ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার কৌশল বেগম জিয়ার

প্রকাশিত: ২১:৪৩, ১৮ জুন ২০১৭

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার কৌশল বেগম জিয়ার

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার কৌশল নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ জন্যই তিনি এতদিন নির্দলীয় সরকারের দাবি জানিয়ে এলেও এখন যে কোন ধরনের সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলছেন। এমনকি নির্বাচন অনেক দূরে থাকলেও তিনি ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। প্রসঙ্গত, আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলতেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে হবে তারপর আমরা দেখব নির্বাচনে যাব কিনা। কিন্তু রমজান শুরুর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তিনি কোন না কোন ইফতার পার্টিতে অংশ নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলের নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নিতে বলছেন। কোন কোন ইফতার পার্টিতে তিনি সরাসরি বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ মার্কার জন্য ভোটও চাচ্ছেন। আর তার এ ধরনের বক্তব্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে দলের নেতাকর্মীরাও আশাবাদী হচ্ছেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সারাদেশের সর্বস্তরে বিএনপি নেতাকর্মীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার কৌশল নিয়েছেন। জানা যায়, বিএনপিপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে খালেদা জিয়া নির্বাচনমুখী বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। এর ফলে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যেমন ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সনের নির্বাচনমুখী বক্তব্যের কারণে উজ্জীবিত হয়ে সাংগঠনিকভাবেও চাঙ্গা হতে শুরু করেছে দলটি। এমনকি জেলায় জেলায় নতুন কমিটি দেয়া এবং কোন্দল নিরসনের কাজও শুরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া যারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান তাদের তৎপরতাও আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। এদিকে আসন্ন ঈদের পর নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেয়ার প্রস্তুতিও এগিয়ে নিচ্ছে বিএনপি। সংবাদ সম্মেলন করে এ রূপরেখা প্রণয়নের পর সেটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে দলটি। এ জন্য জনমত তৈরি করতে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরে গিয়ে সমাবেশ করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। একইভাবে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদেরও তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে সহায়ক সরকারের রূপরেখা সম্পর্কে জনমত তৈরি করতে বলা হবে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, যে কোন পরিস্থিতিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বর্তমানে রাজনৈতিভাবে বেকায়দায় থাকা দলটি ইতোমধ্যেই নির্বাচনমুখী তৎপরতা জোরদার করেছে। খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারাও নির্বাচনমুখী তৎপরতা জোরদার করার কৌশল হিসেবে বলছে আর কোন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে খালি মাঠে গোল করার সুযোগ দেয়া হবে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায় বিএনপির বড় একটি অংশই এখন মনে করছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। যে ভুলের খেসারত এখন দলের নেতাকর্মীরা দিচ্ছেন। দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ এবং ২০ দলীয় জোটের কোন কোন শরিক দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনে খালেদা জিয়াকে যে ভুল বার্তা দিয়েছিল এটিও এখন বিএনপির সর্বস্তরে আলোচিত হচ্ছে। তবে এবার আর এমন ভুল করতে চায় না দলের নেতাকর্মীরা। দলের হাইকমান্ডও এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে। আর এ কারণেই খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরেরও বেশি সময় হাতে রেখেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে সরব রয়েছে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া নিশ্চিত হলেও এ নির্বাচনে যাতে অধিক সুবিধা পাওয়া যায় সেজন্য বিএনপির পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবিদাওয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। যেমন দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার থাকতে হবে। আরও বলা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। আর এগুলো নিশ্চিত করা গেলে বিএনপি নিজেদের পক্ষে ভোট আদায় করে নির্বাচনের ফসল ঘরে তুলতে পারবে বলেই দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন। নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখতে সম্প্রতি এক ইফতার পার্টিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ করে বলেন, বর্তমান সরকার আপনাদের কাছে যা আবদার করবে, আপনারা তা বাস্তবায়ন করবেন না। আপনারা জনগণের মতামত নেবেন। