ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ

চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ও করণীয়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২১ জুন ২০১৭

চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ও করণীয়

ঢাকা শহরে এখন চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা অনেক। কোন পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু রোগটি মানুষের মাঝে এক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকে রোগটি মহামারীভাবে দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন। মহামারী শব্দটি আমাদের ভয় ধরায় অতীতে ‘কলেরা মহামারী’ বা গুটি বসন্ত মহামারীর স্মৃতি আমাদের আছে। তাই বর্তমান অবস্থাকে আমি ‘প্রাদুর্ভাব’ বলতে চাই। একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একসঙ্গে অনেকে ও একটি নির্দিষ্ট এলাকায় হয়, এমন রোগ বিস্তারকে ‘প্রাদুর্ভাব’ বলাই সঙ্গত। রোগটি নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক লেখা ও বলা হয়েছে। সভা-সমিতি, কাগজে টিভিতে এখন প্রত্যেক দিন আলোচনা হচ্ছেÑ যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, রোগটির বাহক মশা এবং মশা নিয়ে যারা পড়াশোনা বা কাজ করেন, কীটতত্ত্ববিদ তাদের অংশগ্রহণ নেই। যদিও বলা হচ্ছে, রোগটির কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেইÑ বাহক মশা মারাই এই রোগটি থামাতে পারে এবং একে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করাও একমাত্র মশা ধ্বংস করার মধ্যেই নিহিত। গত ৫০ বছর ধরে পোকামাকড় নিয়েই কাজ করেছি, তাই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি। চিকুনগুনিয়া রোগটি নিয়ে চিকিৎসকরাই কথা বলবেন। যদিও দেখি চিকিৎসকরা ‘মশা বাহক’ নিয়ে বিশেষজ্ঞর মতো কথা বলেন। আমরা রোগটি নিয়ে কথা বললে ভ্রু কোচকাতে পারেন অনেকে। তবুও তাদের মতোই দু-একটি কথা বলি রোগ সম্বন্ধে। রোগটি ডেঙ্গু রোগের মতোই। একই মশা দ্বারা রোগ দুটি হয়। ‘জিকা ভাইরাস’ রোগটিও এই মশা দ্বারাই সংক্রমিত হয়। তাই অনেক সময় রোগটি ‘ডেঙ্গু’ না ‘চিকুনগুনিয়া’ বোঝা যায় না। ঢাকা শহরে সরকারী প্রতিষ্ঠান, ‘রোগ তত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ রোগ নির্ণয় করার সুবিধা আছে বিনা পয়সায়। শুনেছি বাজারে এটি করতে কোন কোন প্রতিষ্ঠান ২০০০-২৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়। রোগ নির্ণয় সরকারী স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান করার ব্যবস্থা করা উচিত। যে ব্যক্তির একবার এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তার দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চিকিৎসকরা প্রায়ই বলেন ‘আতঙ্কিত হবেন না। এই রোগের কারণে মৃত্যুর ঝুকি নেই।’ কথাটি সত্যি। কিন্তু যার এই রোগটি হয়েছে, তিনি তার গিটে গিটে (ঔড়রহঃ) যে প্রচ- ব্যথা অনুভব করেন, তা অবর্ণনীয়। যাদের এই ধরনের ‘বাত’ আছে তাদের চিকুনগুনিয়া হলে, তাদের কষ্ট অনেক বেড়ে যায় ও দীর্ঘ স্থায়ী হতে পারে মাস বা বছর পর্যন্ত। চিকিৎসকরা এই রোগ হলে যে চিকিৎসা দেন, তা রোগটি সারাতে পারেন না, শুধু লক্ষণ ও উপসর্গ কমানোর চেষ্টা করেন। রোগটি নিয়ে যে কথাটি চিকিৎসকরা বলেন না, তা হলো এই রোগের কারণে ‘লিউকেপেনিয়া’ হতে পারে। এর ফলে আমাদের রক্তে যে ‘সাদা রক্ত কণিকা’ থাকে তা কমে যেতে পারে। সাদা রক্ত কণিকাই আমাদের রোগের বিরুদ্ধে ‘ইমিউনিটি’ গড়তে সাহায্য