ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরায় সি-শেল হোটেলে অগ্নিকাণ্ড, দু’জন নিহত

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৪ জুলাই ২০১৭

উত্তরায় সি-শেল হোটেলে অগ্নিকাণ্ড, দু’জন নিহত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের সি-শেল আবাসিক হোটেলে এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে দুইজন নিহত ও ৭ জন আহত হয়েছে। আগুন লাগার ৪ ঘণ্টার মধ্যে দগ্ধ দুজনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ দগ্ধ লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে- তারা হোটেল কর্মী ছিলেন। এর ভেতরে রাসেল নামের এক যুবক ও অপরজন একই বয়সের একজন নারী। হোটেলটির ৩০২ নম্বর কক্ষ থেকে দগ্ধ দেহদুটি উদ্ধার করা হয়। তাদের অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। নিহতের একজন রাসেল মিয়া (৩৫)। তার বাবার নাম নূর মোহাম্মদ। চাঁদপুর হাইমচর থানা এলাকায় তার বাড়ি। তিনি পল্লবী ১২ নং সেকশনের রোড ২৩, ব্লক-ডি এর ৪৮ নং বাসায় থাকতেন। নিহত অপর নারীর পরিচয় জানা যায়নি। তবে তিনি নিহত রাসেলের স্ত্রী বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া একই রুমে তাদের কাটানোর কোন সুযোগ নেই বলে দাবি করছেন হোটেল মালিক কর্তৃপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার ভোর ৫টার দিকে সি-শেল হোটেলে আগুন লাগে। পরে তা পাশাপাশি তিনটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। সকাল থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট। আবাসিক সি-শেল হোটেল যে ভবনটিতে সেটার মালিক ইসমিয়ারা হানিফ বলেন, আমি ভোর ৫টার দিকে খবর পেয়ে চলে আসি। এসে দেখি আগুন জ্বলছে। এরপর থানা ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেই। সাড়ে ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিস আসে। তৎক্ষণে আগুনে মাঝখানের সি-শেল ভবন পুড়ে আমাদেরটিতে লাগছে। এরপর ফায়ার সার্ভিস চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আড়াই ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা এ মুহূর্তে বলতে পারব না। আগুন নেভানোর সব ব্যবস্থা আমাদের ভবনে ছিল। তবে সেগুলো কেউ ব্যবহার করেনি। ঘটনার পর পরই এ প্রতিনিধি সেখানে হাজির হয়ে দেখতে পান, আগুন লাগার পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে, কিভাবে আগুন লেগেছে সে সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকা-ের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে দমকল বাহিনী। দমকল বাহিনীর সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার ভোর সোয়া ৫টার থেকে শুরু করে দুপুর ২টা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ আনা হয়। প্রথম দিকে ৫ ঘণ্টার ব্যবধানে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এতে ফায়ার সার্ভিসের ১৫ থেকে ১৬টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে একযোগে কাজ করে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। এলাকাবাসী জানায়, ভোরে সি-শেল রেস্তরাঁর ওই ভবন থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেন। পরে পাশের ভবনেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাতে রেস্তরাঁয় তাদের দু’জন কর্মী ছিল, তারা সামান্য আহত হয়েছেন। তবে ছয়তলা ভবনের সব ফ্লোরেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পাশের ভবনগুলো থেকে লোকজনকে নিরাপদে নামিয়ে এনেছে। সোমবার ভোর পৌনে ৫টার দিকে সি-শেল হোটেলে আগুন লাগে। পরে তা পাশাপাশি তিনটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। সকাল থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট। আগুনের খবর পেয়ে উত্তরার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসা শতশত মানুষ ঘটনাস্থলে এসে প্রচ- ভিড় জমায় ও জড়ো হন। এ সময় দমকল বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য আগুন নেভানোর কাজে সহায়তা করেন। ঘটনার পর সেখানে ছুটে যান স্থানীয় সাংসদ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ খবর নেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) শাকিল নেওয়াজ জানান, আগুন নেভানোর যে ব্যবস্থা থাকার কথা তা ওই ভবনগুলোতে ছিল না। সি-শেল রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টারের মার্কেটিং ম্যানেজার মোঃ সোহেল বলেন, আমরা ৫টার দিকে খবর পেয়েছি। এরপর এসে দেখি ভবন দাউ দাউ করে জ্বলছে। সি-শেলের মালিক আমানউাল্লাহ উত্তরা আওয়ামী লাীগের নেতা। তিনি বলেন, আমাদের ১৯ বছরের ব্যবসা, সব পুড়ে ছাই। আগুনে প্রায় একশ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হবে। কোন কিছু বাঁচানো যায়নি। সি-শেল রেস্তরাঁর মালিক আমানউল্লাহ আমান নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি পাশের ভবনের একটি অংশ ভাড়া নিয়ে আবাসিক হোটেল চালাচ্ছিলেন। ছয় তলা ওই ভবনের মালিক দক্ষিণখান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু হানিফ। আবু হানিফের স্ত্রী ইসমে আরা হানিফ বলেন, আমাদের চার তলা থেকে ছয় তলা ভাড়া দিয়েছি আমানুল্লাহ আমানের কাছে। তিনিই হোটেল চালাচ্ছিলেন। আমাদের ভবনে অগ্নি নির্বাপণের সব ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ভবনে আমাদের কোন কর্মচারী ছিল না। এ সম্পর্কে উত্তরা পূর্ব থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিক জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সি-শেল আবাসিক হোটেলে তলাশি চালিয়ে চতুর্থ তলার ৩০২ নম্বর কক্ষ থেকে দুইজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। নিহতদের মধ্যে একজনের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার পরিচয় তারা জানা যায়। মোঃ রাসেল মিয়া নামের ৩৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি ঢাকায় প্রাণ আরএফএল গ্রুপে কাজ করতেন। তিনি চাঁদপুরের হাইমচরের নূর মোহাম্মদের ছেলে; ঢাকায় থাকতেন পল্লবীর এক বাসায়। তার সঙ্গে একই কক্ষ থেকে আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তার পরিচয় পুলিশ জানতে পারেনি। ভেতরে আরও কেউ আছে কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস শাকিল নেওয়াজ বলেন, হোটেলের মালিক দাবি করেছিল, ভেতরে কেউ আটকা নাই। তারপরও দুইজনকে পাওয়া গেছে। হতাহত অন্য কাউকে এখন পর্যন্ত আমরা দেখিনি। ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা আসার পর সি-শেল রেস্তরাঁতেও কোন কর্মচারীকে দেখা যায়নি। কর্মচারীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেনি। পুলিশের কাছে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা আসে। তার আগেই তারা সবাই পালিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত তিন ভবনের মধ্যে মাঝখানের চার তলা ভবনের পুরোটা জুড়ে ছিল সি-শেল রেস্তরাঁ। ওই ভবনের পুরোটাই পুড়ে গেছে। তার উত্তরের ছয়তলা ভবনটির চতুর্থ তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত ছিল সি-শেল হোটেল এ্যান্ড রেসিডেন্স। আর তৃতীয় তলায় ছিল পার্টি সেন্টার। ভবনটি নিচতলায় রয়েছে একুশে সুইটস এ্যান্ড বেকারি এবং রহিম আফরোজের একটি আউটলেট আর দোতলায় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের কার্যালয়। আগুনে সি-শেল হোটেল ও পার্টি সেন্টার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দক্ষিণ দিকের এ কে টাওয়ারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘটনাস্থলেই এ কে টাওয়ারের ব্যবস্থাপক আলাউদ্দিন জানান, খবর পাওয়ার পরে তিনি এসে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আগুন নেভাতে দেখেন। কীভাবে আগুন লেগেছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নিকা-ের কারণ বা ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ জানাতে পারেননি। জানা যায়- ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর একটিতেও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। আগুন লাগার ঘণ্টাখানেক পর খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহও পাওয়া যায়নি। যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বেলা এগারটার দিকে মেজর শাকিল নেয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগুন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে পুরোপুরি আনতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। ভবনের ভেতর প্রচুর দাহ্য পদার্থ- প্লাস্টিক, ফোম, ফার্নিচার থাকায় আগুন দ্রত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভানোর জন্য ভবনের কোথাও কোন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। এজন্য আরও বেগ পেতে হয়। আগুন লাগার পরপর ভবনের নিরাপত্তারক্ষীরা পালিয়ে যায়। তারা প্রাথমিক অবস্থায় চেষ্টা করলে আগুন এতো বাড়ত না। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় সি-শেল রেস্তরাঁর ভবনের মালিক আমানুল্লাহ আমান জানান, ঘটনার সময় ১২-১৫ জন অতিথি ছিলেন। তারা ওই সময়ই হোটেল থেকে বেরিয়ে গেছেন। আগুন লাগার পর হোটেলের ভেতরে কেউ ছিল না। আগুনে কেউ পুড়েনি। তবে দুটি ভবনের সব পুড়ে গেছে। আবাসিক হোটেলটিতে ২৬টি রুম ছিল। কিন্তু ঠিক কিভাবে আগুনে দুজন মারা গেলেন, সে সম্পর্কে কোন তথ্য জানাতে পারেননি তিনি। ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন অগ্নিকা-ের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডেপুটি ডিরেক্টর দেবাশীষ বর্ধনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির বাকি ২ সদস্য হলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডিএডি মোঃ সালাহ উদ্দিন ও উত্তরা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার (ইনচার্জ) মোঃ শফিকুল ইসলাম। তদন্ত কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দিবেন। এদিকে খবর পেয়ে বেলা বারোটায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (এমপি)। এ সময় তিনি মেজর শাকিল নেওয়াজ এর সঙ্গে আগুন লাগার বিষয়ে কথা বলেন ও বিস্তারিত জানতে চান। পরিদর্শনকালে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলহাজ মোঃ হাবিব হাসান, সহসভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক এসএম মাহাবুব, উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা কুতুব উদ্দিন আহমেদ, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন মালিকের স্ত্রী ইসমিয়ারা হানিফ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (উত্তরা-১) নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলহাজ মোঃ আফসার উদ্দিন খানসহ দলীয় নেতাকর্মীরা সঙ্গে ছিলেন।
×