ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইজাজ আহমেদ মিলন

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য ’৭৩-এ কবি নির্মলেন্দু গুণ

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ২১ জুন ২০১৭

জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য ’৭৩-এ কবি নির্মলেন্দু গুণ

‘জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম, এখন আমার সব কিছুতেই হাসি পায়/আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।’ আধুনিক কাব্য সাহিত্যের দিকপাল কবি নির্মলেন্দু গুণ জন্ম এবং মৃত্যু সম্পর্কে এভাবেই বলেছেন তার স্ববিরোধী কবিতার শেষাংশে। সত্য ও সুন্দরের উপাসক কবি গুণ তার কবিতায় যথার্থই বলেছেন। প্রত্যেকটা মানুষই জন্মের প্রয়োজনে ছোট থাকে। আর মৃত্যুর প্রয়োজনেই বড় হন। বড় হতে হতে যখন আর বড় হওয়ার জায়গা থাকে না তখনই তিনি অনিবার্য ঠিকানায় চলে যান। আর এ সব দেখে কবির বড্ড হাসি পায় যেমনটা কান্না পেয়েছিল জন্মের সময়। আজ ২১ জুন। ৬ ফুট দীর্ঘ, উন্নত নাসিকা, রবীন্দ্রনাথের মতো শ্মশ্রƒম-িত, তীব্র- তীক্ষè চোখ আজীবন ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত কবি নির্মলেন্দু গুণ ’৭৩-এ পা রাখলেন। এ কথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, কবি নির্মলেন্দু গুণই বাংলাদেশে জীবিতদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পাঠকনন্দিত কবি। এই কবিতার পেছনেই তিনি জীবনের প্রায় পুরো অংশই বিনিয়োগ করেছেন। এই কবিতাই তার ধ্যান জ্ঞান সাধনা। এ কবিতা গুণদাকে সব দিয়েছে। তিনি সফলতার শীর্ষে আরোহন করেছেন যৌবন শুরু হওয়ার বেশ আগেই। ১৯৬৮ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার বোন সোনালিকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনÑ ‘আমার কাছে আমার কবিতা আমার চোখের মতো। আমার কাছে আমার কবিতা আমার আত্মার মতো। আমার কাছে আমার কবিতা আমার রক্তের মতো প্রিয়। আর কবিতাও আমাকে ভালবাসে বলেই হয়ত ষাট দশকের যেসব কবি পূর্ববঙ্গে জন্ম নিয়েছে তাদের মধ্যে যদি পাঁচজনেরও নাম করতে হয়- তবে আমার নাম অপরিহার্য।’ গুণদা সারাটা জীবনই তার লেখনীতে সত্য আর সুন্দরের উপাসনা করেছেন। যদি তাকে ফাঁসির মঞ্চে নেয়া হয় কিংবা জিহবা কেটে দেয়া হয় তবুও তিনি কখনও মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। নেননি কখনও। প্রবল আত্মবিশ্বাসী এ কবি চরম সত্য কথাকে যে কোন ভর মজলিশে অকপটে বলে যেতে পারেন। নিজের বিপক্ষে গেছে অথচ অকপটে লিখেছেনও এমন নানা সত্য কথা। যেমন- হোটেলে খেয়ে টাকা না থাকার জন্য দৌড়ে পালিয়েছেন, কলেজে-হোস্টেল ম্যানেজার নির্বাচিত হয়ে টাকা চুরি করেছেন, সে টাকা দিয়ে জুয়া খেলেছেন। গুণদা তার আত্মজীবনী আমার কণ্ঠস্বরে লিখেছেন ‘দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করে আমি হোস্টেলের ছাত্রদের ম্যানেজার নির্বাচিত হই। ম্যানেজার হয়ে আমি শুরু করি টাকা মারা। পঞ্চাশ টাকার মাছ কিনে বলি ষাট টাকা। এক শ’ টাকার মাংস কিনে বলি, এক শ’ বিশ টাকা। এভাবে মহানন্দে দিন চলতে থাকে। ইতোমধ্যে টেডি জুতো আর আকাশি নীল কেরোলিন শার্ট কেনা সম্পন্ন। দিনে আয় করি, রাতে ওই টাকা দিয়ে বসি জুয়া খেলতে। দিনের উপার্জন রাতে হারাই। ফলে পরেরদিন বাজারের টাকা থেকে চুরি করাটা আমার জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমার জীবন ধারণের মান যত ঊর্ধ্বমুখী হয় ছাত্রদের খাদ্যের মান খুব স্বাভাবিক নিয়মেই নিম্নমুখী হতে থাকে।’ নিচের চৌর্যবৃত্তি কিংবা জুয়া খেলার কথা এত সহজ করে আর কে আছেন বলতে পারেন? এই বলার সাহস একমাত্র গুণদারই আছে। কবিতাই একদিন তাঁকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেছিল, কবি হওয়ার জন্য এসেছিলেন শহরে। তিনি কবি হয়েছেন, শুধু কবিই নন, বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম গুটি কয়েক জনপ্রিয় কবির মধ্যে তাঁর নামটি সবার শীর্ষে। তার ভাষায় ‘কবিতার জন্য আমি একদিন গ্রাম ছেড়েছিলাম এখন আবার গ্রামে ফিরে যেতে চাই। কবিতা লেখার কারণে আমি মানুষের অনেক ভালবাসা পেয়েছি আমার কবি জীবনে। এখন আমার জন্ম ভিটা বারহাট্টার কাশবনে গিয়ে মানুষের সেবা করতে চাই। আমার আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই আমি অভিভূত, আমি তৃপ্ত’। ১৯৪৫ সালের এই দিনে নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার কাশবন গ্রামে সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরীর ওরসে মাতা বীণাপাণি গুণের গর্ভে তাঁদের চতুর্থ সন্তান কবি নির্মলেন্দু গুণ জন্ম গ্রহণ করেন। চার বছর বয়সে মাতৃহারা হওয়ার পর নতুন মা চারুবালার হাতে তিনি লালিত পালিত হন। কাশতলা নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করলেও পরবর্তীকালে কবি তাঁর গ্রামের নাম রাখেন ‘কাশবন’। সেই থেকে গোটা কাশতলা গ্রাম কাশবন হয়ে যায়। সেই কাশবন এখন গুণ তীর্থে পরিণত হয়েছে। স্কুল করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, মাইকেল এবং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। তৈরি করেছেন দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। সেই কাশবন এখন দেশের শীর্ষ একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখনও চলছে তাঁর কবিতা লেখার নিরন্তর প্রয়াস। কবিতা তাঁর প্রাণ, সবকিছু। শুধু কী কবিতা? না- নির্মলেন্দু গুণের গদ্য সম্ভারও কম নয়। তাঁর কাব্যসমগ্র যেমন তিন খ-ে প্রকাশিত হয়েছে তেমনি তার গদ্য সমগ্র হয়েছে তিন খ-ে। পৃষ্ঠার সংখ্যা বিচারে বরং তার গদ্যের পরিমাণই বেশি। শুরুতে তিনি নাটক রচনায় প্রেয়সী হয়েছিলেন। তাঁর রচিত প্রযুক্তিনির্ভর নাটক ‘এ যুগের আকবর’ ১৯৬৭ সালে মঞ্চস্থ হয়। এ নাটকে রেডিও, টিভি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান টিভিতে তাঁর লেখা নাটক প্রচারিত হয়। ওই নাটকে তিনি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থ দিয়ে কবির সাড়া জাগানো আত্মপ্রকাশ। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬-দফা ঘোষিত হওয়ার পর বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। পরে একটি ডাকাতি মামলায় জড়িত করে তাঁর নামে হুলিয়া জারি করা হয়। তার নামে চুরির মামলাও হয়েছে। শুরু হয় তাঁর ফেরারি জীবন। ১৯৬৯ সালে তিনি লেখেন তার জনপ্রিয় কবিতা ‘হুলিয়া’। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেন এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে কবি ভারসাম্য হারিয়ে গ্রামে ফিরে যান। পরে ঢাকায় ফিরে এলে সেনাবাহিনী তাঁকে পরিকল্পিতভাবে গ্রেফতার করলে কিছু দিন হাজতবাসের পর মুক্তি পান। ১৯৭৭ সালে নীরালাহিড়ীর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর রয়েছে মৃত্তিকা গুণ নামে এক কন্যা। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ভারত, নেপাল, যুগোশ্লাভিয়া, ভিয়েতনাম, লন্ডন, নিউইয়র্ক, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার, সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, হুমায়ুর কবির স্মৃতি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পদকসহ দেশ এবং দেশের বাইরের শতাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তাঁর এই লেখক জীবনে। কবির জন্মদিনে রইল অনেক অনেক প্রীতি আর শুভেচ্ছা। লেখক : কবি
×