করে। ফলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। চিকিৎসকরা হয়ত এই তথ্যে মানুষ আতঙ্কিত হতে পারে বলে তা রোগীকে জানান না। তবে কথাটা সত্যি। রোগ সংক্রমণে মশা এটা এখন সবারই জানা, চিকুনগুনিয়া দুটি এডিস মশা (অফবং ধবমুঢ়ঃর এবং অব. ধষনড়ঢ়রপঃধং) দ্বারা সংক্রমিত হয়। এই মশা দিনে, বিশেষ করে সকালে ও বিকেলে দংশন করে। তবে কখনও কখনও রাতে আলোকিত স্থানেও এদের দংশন করতে দেখা গেছে। প্রথম মশাটিকে এই রোগের প্রধান বাহক বলে ধরা হয়। দ্বিতীয় বহনকারী হিসেবে পরের মশাটি গণ্য করা হয়। এই দুটি মশা নিয়ে দু-একটি কথা বলা দরকার। ‘এডিস ইজিপ্টাই’ মশা প্রধানত ঘরের ভেতরে কামড়ায় তবে বাইরেও কামড়াতে পারে। এই মশা সাধারণত ঘরের মধ্যে থাকা পাত্র যেমন ফুলদানি, পানির পাত্র, চৌবাচ্চা ইত্যাদি পাত্রে দেখা যায়। বাইরে ফেলে রাখা পাত্রেও এরা ডিম পাড়ে। কিন্তু এডিস এ্যালবোপিকটাস উপরোক্ত পাত্র ছাড়াও প্রাকৃতিক পাত্র যেমন গাছের কোঠর, পাতা ও কা-ের মাঝে জমা পানি (খবধভধীরষ) কাটা বাঁশ, ডাবের খোসা, কলা গাছের খোল ইত্যাদিতে ডিম পাড়ে। তাই কোন কোন ক্ষেত্রে এই মশার সংখ্যা বেশি। এ কারণেই এডিস এ্যালবোপিকটাস মশাকে গ্রামাঞ্চলে, উপশহর ও গাছপালা ঢাকা পার্কে প্রচুর দেখা যায়। আমার মনে হয় বাংলাদেশে প্রাথমিকভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ও ঢাকার দোহার অঞ্চলে যে চিকুনগুনিয়া দেখা গেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে তা এই মশা দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। ঢাকা শহরেও অনেকে বাড়ির আশপাশে ও ছাদে গাছপালা লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে, ফলে দুই প্রকার মশাই এখানে এখন বেশি দেখা যায়। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কি করণীয় সব রকম মশা সংক্রামক রোগেই দুটি ব্যবস্থা থাকে। ১। রোগীর চিকিৎসা। আমাদের চিকিৎসকরা এ ব্যাপারে সচেতন এবং তার ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তারা জনগণকে এই রোগ থেকে কিভাবে দূরে থাকা যায়, এ ব্যাপারে পরামর্শ দেবেন। ২। রোগ বাহক মশা নিয়ন্ত্রণ মশা নিয়ন্ত্রণে সাধারণভাবে যে যে ব্যবস্থা নেয়া হয়, প্রাদুর্ভাবের সময় এর সঙ্গে আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ (অফঁষঃ) মশা মারার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ যে মশাটি রোগী থেকে রোগজীবাণু (ভাইরাস) একবার গ্রহণ করেছে, সেই মশাটি ২-৩ দিন বেঁচে থাকবে (প্রায় এক মাস), ততদিন রক্ত পান করার সময় (২-৩ দিন পর পর) যত মানুষকে কামড়াবে ততদিন রোগ ছড়াবে। সাধারণত মশা একজনের কাছ থেকেই যা রক্ত পায় সে দিয়েই সে তার ডিমকে পরিপক্বতার দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু এ ইজিপটাই মশা কয়েক জনের কাছ থেকে সেই রক্ত সংগ্রহ করে, অর্থাৎ এই মশা আরও বেশি মানুষের মাঝে রোগ বিস্তার করতে পারে। তাই প্রাদুর্ভাবের সময় পূর্ণাঙ্গ মশা মারার ব্যবস্থা আগে নিতে হবে। সঙ্গে মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও চলবে। পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ন্ত্রণ মশা মারা নিয়ন্ত্রণ কাজ, ঢাকা শহরে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। তারা জরুরীভাবে ‘ফগিং মেশিনের’ সাহায্যে কীটনাশক ছিটাবে। এই মশার জন্মস্থান ও তার আশপাশের বাড়িতে ফগিং করবে। ঢাকা শহরে বেশ কটি ‘পেস্ট কন্ট্রোল’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে ফগিং