ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়ন নেই ॥ বিশ লাখ গৃহকর্মী অব্যাহত নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ জুলাই ২০১৭

গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা বাস্তবায়ন নেই ॥ বিশ লাখ গৃহকর্মী অব্যাহত নির্যাতনের শিকার

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১৫’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় একের পর এক গৃহকর্মী হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ২ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় সাবিনা আক্তার (১১) নামের এক শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়। টাঙ্গাইলের এই মেয়েটি ছয় মাস ধরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার এক সেনা কর্মকর্তার ডিওএইচএসের বাসায় কাজ করছিল। গৃহকর্ত্রী প্রায়ই সাবিনাকে মারধর করতেন। গত রবিবার মারধরের একপর্যায়ে তাকে বাসা থেকে বের করে দেন তিনি। মেয়েটির শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শারীরিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় সাবিনাকে ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। ২৯ মার্চ মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি বাড়িতে ঐশী নামের এগারো বছরের এক শিশু গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গৃহকর্তা বলেন, ঐশী ছাদে কাপড় আনতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে মারা গেছে। এ ঘটনায় পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়াধীন। রাজধানী মোহাম্মদপুরের এক বাড়িতে পাবনার মতিগাছা থানার আটঘড়িয়ার ৮ বছরের শিশু রহিমা কাজ করত। একটি প্লেট ভাঙ্গার অপরাধে গত বছরের ১৪ মার্চ বাড়ির গৃহকর্তী নিলুফার ইয়াসমিন ছোট্ট রহিমাকে গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়। এভাবে একের পর এক গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে রহিমার সারা শরীরের দগদগে ঘা করে দেয় গৃহকর্ত্রী। রহিমার চিৎকারে, পাশের বাড়ির একজন মহিলা এসে তাকে উদ্ধার করে এবং পরবর্তীতে সে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যায়। সাবিনা, ঐশী ও রহিমার মতো দেশে রয়েছে প্রায় ২০ লাখ গৃহকর্মী। এদের ৮০ ভাগই মেয়ে শিশু। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের এক জরিপে এ তথ্য জানা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর-২০১৪ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী গৃহকর্মে নিয়োজিত এক লাখ ২৫ হাজার শিশুকর্মীর বয়স পাঁচ থেকে সতের বছরের মধ্যে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ মেয়ে শিশু। আর ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী দেশে ১৫ বছর বয়সের ওপরের প্রায় ৯ লাখ শিশু গৃহকর্মী রয়েছে। এদের আবার ৮৩ শতাংশ মেয়ে শিশু। যাদের বয়স ১৮-এর নিচে। এই বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মীর সার্বিক কল্যাণ ও গৃহকর্মকে ‘শ্রম’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর ‘গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১৫’-এর খসড়া অনুমোদন করা হয়। এই নীতিমালায় গৃহপরিচারিকাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বর্তমানে গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকদের ওপর শারীরিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়নসহ বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখজনকভাবে বেড়ে গেছে। শুধু শারীরিক নির্যাতনই নয়, থাকা-খাওয়ার বেলায়ও এদের ওপর অমানবিক আচরণ করা হয়। সম্প্রতি একের পর এক গৃহকর্মী হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ‘গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক’-এর সমন্বয়কারী সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার ঘোষিত ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশে একের পর এক গৃহশ্রমিক হত্যা এবং তাদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। তিনি বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলার আসামিদের সাজা হয় না। আদালতে মামলাগুলো অধিকাংশই চূড়ান্ত রায় পায় না। অধিকাংশ ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। দারিদ্র্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মামলার বাদীরা অভিযুক্তদের সঙ্গে রফা করে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন। আর এ জন্যই দোষীরা কঠিনতম শাস্তি পাচ্ছে না। এছাড়া দারিদ্র্যের কারণে শিশুকে যেখানে সেখানে কাজে লাগিয়ে দেয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদের। ২০১৫ সালে সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি গ্রহণ করে সরকার। এতে গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এই নীতিমালায় তাদের মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন দেয়া, চাকরি থেকে অপসারণের অন্তত এক মাস আগে জানানো, কোন কারণে জানাতে না পারলে ৩০ দিনের বেতন প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী পাশাপাশি ১২ বছরের নিচে কাউকে চাকরি দিলে তৃতীয় পক্ষের অনুমতি নিতে হবে। পরিশ্রমের পাশাপাশি বিনোদনের জন্য সময় দেয়ার কথাও বলা আছে নীতিমালায়। মাতৃত্বকালীন ছুটি হিসেবে চার মাসের বেতনসহ ছুটি দেয়ার কথাও আছে এতে। কোন কারণে গৃহকর্মী অসুস্থ হলে তার সুস্থতার জন্য সম্পূর্ণ খরচের ব্যয়ভার বহন করবে নিয়োগকর্তা। কিন্তু এই নীতিমালাটি আইনে পরিণত করা যায়নি এখনও। সম্প্রতি মহিলা ও শিশু অধিদফতর কর্তৃক গৃহশ্রমিক নির্যাতন রোধে ফোন নম্বরের মাধ্যমে জরুরী সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ন্যাশনাল টোল ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ ডায়াল করলেই তাৎক্ষণিকভাবে সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তবে সচেতনতা না থাকায় এই নম্বরে তেমন ফোন আসে না বলে জানান অধিদফতরের কর্মকর্তারা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও গৃহকর্মীর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনকে দিন ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, সমাজের নেতিবাচক মানসিকতা গৃহকর্মীর ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা আনুষ্ঠানিক নিয়মের মধ্য দিয়ে তাদের কাজে নিয়োগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘গৃহকর্মী হত্যায় মামলা হলেও তা টাকার বিনিময়ে আপোস হয়ে যায়। এ কারণে অপরাধীরা ভীত নন।’
×