলা। এবারের বর্ষায় ভিন্নরূপ। কোথাও নদী ফুলে ফেঁপে উঠছে। কোথাও উজানী ঢল গড়িয়ে নামছে ভাটির দিকে। বৃষ্টির ক্লাসিক্যাল ছন্দ। চোখে পড়ছে, মনেও ধরেছে। ঋতুর নিসর্গ বর্ষা। আষাঢ়ের মেঘ জানিয়ে দিচ্ছে বর্ষার এই রেশ টেনে নেবে সঙ্গী শ্রাবণ। নদীতীরে মেঘ মাদলের পাল তুলে এসেছে বর্ষার তরী। এনে দিয়েছে রোমান্টিকতা। আকাশে সূর্যালোকের অল্পবিস্তর বিচ্ছুরণে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভেসে ওঠে রংধনু (কেউ বলে রামধনু)। মেঘের নাচনে বর্ষার যে কত ব্যঞ্জনা....! বসন্তকে বলা হয় ঋতুর রানী (বা রাজা)। বসন্তের রোমান্টিকতার ধরন থেকে বর্ষা আলাদা। বৃষ্টিতে মানব হৃদয়ের ভাবাবেগ অতি দ্রুত ছুটে ব্যাকুল করে দেয়। বর্ষার নূপুর নিক্বণের/রিমিঝিম সুরে রোমান্টিক হৃদয়ে মান্না দের কণ্ঠের সুর ওঠে ‘ওগো বরষা তুমি ঝরো না গো অমন জোরে/পাছে সে আসবে তবে কেমন করে/এলে না হয় ঝরো তখন অঝর ধারে/যাতে সে যেতে চেয়েও যেতে নাহি পারে...’। এমন সুরে দূরে ও কাছে মুখোমুখি বসে থাকে দুইজনা। অনুভবে কাছে পায়। হৃদয় দিয়েই হৃদয়ের কাছে চলে যাওয়া। মনের ভাষায় অব্যক্ত কথাগুলোও বলা হয়। বর্ষায় মানুষ ও প্রকৃতির এমনএই এক মধুময়তায়। কত কথা বর্ষাকে নিয়ে। হলুদ বরণ ব্যান্ড গায়ক দল হেড়ে গলায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর সুর তোলে। মন্দ লাগে না। পুরাণের কথা: কালো মেঘ দেখে কৃষ্ণকে মনে পড়ে যায় রাধার। নীপ বনে ছুটে যায়। কবিগুরু লিখেছেন ‘এসো নীপবনে ছায়া বিথী তলে এসো করো স্নান নবধারা জলে...’। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করার এবং ভাবের যে ব্যকুলতা তুলে এনেছেন অন্য কেউ তা পারেনি। তিনি লিখেছেন ‘ওই আসে অতি ভৈরব হরষে/জল সিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে/ঘর গৌরবে নব যৌবনা বরষা/শ্যামগম্ভীর সরসা। গর্জনে নীল অরণ্য শিহরে, উতলা কলাপী কেকা কলরবে বিহরে-নিখিলচিত্তহরষা/ঘন গৌরবে আসিছে মত্ত বরষা।’ মেঘ ও বৃষ্টি উতল ধারার বাদল বরিষণ মানব জীবনে এক বিপুল বিস্ময় ও আনন্দ বেদনার ভুবনে পৌঁছে দেয়। এমনই ধারায় কবিগুরু কবিতায় জানান দেন ‘আজি ঝরের রাতে তোমার অভিসার/পরান সখা বন্ধু হে আমার। আকাশ কাঁদে হতাশসম, নাই যে ঘুম নয়নে মম-দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বারে’। বর্ষার বারিধারা রাতে প্রণয়ের মানবীকে হৃদয় মাঝে পাওয়া যায়। আকাশজুড়ে ভেসে আসে নানা বর্নের মেঘ। মেঘমেদুর, মেঘপুস্প, জলদ, মেঘাগম, মেঘবহ্নি, মেঘযামিনী, জলধর মেঘগুলোই বেশি ভাসে। জলেভেজা কেতকি (কেয়া) দূর থেকে সুবাস এনে দেয়। গ্রামের ঝাউবনে, বাঁশবাগানে, নদীতীরে চর এলাকায় বর্ষায় বেশি ফোটে নাম না জানা কত বনফুল। যা দৃষ্টিতে এসে মন রাঙ্গিয়ে দেয়। বর্ষার ধারায় এই ফুলগুলো নেচে ওঠে। প্রকৃতি নিয়ে যত গান রচিত হয়েছে তার মধ্যে বরষা এগিয়ে। উপমহাদেশের বড় শিল্পীরা বর্ষাকেই আবেগের সুরে টেনে এনেছেন বেশি। হেমন্তের কণ্ঠে ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কাছে যাব কবে পাব ওগো তোমার নিমন্ত্রণ..’। সতীনাথের কণ্ঠে ‘এলা বরষা যে সহসা মনে তাই রিমঝিমঝিম গান গেয়ে যাই...’। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরেছে তোমাকে আমার মনে পড়েছে..’। সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে ‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয় সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়..’। বর্ষার গানে আছে মানব মানবীর হৃদয়ের আকুলতা। বর্ষা এভাবেই মানুষকে কাছে টেনে আনে। বর্ষার কাব্য ধারায় মহাজন কবি বিদ্যাপতি গোবিন্দ দাস, চ-ী দাস মেঘ বৃষ্টির অনুষঙ্গে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ব্যাকুলতাকে মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ আরও এগিয়ে গিয়ে মেঘকে ছুঁয়েছেন অন্তরঙ্গ রঙে। বর্ষায় নদনদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। কখনও রূদ্ররূপ ধারণ করে। নদীতীরের মানুষ জেগে ওঠে নিজেদের রক্ষায়। ভালবাসার বন্ধনে একাকার হয়ে যায় মানুষ। মাঝিরা নৌকায় জাল নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে চলে যায় নদীতে। বর্ষার এমন ধারার মধ্যে মানুষ খুঁজে নেয় জীবনের অর্থ। এমন জীবনেই মানুষের পথ চলা...।
×