ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এএমএম সালেহ

কৃষি বিপ্লব ও বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৪ জুন ২০১৭

কৃষি বিপ্লব ও বঙ্গবন্ধুর কৃষি দর্শন

‘আমার দেশের এক একর জমিতে যে ফসল হয় জাপানের এক একর জমিতে তার তিনগুণ ফসল হয়। কিন্তু আমার জমি দুনিয়ার সেরা জমি। আমি কেন সেই জমিতে দ্বিগুণ ফসল ফলাতে পারব না, তিনগুণ করতে পারব না? আমি যদি দ্বিগুণও করতে পারি তাহলে আমাকে খাদ্য কিনতে হবে না। ...আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্টপরা, কাপড়পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাইÑ জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ওই শহীদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি আমাদের অভাব ইনশাআল্লাহ হবে না’- ২৬ মার্চ, ১৯৭৫ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর প্রতি উপরোক্ত আহ্বানটি জানিয়েছেন। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ৬০ থেকে ৭০ দশকে অধিকাংশ কৃষি জমি এক ফসলি ছিল। এমনকি অনেক জমি অব্যবহৃত পড়ে থাকত। বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশনা জনগণের মাঝে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর খালি জায়গায় সেনাসদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রমে ধান চাষ শুরু করেন। ঢাকার অভিজাত এলাকা ধানম-ি, গুলশানসহ অন্যান্য এলাকার বাড়ির সামনে খালি জায়গাগুলোয় বিভিন্ন শাকসবজি চাষ শুরু হয়। কৃষি খাতে তখন বেশকিছু সহায়ক কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এটাই ছিল বাংলাদেশে কৃষি বিপ্লবের সূচনা। ॥ দুই ॥ বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে প্যান্ট, কোট ছেড়ে মাঠে না নামলে বিপ্লব করা যাবে না, তা যতই লেখাপড়া করা যাক, তাতে কোন লাভ হবে না। আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কৃষক ও কৃষিবিদদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৬৮-৬৯ সালে কৃষিকাজের জন্য সারাদেশে ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্প ছিল। বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় ৭৪-৭৫ সালে পাম্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজারে। ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কৃষকদের ভর্তুকি মূল্যে সার দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ফসলের উৎপাদন বাড়াতে উচ্চফলনশীল বীজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। কৃষকদের আধুনিক কৃষির ছোঁয়া দিতে কলের লাঙ্গল ও ট্রাক্টর আমদানি করেন। কৃষি কেন্দ্রিক একটি গ্রামমুখী অর্থনীতি ব্যবস্থার বিকাশে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবার প্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। ভূ-স্বামীদের হাত থেকে ভূমির মালিকানা বের করে এনে ভূমিহীন ক্ষুদ্র কৃষকদের মাঝে তা বিতরণের উদ্যোগ নেন। সমবায়ী পদ্ধতিতে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্দোবস্ত দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ১৩৫ এ বঙ্গবন্ধুর কৃষি সংস্কার আর কৃষক দরদি মনোভাবের আরও কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। এই আদেশে বলা হয়েছে, নদী কিংবা সাগরগর্ভে জেগে ওঠা চরের জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে হতদরিদ্র কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা। মহাজন ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে গরিব কৃষকদের রক্ষাই উদ্দেশ্য ছিল তার। কৃষিজপণ্যে ক্ষুদ্র বিক্রেতাদের শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীনে কৃষি, ধান, পাট প্রভৃতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন বলেই, গ্রাম ও কৃষকদের উন্নয়নে ছিল বঙ্গবন্ধুর ধ্যান ও জ্ঞান। ॥ তিন ॥ ১৯৯৬ সালে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা কৃষকরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি উন্নয়ন, মহিলাদের কৃষিতে অংশগ্রহণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ ২০০০ সালে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। জাতির এ অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এএফও) থেকে সেরেস পদকে ভূষিত হন। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি বছর কৃষি উন্নয়ন থমকে গিয়েছিল যার ফলে খাদ্য আমদানি করতে হয়েছিল। কিন্তু ২য় দফায় দেশরতœ শেখ হাসিনাকে বাংলার জনগণ দেশ পরিচালনা দায়িত্ব অর্পণ করলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং খাদ্য আমদানিকারক দেশ থেকে খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। ॥ চার ॥ ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শক্তি আবার সরকার গঠন করলে কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের রুদ্ধ পথ একে একে খুলতে শুরু করে। কৃষি খাতে আবার ভর্তুকি, সার বিতরণ ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, শস্য বহুমুখীকরণসহ অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। সার ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে সরকারের ভর্তুকি নীতি। একসময় যে ইউরিয়া সার ৬০ টাকা মূল্যে বিক্রি হতো ভর্তুকির ফলে দাম দাঁড়িয়েছে কমবেশি ২০ টাকা। একই সঙ্গে জলসেচের ব্যবস্থা করার জন্য পাম্প চালনার জন্য ডিজেলের জন্য মূল্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়েছে। জমির পরিমাণ ভেদে দুই স্তরে যথাক্রমে ৮০০ ও ১০০০ টাকা হিসেবে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। কৃষকদের জন্য ১০ টাকা মূল্যে ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোরো মৌসুমে অনেক সময় শহরে লোডশেডিং বাড়িয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রয়াস চালানো হয়েছে। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি থাকলেও সরকার কৃষি খাতের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে ও কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে। ভাল বীজে, ভাল ফসল। ভাল ও গুণগত মানসম্পন্ন বীজ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে জোরদারকরণ করা হয়েছে। ॥ পাঁচ ॥ কৃষিতে বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের বিস্ময়। হালের বলদের পরিবর্তে বর্তমানে প্রায় শতভাগ কৃষকের জমি চাষ হচ্ছে কলের লাঙ্গল বা ট্রাক্টরে। গ্রাম-গঞ্জে কৃষিতে লেগেছে প্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের ছোঁয়া। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সবদিক থেকে বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। ১৯৭০-৭১ সালে এদেশে চালের উৎপাদন ছিল প্রায় ১ কোটি টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন । গত এক যুগে দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে। দেশে এখন ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এ কৃষক পরিবারগুলোর সবাই কমবেশি সবজি চাষ করেন। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। মাছে-ভাতে বাঙালী প্রবাদটি মাঝে হারিয়ে গেলেও বর্তমানে তা আবারও বাস্তব। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন মতে ২০১৪ সালে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টন হয়েছে। দশ বছর আগেও বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ছিল অর্ধলাখ টনের নিচে। বর্তমানে বাংলাদেশের আলুর উৎপাদন ৮২ লাখ ১০ হাজার টন (এফএও,২০১৪)। এ সাফল্য বাংলাদেশকে করেছে বিশ্বে আলু উৎপাদনে অষ্টম। অচিরেই বাংলাদেশে আলু উৎপাদন কোটি টনের দিকে যাবে বলে আশা করা যায়। বিশ্বে আম উৎপাদন অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। দেশে গড়ে ৩২ হাজার একর জমিতে আমের আবাদ হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম। আম উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। আসলেই খাদ্য উৎপাদনে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকের মাথায় এসে উৎপাদনের পাশাপাশি উদ্বৃত্ত খাদ্য সংরক্ষণের জায়গাটি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে রাষ্ট্রকে। খাদ্যশস্যের ন্যায্য মূল্যের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসছে। নিরাপদ ও মানসম্পন্ন কৃষিপণ্যের কথা ভাবছি আমরা। ক্ষুধা নিবৃত্তির ধাপ শেষে জাতির পুষ্টি নিশ্চিতের কাজ চলছে। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ কৃষক ও কৃষিবিদদের জীবনমান উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ও সেইসঙ্গে কৃষকরতœ শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ কৃষি বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। লেখক : সভাপতি, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ
×