ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

হাওড়ে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ॥ পাউবোর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩ জুলাই ২০১৭

হাওড়ে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি ॥ পাউবোর সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সুনামগঞ্জ হাওড়ে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি, অনিয়ম ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীসহ ১৫ জন কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রবিবার দুপুরে সুনামগঞ্জ সদর থানায় এই মামলা করেন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ফারুক আহমেদ। একই সঙ্গে পাউবোকে ১৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে দুদক। আসামিদের বিরুদ্ধে দ-বিধি ১৬৬/১০৯, ৪০৯/৫১১/১০৯ ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)ধারা/১০৯ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলা নং ২/১৯৫, ২০১৭। এ মামলার পরপরই আসামিদের মধ্যে সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরখাস্তকৃত নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আফছার উদ্দীনসহ দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। কমিশনের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণবকুমার ভট্টাচার্য জনকণ্ঠকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আসামিদের তালিকায় সিলেট বিভাগীয় পাউবো এবং সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। তাই মামলার অন্য আসামিদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে। মামলার আসামিরা হচ্ছেন সুনামগঞ্জের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আফছার উদ্দীন, সিলেট পওর সার্কেলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম সরকার, সিলেট উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই, সুনামগঞ্জের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দিপক রঞ্জন দাস, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমান, সুনামগঞ্জ পাউবোর ১০ জন সেকশন কর্মকর্তা হলেন- মোঃ শহিদুল্লা, ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ খান, খন্দকার আলী রেজা, মোঃ রফিকুল ইসলাম, মোঃ শাহ আলম, বরকত উল্লাহ ভূঁইয়া, মাহমুদুল করিম, মোঃ মোছাদ্দেক, সজিব পাল ও জাহাঙ্গীর হোসেন। এছাড়া মামলায় অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ৪৬ জন ঠিকাদার রয়েছেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, পাউবোর উক্ত কর্মকর্তাগণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট ৪৬ জন ঠিকাদারকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ করেছেন। তারা উভয়ে মিলে প্রতিবছরে বন্যা আসার সময় ও সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা সম্বন্ধে অবহিত থাকা সত্ত্বেও মৌলিক চুক্তি ভঙ্গ করেছে। এজাহারে বলা হয়, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে চুক্তিপত্রের সময়সীমা উল্লেখ থাকলেও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারগণ ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৮৪টি প্যাকেজের কাজ নির্ধারিত সময়ে সমাপ্ত করতে পারেনি। চুক্তিপত্রের শর্ত মোতাবেক ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক টেন্ডার চুক্তি বাতিল, কালো তালিকাভুক্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায় করে নতুনভাবে টেন্ডার আহ্বান করার বিধান থাকা সত্ত্বেও তা প্রতিপালন না করে নিজেরা অবৈধভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে এবং ঠিকাদারদের অবৈধ লাভবান করার মানসে উক্ত ৮৪টি প্যাকেজের কাজ ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে টেন্ডার ছাড়াই পূর্বের ঠিকাদারগণকে কাজ সমাপ্ত করার অনুমতি দিয়ে জনগণের ক্ষতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এছাড়াও ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাঁধ রিসেকশনিং (পুনরাকৃতি) কাজে টেন্ডার ডকুমেন্টের সময়সীমা অতিক্রম করা সত্ত্বেও অর্থাৎ ২৭ মার্চ, ২০১৭ পানি আসার আগ পর্যন্ত সময়ে ৪ জন ঠিকাদার কর্তৃক ৯টি প্যাকেজে কোন কাজ শুরু না করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক টেন্ডার চুক্তি বাতিল, কালো তালিকাভুক্তি ও ক্ষতিপূরণ আদায় করে নতুনভাবে টেন্ডার আহ্বান করার বিধান থাকালেও নিজেরা অবৈধভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে এবং ঠিকাদারদের অবৈধ লাভবান করার মানসে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক তা প্রতিপালন করেনি। অপরদিকে ৪৫ জন ঠিকাদার ১৫১টি প্যাকেজের কাজ চুক্তির সময়সীমার মধ্যে শুরু করলেও ২৭’ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত সময়ে সর্বনি¤œ ১০ ভাগ ও সবোর্”চ ৯০ ভাগ কাজ শেষ করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ঠিকাদারগণ নির্ধারিত সময়ে কাজ সমাপ্ত না করে বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক বন্যার অপেক্ষায় ছিল। যাতে পরবর্তীতে সরকারী অর্থ কাজ না করে অসৎ উদ্দেশ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসৎ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ভুয়া বিল প্রস্তুত ও দাখিল করে প্যাকেজের টাকা উত্তোলনপূর্বক আত্মসাত করতে পারেন। প্রকারান্তরে যা কৃষকের ও জনসাধারণের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সাধন করতে সহায়তা করেছেন। যা ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)ধারা তৎসহ দ-বিধি ৪০৯/১৬৬/৫১১/১০৯ ধারায় যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এজাহারে বলা হয়েছে, বাঁধ নির্মাণে সরকারী দায়িত্ব পালনে গুরুতর অবহেলাপূর্বক নিজে লাভবান হওয়ার উদ্দেশে প্রকল্প বাস্তবায়নে অধস্থন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়িত্ব সঠিকভাবে মনিটরিং ও কন্ট্রোলিং না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কর্মকর্তাগণ ঠিকাদারদের অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার দায়ে অধস্থন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এর মাধ্যমে জনসাধারণ ও কৃষকের আর্থিক ক্ষতিসাধনে অবৈধভাবে সহযোগিতা করেছেন। উল্লেখ্য, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে এ বছরের মার্চের শেষ দিকে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা তলিয়ে যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী হাওড়াঞ্চলের ছয় জেলায় মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮শ’ ৪০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ক্ষতির শিকার হয় আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩০ এপ্রিল সুনামগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে বলেন, বাঁধ নির্মাণে কারো গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর সঙ্গে জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। তারা যত ক্ষমতাশালীই হোক তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবির প্রেক্ষিতে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির তদন্ত করার আশ্বাস দেন। এরপরই হাওড় রক্ষা বাঁধ প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করে দুদক। কমিশনের পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। দুদকের তদন্ত চলার মধ্যেই সিলেটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ নুরুল ইসলাম সরকার, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর-পূর্বাঞ্চল) মোঃ আব্দুল হাই এবং সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আফসার উদ্দীনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
×