ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

গাজীপুরে বয়লার বিস্ফোরণ

নিহত তিন শ্রমিকের নামে হত্যা মামলা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৬ জুলাই ২০১৭

নিহত তিন শ্রমিকের নামে হত্যা মামলা

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর ॥ গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস পোশাক কারখানায় ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে জয়দেবপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় নিহত তিন কর্মীর নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৮-১০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদিকে নিখোঁজের তালিকায় কোন ব্যক্তি না থাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস। বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত সবার লাশ ইতোমধ্যে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছে। অপরদিকে ঘটনার তদন্তে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বুধবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আক্তারুজ্জামান লিটন ও স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকাস্থিত মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড পোশাক কারখানায় সোমবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে বয়লারের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানার একটি চারতলা ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয়তলার দুই পাশের দেয়াল, দরজা-জানালা ও মেশিনপত্র উড়ে যায় এবং দুমড়ে-মুচড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও ভেঙ্গে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে এবং বিস্ফোরিত বয়লারের টুকরোর আঘাতে কর্মকর্তাসহ এ পর্যন্ত ১৩ জন মারা গেছে এবং প্রায় অর্ধশত আহত হয়েছে। হতাহতদের সন্ধানে ঘটনার পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে ‘রেস্কিউ অপারেশন’ (উদ্ধার অভিযান) শুরু করে। ঘটনার রাতে কারখানার ভেতরের ধ্বংস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় ছয়জনের লাশ আহত ৪৭ জনকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে আহতদের মধ্যে হাসপাতালে আরও তিনজন মারা যায়। ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার সকালে ধ্বংসস্তূপ থেকে ক্ষতবিক্ষত আরও একজনের বিকৃত লাশ এবং বিকেলে আরও ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করে উদ্ধারকর্মীরা। নিহতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকায় মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড পোশাক কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে জয়দেবপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। জয়দেবপুর থানার ওসি মোঃ আমিনুল ইসলাম জানান, চক্রবর্তী পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আবদুর রশীদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে কারখানার তিন কর্মীর নামোল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৮-১০ জনকে আসামি করে ওই মামলা করেছেন। মামলার নামীয় আসামিরা হলেনÑ কারখানার বয়লার অপারেটর চট্টগ্রামের মীরের সরাই থানার বামন সুন্দর গ্রামের মোরশেদ আহমেদের ছেলে আবদুস সালাম (৪৮), বোচাগঞ্জ থানার মনিপুর গ্রামের মৃত মোস্তফা চৌধুরীর ছেলে এরশাদ হোসেন (৩৭) ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার গোলাকান্দাইল গ্রামের লুৎফল হকের ছেলে মনসুরুল হক (৪১)। তদন্তের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তারা নিহত হলেও দোষী হলে কিংবা দায়ী না হলে অভিযোগপত্রে তাদের দায়মুক্তি দেয়া হবে। মামলার বিবরণে বলা হয়েছে, গত ২৫ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত কারখানাটি নয়দিনের ছুটি ছিল। কারখানা ছুটি হওয়ার আগে গত ২৪ জুন বয়লারটির মেয়াদ শেষ হওয়ায় নবায়নের জন্য ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বয়লার অধিদফতরে আবেদন করেন কারখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ৪ জুলাই কারখানা খোলার কথা থাকলেও তার আগের দিন ডাইং সেকশনের অধিকাংশ শ্রমিক কর্মস্থলে যোগ দেন। বয়লার অধিদফতরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগেই কারখানা ছুটি থাকাবস্থায় বয়লার অপারেটর আবদুস সালাম, এরশাদ হোসেন ও মনসুরুল হক কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে বা অনুমতি না নিয়ে ৩ জুলাই সন্ধ্যায় বয়লারটি চালু করে। বয়লারটি চালুর কিছুক্ষণের মধ্যেই তা বিস্ফোরিত হয়ে ভবনের একাংশ ধসে পড়ে ও মেশিনপত্র দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এতে ১৩ নিহত এবং ৪০ জন আহত হন। এ ব্যাপারে গাজীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডাঃ মোঃ মামুন শিবলী ও গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম গোলাম মোরশেদ খান জানান, মামলায় উল্লেখকৃত নাম তিনটি তাদের তৈরি করা মৃতদের তালিকায় রয়েছে। মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই তাদের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদানের টাকা ও লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার বাদী এএসআই আবদুর রশীদ জানান, মৃতদের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন, কিন্তু মৃতদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই হারুন-অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বিশেষজ্ঞসহ তদন্ত টিম বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ রাহেনুল ইসলাম জানান, তদন্ত কাজ এগিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি একাধিকবার বৈঠক করেছে। আগামী রবিবার আরও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। নিহতদের পরিবারকে বিশ হাজার টাকা সহায়তা গাজীপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম গোলাম মোরশেদ খান জানান, গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের দাফন কাফন ও লাশ বহনের জন্য প্রত্যেকের পরিবারকে বিশ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ১৩ জনের সবার লাশ ঘটনার পর থেকে মঙ্গলবার রাতের মধ্যে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের পরিবার ৮ লাখ টাকা করে পাবেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, মাল্টিফ্যাবস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবার ৮ লাখ টাকা করে পাবেন। এ ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে বীমার খাত থেকে ২ লাখ এবং শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান বাবদ আরও ৩ লাখ টাকা করে দেয়া হবে। এছাড়াও এ ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে কারখানার পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকা করে দেয়া হবে এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে বলে কারখানার চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন ফারুক ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। কারখানা বন্ধ মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় মঙ্গলবার থেকে কারখানাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও একই ঘটনায় ওই এলাকার ম-ল গ্রুপের মনটেক্স, কটন ক্লাব বিডি লিঃ, কটন ক্লাউড বিডি লিঃ, আলিম নিট বিডি লিঃ, মাস্কো গ্রুপের তাসনিয়া ফেব্রিক্সসহ প্রায় সবকটি কারখানা মঙ্গলবার একদিনের জন্য বন্ধ রাখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তিতাস গ্যাসের বক্তব্য গত ৩ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায় মেসার্স মাল্টিফ্যাবস্ লি., নয়াপাড়া, কাশিমপুর, গাজীপুরে বয়লার বিস্ফোরণ ঘটে। দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে এ কোম্পাানির সংশ্লিষ্ট জোনের জরুরী গ্যাস নিয়ন্ত্রণ দল রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে কারখানার গ্যাস মিটারিং এ্যান্ড রেগুলেটিং স্টেশন এবং গ্যাস সরবরাহ লাইনের ভাল্্ভ বন্ধ করে গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে নিরাপত্তার জন্য বন্ধ করে। ওই রাতেই তিতাসের কোম্পানির সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। দুর্ঘটনায় গ্যাসের কোন সংশ্লিষ্টতা/আলামত পরিলক্ষিত হয়নি বলে তিতাসের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়।
×