ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

গ্রাম উন্নয়নের কৌশলে সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৪ জুলাই ২০১৭

গ্রাম উন্নয়নের কৌশলে সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব

দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষিত স্বীকৃত মাধ্যম হচ্ছে সমবায়। বর্তমানে অর্থনীতির প্রায় সব শাখায় সমবায় তার কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ও ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে সমবায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে আর্থিক ও সেবা খাতে নতুন কার্যক্রম গ্রহণ, বিদ্যমান কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়ন ও সময়োপযোগীকরণের মাধ্যমে সমবায় অধিদফতর বেশ কিছু মৌলিক লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে পারে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনয়ন, প্রশিক্ষণ ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষত নারী উন্নয়নে সমবায় নিকট ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। সমবায় মূলত সঞ্চয়, পুঁজি গঠন, বিনিয়োগ, লভ্যাংশ বিতরণ ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি খাতের পাশাপাশি সমবায় খাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ১৯০৪ সালে পল্লী এলাকার উন্নয়নের কৌশল হিসেবে বাংলাদেশে সমবায় কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতাত্তোর সত্তরের দশকে এ দেশের কৃষকদের সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করে উন্নত বীজ, সার ও সেচ সুবিধা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ সময়ে কৃষি ও কৃষিজাত শিল্পায়নে সমবায়ের উপরোক্ত ধারা চলমান থাকে। যা আশির দশকে সবুজ বিপ্লব অর্জনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করে। নব্বইয়ের দশকে দেশে সংস্কার কর্মসূচী চালু হলে সরকারের বেসরকারীকরণ ও উদারীকরণ নীতির আওতায় সমবায়ের জন্য নতুন ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় আজ গড়ে উঠেছে হাজার হাজার নতুন শ্রেণীর সমবায় সমিতি। এ সব সমবায় সমিতির বেশিরভাগই ক্ষুদ্র আয়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অন্যদিকে কৃষিজাত শিল্পায়ন ও মৎস্য খাতে বিভিন্ন কারণে সমবায়ের কার্যক্রমে ভাটা পরিলক্ষিত হলেও দুগ্ধ খাতে সমবায়ের ক্রমেই বিস্তৃতি ঘটছে। এ ছাড়া দেশের পানি সম্পদের সুষ্ঠু ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পানি স¤পদ অবকাঠামো উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সুবিধাভোগীদের সমন¦য়ে দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি। আশ্রয়হীন ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে ভূমি ও বাসস্থান বরাদ্দ করে দেশের মূল ধারায় সংযুক্ত করার প্রয়াসে গড়ে উঠছে আশ্রয়ণ সমবায় সমিতি। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে এবং নিরাপদ আবাসন স্থাপনের লক্ষ্যে গড়ে উঠছে গৃহায়ন সমবায় সমিতি। সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি গ্রামের সব মানুষকে একত্রিত করে গ্রামের অনাবিষ্কৃৃত সম্ভাবনাগুলোকে উন্মোচন করে স্থানীয় স¤পদ সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। পরিবহন খাতে সংশ্লিষ্ট সমবায় তথা পরিবহন সমবায় দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। টেকসই পরিবেশ গড়তে সমবায়ের মাধ্যমে সামাজিক বনায়নকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়েছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সব সেক্টরে সমবায় কার্যকর ভূমিকা পালন করছে সেগুলো হচ্ছে নি¤œরূপ : কৃষি সমবায়, ২) বাজারজাতকরণ সমবায় ৩) শিল্প সমবায় ৪) মৎস্য সমবায় ৫) মহিলা সমবায় ৬) পরিবহন সমবায় ৭) দুগ্ধ সমবায় ৮) বীমা সমবায় ৯) সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় ১০) আশ্রয়ণ সমবায় ১১) পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় ১২) গৃহায়ন সমবায়। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাপনের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত জনগোষ্ঠী কিছু নাগরিক সুবিধা ভোগ করে, যা গ্রামের মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। বিদ্যুত, পাইপলাইনের মাধ্যমে রান্নার জন্য গ্যাস, কেবল টিভির সম্প্রচার, ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত সেবার বেশিরভাগ থেকেই গ্রামের মানুষ বঞ্চিত থাকে। অন্যদিকে গ্রামের মানুষ সবুজ প্রকৃতি, বিশুদ্ধ বাতাস, উন্মুক্ত খেলার মাঠ, তাজা শাক-সবজি এবং দূষণমুক্ত পরিবেশের সুবিধা পেলেও শহরে বসবাসকারী নাগরিকগোষ্ঠী তা থেকে বঞ্চিত হয়। জীবনযাপনের এই ব্যতিক্রমধর্মী বৈচিত্র্য থাকলেও বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের সঙ্গী হচ্ছে দারিদ্র্য। গ্রামের মানুষ নানামুখী দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের দারিদ্র্য, শিক্ষার দারিদ্র্য, আবাসনের দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশগত দারিদ্র্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দারিদ্র্য, মানবাধিকার ও আয় বৈষম্যজনিত দারিদ্র্যসহ নানামুখী প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় গ্রামের মানুষকে। নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার নগর ও গ্রামীণ জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমবায় নীতি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘লোভের উত্তেজনা, শক্তি উপাসনা, যে অবস্থায় সমাজে কোন কারণে অসংযত হয়ে দেখা দেয় সে অবস্থায় মানুষ আপন সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্ব সাধনার দিকে মন দিতে পারে না; সে প্রবল হতে চায়, পরিপূর্ণ হতে চায় না। এই রকম অবস্থাতেই নগরের আধিপত্য হয় অপরিমিত, আর গ্রামগুলো উপেক্ষিত হতে থাকে। তখন যত কিছু সুবিধা সুযোগ, যত কিছু ভোগের আয়োজন, সমস্ত নগরেই পুঞ্জিত হয়। গ্রামগুলো দাসের মতো অন্ন যোগায় এবং তার পরিবর্তে কোন রকম জীবনধারণ করে মাত্র। তাতে সমাজের মধ্যে এমন একটা ভাগ হয় যাতে এক দিকে পড়ে তীব্র আলো, আরেক দিকে গভীর অন্ধকার।’ বাংলাদেশের চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজ কাঠামোর একটি অন্যতম রূপ হচ্ছে সংঘবদ্ধ থাকা। পরিবার প্রথাভিত্তিক গোষ্ঠীতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মূল শক্তি হচ্ছে সম্মিলিত উদ্যোগ, সামাজিক বন্ধন এবং সমষ্টিগত উন্নয়ন। গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে সমবায় দর্শন বেশ টেকসই এবং কার্যকরী হাতিয়ার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বিচ্ছিন্নভাবে সমবায় ব্যবস্থা প্রায় শতাধিক বছর যাবত গ্রামীণ দারিদ্র্য লাঘবে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে তিন স্তরবিশিষ্ট সমবায় বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন পেশার ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ করে সমবায়ের মাধ্যমে এগিয়ে চলার পথ দেখায়। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষক সমবায়, জেলে সমবায়, তাঁতী সমবায়সহ নানা ধরনের পেশাভিত্তিক সমবায় সংগঠন গড়ে ওঠে। এসব সমবায় সমিতির যেমন সাফল্য ছিল তেমনি নানামুখী দুর্বলতা/ব্যর্থতাও কম ছিল না। ষাটের দশকে তিন স্তরবিশিষ্ট সমবায়ের পাশাপাশি দ্বিস্তর সমবায়ের যাত্রা শুরু হয়। আশির দশকের শুরুর দিকে এ ধরনের দ্বিস্তর সমবায়ের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটলেও বিংশ শতকের শুরুর দিকে সমবায়ের এ ধারাটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯০৪ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত সমবায় পদ্ধতির নানামুখী প্রয়োগ লক্ষ্য করা গেলেও কার্যত টেকসই সমবায় মডেল গড়ে ওঠেনি। সমবায় সেক্টরে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও জাতীয়ভাবে টেকসই গ্রাম উন্নয়নের কার্যকর পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায়নি। অথচ বিশ্বব্যাপী সমবায় একটি স্বীকৃত উন্নয়ন কৌশল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সম্পদের মালিকানার অন্যতম খাত হিসেবে সমবায়কে স্বীকৃতি দেয়া হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েই সমবায়কে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং শোষিত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের আওতায় সমবায়কে অন্যতম কৌশলিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে গ্রাম উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে সমবায়কে বেছে নেয়া হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩ অনুসারে রাষ্ট্রের উৎপাদনযন্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা ও বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক জনগণ। রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানাÑ এ তিন ধরনের মালিকানা ব্যবস্থা সংবিধানে স্বীকৃত। সমবায়ী মালিকানা হচ্ছে আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে সমবায়সমূহের সদস্যদের পক্ষে সমবায়সমূহের মালিকানা, যা সমষ্টিগত বা যৌথ মালিকানা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব মেহনতী মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তি দান করা। এক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, কেননা সমবায়, সমবেত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সকলের দ্বারা দুর্বলকে শোষণ থেকে মুক্ত করে তার ক্ষমতায়নে সহায়তা করে। যুগোপযোগী সমবায় নীতির আওতায় বিকশিত সমবায়ের মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে সামাজিক সাম্য ও সমতা অর্জনসহ মালিকানা সম্পর্কিত সাংবিধানিক স্বীকৃতির সফল রূপায়ণ সম্ভব। দেশের সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও এর উযোগিতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা, উৎপাদিত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে সমবায় প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এসব উদ্দেশ্য এবং সমবায় আন্দোলনের কাংক্ষিত সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে সমবায় সমিতিকে গণমুখী ও বহুমুখী করার উদ্দেশ্যে সমবায় অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দফতরের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করে জাতীয় পল্লী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন এবং অর্থনীতিতে সমবায়ের প্রভাব ও পরিমাণ বিস্তৃত করার লক্ষ্যে সমবায়বান্ধব নীতি আবশ্যক। পৃথিবীতে অনেক উন্নত রাষ্ট্রই সমবায়ের কৌশলকে অবলম্বন করে স্বাবলম্বী হয়েছে। বাংলাদেশও সমবায়ী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে, অনুপ্রাণিত হলে ড. আকতার হামিদ খানের প্রণীত পল্লী উন্নয়নের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে একমাত্র সমবায়ী চেতনায় মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে যে কোন কঠিনতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে সম্ভাবনাময় কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা উপহার দিয়ে বিশ্ব দরবারে তাকে এক সুনাম ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। লেখক : উপ-মহাপরিচালক আনসার ও ভিডিপি
×