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে যে মতামত পাবেন, তার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন পরিচালনা করবেন। আরেকটি ইফতার পার্টিতে খালেদা জিয়া বলেন, ২০১৮ সাল হবে জনগণের বছর। ২০১৮ সালে দেশ থেকে সব অত্যাচার বিদায় নেবে। অপর একটি ইফতার পার্টিতে তিনি ধানের শীষের পক্ষে ভোট চান। এদিকে খালেদা জিয়ার মুখে নির্বাচনমুখী বক্তব্য শুনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও আশাবাদী হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই ঈদকে সামনে রেখে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের ছবি সংবলিত পোস্টার ও ব্যানার সাঁটানো শুরু করেছে। একই সংসদীয় এলাকায় একাধিক নেতা এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও শুরু করেছে। এ ছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীরা নেতাকর্মীদের জড়ো করে ইফতার পার্টির আয়োজন করছেন। বিএনপি হাইকমান্ড চায় অতীতের সকল ভুলত্রুটি সংশোধন করে এবার সর্বস্তরে দল গুছিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করে দলের জন্য কাক্সিক্ষত ফল বয়ে আনতে। এ জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে টার্গেট নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিছু কাজ করে যাচ্ছেন তারা। বর্তমানে একদিকে সর্বস্তরে দল গোছানোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনমুখী বিভিন্ন কর্মকা- জোরদার করছেন। ইতোমধ্যেই দলের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির প্রস্তুতিও শুরু করা হয়েছে। বিএনপি ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’ এর আলোকেই এ নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সরকার মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকলেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল ভাল ফল করবে। তবে দলের কোন কোন নেতার বিরুদ্ধে স্পর্শকাতর মামলা থাকায় তাদের শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয় কিনা এমন আশঙ্কা আছে। অবশ্য এ জন্য দলীয় হাইকমান্ডের আগাম প্রস্তুতিও রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে একটি কৌশলও গ্রহণ করা হয়েছে। এ কৌশলের অংশ হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাইয়ের সময় প্রতিটি সংসদীয় এলাকা থেকে ৩টি নাম রাখা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা হারানোর পর টানা দুই বছর রাজনৈতিকভাবে চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বিএনপি। এ সময় দলের অনেক সিনিয়র নেতাকে বিভিন্ন মামলার আসামি হয়ে জেলও খাটতে হয়। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নিবাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পায় তারা। কিন্তু ২০১৩ সালে ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে আবারও কঠোর সমালোচনর মুখে পড়ে বিএনপি। বিএনপির এ নাজুক পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর ক্ষমতা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসে। এ পরিস্থিতিতে সরকার পতনের লক্ষ্যে গতবছর ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালন করে দলটি। কিন্তু এ কর্মসূচী পালনের সময় দেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় নাশকতার মামলায় জড়িয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতা পেরেশানির মধ্যে পড়েন। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে মাঠের আন্দোলন তো দূরে থাক দলের স্বাভাবিক কর্মকা- চালাতেই হিমশিম খায় বিএনপি। তাই অতীতের ভুলভ্রান্তি অতিক্রম করে বিএনপি এখন সর্বস্তরে দল গুছিয়ে এবার নির্বাচনে যেতে চায়। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখে বিএনপি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেবে। ইতোমধ্যে বিষয়টি দলীয় ফোরামে চূড়ান্ত হয়েছে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেয়ার পর দলের নেতাকর্মীরা সেই দাবি আদায়ে রাজপথে থাকবে। ইতোমধ্যে সাংগঠনিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলের প্রার্থীদের বিষয়েও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন দলের কর্মকা-ে নিষ্ক্রিয় নেতাদের ডেকে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। সর্বস্তরে দলকে ঢেলে সাজিয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম আরও গতিশীল করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি আরও জোরদার করা হচ্ছে। আমরা চাই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। শীঘ্রই নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেয়া হবে। আমাদের দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ইতোমধ্যেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। সে মোতাবেক আমরা সবাই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা বর্তমান সরকারসহ সবার সহযোগিতা চাচ্ছি।
×