ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মামলা ডিবিতে হস্তান্তর

ফরহাদ মজহার অপহরণে লাভবান কারা?

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৬ জুলাই ২০১৭

ফরহাদ মজহার অপহরণে লাভবান কারা?

শংকর কুমার দে ॥ হঠাৎ করেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের ‘অপহরণ’ ঘটনা ঘটনার পেছনে কোন মহলের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে তদন্তকারীরা। রাজধানীর আদাবর থানার ফরহাদ মজহার অপহরণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার তদন্ত করতে নির্দেশ পেয়েছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। দেশের শন্তিপূর্ণ রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কে বা কারা অপহরণের নাটক সাজিয়েছে তা খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তদন্তকারীদের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে নানামুখী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ ধরনের আরও অনেক অঘটন ঘটানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এ জন্য বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের মধ্যকার উগ্রপন্থী গ্রুপগুলোর মদতে দেশী-বিদেশী অশুভ গোষ্ঠী জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের ওপর সতর্ক নজরদারি শুরু করা হচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উচ্চপর্যায় থেকে কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারকে অপহরণে কে বা কারা জড়িত, মোটিভ কি তা দ্রুততার সঙ্গে উদ্ঘাটন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া মঙ্গলবারই আদাবর থানা থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, ফরহাদ মজহারকে অপহরণের অভিযোগে হওয়া মামলাটি মঙ্গলবার ডিএমপির কমিশনার ডিবির কাছে হস্তান্তরের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে আদেশ দেয়ার পর আজ বুধবারই ডিবির কর্মকর্তারা মামলার ডকেট, নথিপত্র, গ্রহণপূর্বক তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ডানপন্থী অধিকার কর্মী হিসেবে পরিচিত কবি প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন সংবাদমাধ্যমে এমন অসংখ্য প্রবন্ধ ও বক্তব্য প্রদান করায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তাকে দুর্বৃত্ত চক্রটি অপহরণের জন্য বেছে নেয় বলে মনে হচ্ছে। ফরহাদ মজহার মঙ্গলবার আদালতে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়ার সময়ে ও আদালতে শুনানিতে তার আইনজীবী হিসেবে ছিলেন বিএনপিপন্থী বলে পরিচিত বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মামলার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া। আদালতে শত শত আইনজীবী থাকতে ফরহাদ মজহারের জন্য বেগম জিয়ার আইনজীবীকে বেছে নেয়া হলো কেন সেই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজছেন তদন্তকারীরা। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ষড়যন্ত্রের ছক কষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একের পর এক যে ঘটনা ঘটানো হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনা কি না, তা তদন্তের সামনে আসছে। বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমায় আগুনে পুড়িয়ে মারার সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকা- থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল গঠনে বাধা প্রদান, রায় ঘোষণার বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান, জঙ্গী গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে মুুক্তমনা লেখক, ব্লগার, প্রগতিশীল নাগরিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে নামানো হয়েছে দুর্বৃত্ত চক্রকে। রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় ইতালীয় নাগরিক খুন, খুনের ঘটনায় আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দায় স্বীকার, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ, পদ্ম সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ, রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলাসহ অসংখ্য ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতায় ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনা সাজাতে পর্দার অন্তরাল থেকে কোন মহল থেকে কলকাঠি নাড়ছে কি না, সেই প্রশ্ন করেছেন খোদ ফরহাদ মজহারও। মঙ্গলবার ঢাকার আদালতে ফরহাদ মজহার নিজেই ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে বলেছেন, আমাকে কারা অপহরণ করেছে তাদের আমি চিনতে পারিনি, তবে তাদের কথাবার্তায় বুঝতে পারি এই সরকারকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করতে চায় এমন একটি গোষ্ঠী আমাকে অপহরণ করেছিল। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের মতো অতীতেও অনেক রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ বা অপহরণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এসব ঘটনার পর সরকারের প্রতিপক্ষরা সাদা পোশাকে র‌্যাব, ডিবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর দোষ চাপিয়েছে। কিন্তু কোন অভিযোগই উপযুক্ত প্রমাণনির্ভর ছিল না, অনুমাননির্ভর ভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দোষ চাপিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হয়। অপহরণের পর যারা ফিরে এসেছে তারা বলেছেন, কোন কথা মনে করতে পারেন না। কবি ফরহাদ মজহার ১৮ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগকে বলেছেন, শ্যামলীতে তার বাসার সামনে থেকে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। এরপর আর কিছু তিনি জানেন না। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে শুধু ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনাই নয়, এর আগেও এই ধরনের নিখোঁজের ঘটনাকে অপহরণের ঘটনা বলা হলেও নিখোঁজ বা অপহৃত ব্যক্তি ফিরে এসেছেন। গোয়েন্দা নথিতে উল্লেখ আছে, ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন। প্রায় ৩৪ ঘণ্টা পর তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় কে বা কারা মিরপুরে নামিয়ে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। তার পকেটে ৩০০ টাকাও গুজে দেয় দুর্বৃত্ত চক্র। চোখের বাঁধন খুলে প্রথমে রিক্সায় করে মিরপুর ১০ নম্বরে, পরে সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় করে ধানম-িতে যান তিনি। স্বামী আবু বকর সিদ্দিক অপহরণের ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা করেন তার স্ত্রী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ২০১৫ দিবাগত রাত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাড়ে তিনটার দিকে বনানীতে তাদের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে সাদা পোশাকে থাকা পুলিশ তুলে নিয়ে যায় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। প্রায় ২১ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর তাকে ধানম-ির স্টার কাবাবের সামনে থেকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১৫ সালে ১০ মার্চ উত্তরার একটি বাসা থেকে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ। প্রায় ৬২ দিন পর ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে উদ্ধার হন তিনি। এরপর ওই বছরের ১২ মে তিনি মেঘালয় ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ এ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতাল থেকে তার স্ত্রী হাসিনা খানকে ফোন করেন। ভারতীয় পুলিশের বরাতে বলা হয়, মেঘালয়ের গলফ গ্রিন এলাকায় ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাকে আটক করে। সে সময় তাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছিল। ২০১৬ সালের ১৬ মার্চ দিবাগত রাতে তিনি নিখোঁজ হন তানভীর আহমেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাতকার দেন তিনি। পাঁচদিন পর তাকে উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় বিমানবন্দর সড়কে হাঁটতে দেখে পুলিশ বাড়ি পৌঁছে দেয়। গত বছরের ১৫ অক্টোবর নিখোঁজ হন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদসহ অনেকেই। তারা নিখোঁজ হওয়ার পর অভিযোগ করা হয়েছিল যে, সাদা পোশাকে র‌্যাব, ডিবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের অপহরণ করেছে। তারা সবাই পরে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর আর তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর আর দোষ তো চাপানো হয়নি, বরং তাদের উদ্ধারের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রশংসা করেছেন তারা ও তাদের পরিবারবর্গ। ফরহাদ মজহারও ফিরে আসার পর তার স্ত্রী ফরিদা আখতার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘স্বামীকে ফিরে পেয়েছি। এতেই খুশি।’ ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছেন, পুলিশ যুক্তিসঙ্গত কারণে কাউকে গ্রেফতার করলে আইন অনুযায়ী আদালতে উপস্থাপন করে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে। এ ছাড়া কেউ যদি কখনও অপহরণের অভিযোগ নিয়ে আসেন, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হয়, অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। অতীতে অনেক নিখোঁজ ও অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা প্রশংসিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, গত সোমবার ভোর পাঁচটার দিকে শ্যামলীর হক গার্ডেনের বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগর এলাকায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। তাকে উদ্ধারের পর পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক দিদার আহম্মেদ বলেছিলেন, এটা ‘অপহরণের নাটক’ বলে মনে হয়েছে। উদ্ধারের পর তাকে রাজধানীর আদাবর থানায় আনা হয়। আদাবর থানা থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) অফিসে। সেখান থেকে আদালতে পাঠানোর পর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন তিনি। জবানবন্দী দেয়ার পর তাকে জিম্মায় বাড়িতে পাঠানো হয়। বাড়িতে পাঠানোর পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনাটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। ফরহাদ মজহার খুন, গুম, মুক্তিপণ আদায়, ভারতে পাচার হওয়ার সম্ভাবনা দিকগুলোকে সামনে রেখে কারা কি কারণে এই অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে, এর পেছনে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কারণ ছিল কি না, সবকিছুই খতিয়ে দেখা হবে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।
×