ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন পররাষ্ট্র কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে শহীদুলের বৈঠক

যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক কূটনীতিক গ্রেফতারে বাংলাদেশের উদ্বেগ

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৪ জুন ২০১৭

যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক কূটনীতিক গ্রেফতারে বাংলাদেশের উদ্বেগ

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহকর্মীকে ঠকানোর অভিযোগে একের পর এক কূটনীতিকদের গ্রেফতারে বাংলাদেশের উদ্বেগ বাড়ছে। কূটনীতিকদের গ্রেফতারের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত বলেও মনে করছে বাংলাদেশ। ঢাকার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই ওয়াশিংটনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগও প্রকাশ করা হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের ঘটনায় ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ও রাষ্ট্রদূত থমাস শ্যাননের সঙ্গে এক বৈঠকে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গৃহকর্মীকে নির্যাতন, শ্রমিক পাচার এবং মজুরি চাওয়ায় হত্যার হুমকির অভিযোগে গত ১৯ জুন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে যুক্তরাষ্ট্র পুলিশ। এর ৩৬ ঘণ্টা পর ৫০ হাজার ডলার বন্ডে জামিনে মুক্ত হন তিনি। এ ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই তার দুদিন পরেই একই ধরনের অভিযোগে গৃহকর্মীকে ঠকানো ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে হামিদুর রশীদ নামে জাতিসংঘের এক বাংলাদেশী কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপির ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজি এ্যান্ড পলিসি এ্যানালাইসিস ইউনিটের প্রধান হামিদুর আড়াই লাখ ডলার বন্ডের বিপরীতে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরের পাশাপাশি পাসপোর্ট জমা দিয়ে গ্রেফতারের সাত ঘণ্টা পর জামিনে মুক্ত হন। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি শ্যাননের সঙ্গে বৈঠকের সময় হামিদুর রশীদকে গ্রেফতারের তথ্য তখনও না পাওয়ায় বৈঠকে ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুলকে গ্রেফতারের বিষয়টি উত্থাপন করেই পররাষ্ট্র সচিব গভীর উদ্বেগ জানান। ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা অনুপযোগী বলে মনে করে বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশ আশা করছে এ বিষয়টির অবসানে ওয়াশিংটন প্রশাসন আন্তরিক হবে। বন্ধুপ্রতিম দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার বিশ্বাস ও আস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েই ডেপুটি কনসাল জেনারেলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার নিষ্পত্তিতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আশা পোষণ করেছেন পররাষ্ট্র সচিব। সূত্র জানায়, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলামের বাসায় মোহাম্মাদ আমিন নামে এক গৃহকর্মী কাজ করতেন। মোহাম্মাদ আমিনকে শাহেদুল ইসলাম নিজেই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যান সেখানে। নিউইয়র্কে তার কুইন্সের বাসায় মোহাম্মাদ আমিন ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মে পর্যন্ত কাজ করেছেন। তবে চার বছর সেখানে কাজ করার পর বিনা মজুরিতে জোরপূর্বক কাজ করানোর ঘটনায় শ্রম পাচার ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে গত বছরের মে মাসে পুলিশের কাছে গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে মামলা করেন আমিন। এক বছর আগের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন শাহেদুল। এর আগে ২০১৪ সালে ঠিক একইভাবে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ফাহিমা তাহসিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। তাদের গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা অভিযোগ করেছিলেন, মাসে তিন হাজার ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বেতন ও ভাল কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান বাংলাদেশী ওই দম্পতি। কিন্তু বাস্তবে ওই পরিমাণ বেতন দেয়া হয়নি। বরং তাকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। বিনা বেতনে তাকে আমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো। এসব অভিযোগ করে ম্যানহাটন ফেডারেল আদালতে সে সময় গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা ওই মামলাটি দায়ের করেন। সেসব অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন। ওই মামলা দায়েরের পর গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিন কার্ড পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কূটনীতিক তাদের গৃহকর্মী হিসেবে যাদের নিয়ে যাচ্ছেন, তারাই পরে কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে উল্টো অভিযোগ করছেন। আর তাদের অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নেয়ার জন্য তারা আদালতে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছেন। আর এর ফলে ফেঁসে যাচ্ছেন কূটনীতিকরা। সূত্র জানায়, গৃহকর্মীকে নির্যাতন, শ্রমিক পাচার এবং মজুরি চাওয়ায় হত্যার হুমকির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পর জামিনে মুক্তি পান ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলাম। নিউইয়র্ক পুলিশ স্থানীয় সময় সোমবার সকালে শাহেদুলকে নিজ বাসা থেকে গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টা পর কুইন্স সুপ্রীমকোর্টে হাজির করলে বিচারক ড্যানিয়েল লুইস ৫০ হাজার ডলারের বন্ড বা নগদ ২৫ হাজার ডলারে তার জামিন ঠিক করে দিয়েছিলেন। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি জামিনে মুক্ত হন বলে জানিয়েছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। বিচারকের ঠিক করে দেয়া ৫০ হাজার ডলার বন্ডে তাকে মুক্ত করা হয়। ঠিক একই ধরনের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় হামিদুর রশীদকেও। গৃহকর্মী নির্যাতনের এ অভিযোগকে শাহেদুলের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। তিনি বলেছেন, গৃহকর্মী নির্যাতিত শ্রমিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের অভিপ্রায়ে এমন প্লট তৈরি করেছেন। সময়ের ব্যবধানে তা প্রমাণিত হবে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশী কূটনীতিককে গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, কূটনীতিককে গ্রেফতারের ঘটনাটি কনস্যুলার সম্পর্ক বিষয়ক ১৯৬৩ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের পরিষ্কার লঙ্ঘন। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্সের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়।
×