মেশিন আছে। তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে এই কাজে জড়িয়ে করতে হবে। মশার কামড় থেকে রক্ষা ছোট বাচ্চা, বৃদ্ধ ও চিকুনগুনিয়া রোগী। দিনে বিশ্রাম নেয় এমন ব্যক্তি, অন্যান্য রোগী সবাইকে মশারির মধ্যে রাখতে হবে। হাসপাতালেও চিকুনগুনিয়া রোগীকে মশারির মধ্যে রাখতে হবে। কয়েল, এ্যারোসেল ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। হাত-পা ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরতে হবে। এক কথায় দিনে মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার সব ব্যবস্থা নিতে হবে। ২। অপূর্ণাঙ্গ মশা বা লার্ভা নিয়ন্ত্রণ ঘরের বাইরে ও ভেতরের জমা থাকা পানিতে এই মশার জন্ম হয়। বাইরের পাত্রে বর্ষার পানি জমে। ঘরের পাত্রে, মানুষের দ্বারা। আমাদের জরিপে দেখা গেছে বাড়ির বাইরে ফেলে রাখা প্লাস্টিকের পাত্র, টায়ার, চৌবাচ্চা, মটকা, বালতি, ড্রাম রঙের কৌটা, অব্যবহৃত ফুলের টব ও সরা, ভাঙ্গা সিরামিক ও মাটির দ্রব্য প্রধান। দেখা গেছে, বাড়ির বাইরে যে চৌবাচ্চা বাড়ি তৈরি করার সময় বানানো হয় সেখানে লাখ লাখ ডিম মশার লার্ভা দেখা যায়। ঘরের ভেতরে ফুলদানি, ড্রাম, ফুলের টব ও সরা ইত্যাদি প্রধান। ঢাকার শাঁখারি পট্টিতে প্রতি বাড়িতে ৪-৫টি চৌবাচ্চা, ড্রাম ও মটকা পানি রাখার জন্য ব্যবহার হয়। সেগুলো ঢাকা শহরের অন্যতম মশার জন্মস্থান। আমরা অনেক সময় লক্ষ্য করি বিভিন্ন সংস্থা, ফ্রিজের নিচের ট্রে বা কুলারের ট্রেতে মশার লার্ভার কথা উল্লেখ করি। আমাদের জরিপে এমন স্থানের অবস্থান অনেক নিচে। প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করে জনগণকে তা ধ্বংস এবং নষ্ট বা বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যে রাখতে বলতে হবে। যেন সেখানে মশার জন্ম না হয়। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতের ওপর আলোচনার সারমর্ম। ১। রোগীর চিকিৎসাও এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা। ২। পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরীভাবে কার্যক্রম নেয়া। ফগিং স্প্রে করে পূর্ণাঙ্গ মশা মারা। ৩। মশার কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষ করে দিনের বেলায় মশারি ব্যবহার করা। বিশেষ পোশাক পরিধান করা। ৪। বাড়ির বাইরে ও ভেতরে কোন পাত্র যেন ৫ দিনের বেশি পানি জমা না থাকে তার ব্যবস্থা নেয়া। প্রয়োজনে পাত্র নষ্ট করা বা উবুড় করে রাখা বা কোন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা। ৫। টায়ারে যেন কোনভাবেই পানি না জমে তার ব্যবস্থা নেয়া চৌবাচ্চা যেন ঢেকে রাখা বা কীটনাশক ব্যবহার করা। ৬। সিটি কর্পোরেশন যেন যেখানে সেখানে পড়ে থাকা পাত্র তাদের ময়লা কার্যক্রমের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলে। ৭। জনগণকে সচেতন করার জন প্রচার ব্যবস্থা গ্রহণ। স্কুল- কলেজে ছাত্রদের সচেতন করা। ৮। যত ক্লাব, সমিতি, বয়েস স্কাউট, গার্লস গাইডের সাহায্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়ার প্রচেষ্টা নিতে হবে। ৯। এ কাজে এনজিওদের অংশগ্রহণ অবশ্য কর্তব্য। পরিশেষে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে একটি ‘টেকনিক্যাল কমিটি’ তৈরি করা। যারা জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করবেÑ ও সাধারণ অবস্থায় ও প্রাদুর্ভাবের সময় কি করণীয় তা ঠিক করবে। এই কমিটিতে চিকিৎসক ছাড়াও ‘কীটতত্ত্ববিদদের প্রাধান্য দিতে হবে। লেখক : মেডিক্যাল কীটতত্ত্ববিদ
×