ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক নয়

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৭ জুন ২০১৭

চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক নয়

নিখিল মানখিন ॥ চিকুনগুনিয়া ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তবে এ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে তারা বলেছেন, চিকুনগুনিয়া জ্বর নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। এতে কারও মৃত্যু ঘটবে না। এই জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে। গত কয়েক মাস ধরে রাজধানীতে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত একটি ভাইরাসের নাম। ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী মশাই চিকুগুনিয়া ভাইরাস বহন করে। এটি নতুন কোন ভাইরাস নয়। ১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় রোগটি শনাক্ত হয়। এখন বিশ্বের প্রায় ৬০ দেশে রোগটি দেখা যায়। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে এই রোগটির প্রকোপ প্রথম দেখা যায়। তবে এর আগে এই রোগীটি বাংলাদেশে অন্য নামে পরিচিত ছিল। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে ঢাকার ৯২ স্থানে আজ শনিবার নামছে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, এডিস মশার কারণে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি ও আবহাওয়ার উষ্ণতা বেশি হওয়ায় চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার দ্রুত বাড়ছে। সম্প্রতি ঢাকা শহরে একটি জরিপ চালানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ৪৭ ওয়ার্ডে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র দেখেছি। স্বাভাবিক মাত্রার ইনডেক্স ২০ হলেও ঢাকা শহরের ৪৭ ওয়ার্ডের গড় ইনডেক্স ৫২; যা দ্বিগুণের বেশি। অর্থাৎ ঢাকা শহরের এডিস মশার প্রকোপ অনেক বেশি এবং এ কারণে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে অন্য নগরীতে চিকুনগুনিয়ার দু’একটা কেস পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, কামড় খেয়েছে ঢাকায়। কিন্তু জ্বর হয়েছে ঢাকার বাইরে গিয়ে- এমনটিও হয়েছে। এই মুহূর্তে ঢাকা নগরী আতঙ্কের কারণ। সিটি কর্পোরেশনের কর্মী বাহিনী মশক নিধন কর্মসূচী পালন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই মশাগুলো ঘরের ভেতরে থাকে। বাইরে ফগিং করলে তাতে মশা খুব মরছে বলে মনে হচ্ছে না। একই সঙ্গে তাদের কর্মী বাহিনীর সঙ্কট রয়েছে। এ দুর্যোগে যে ধরনের কর্মী বাহিনী দরকার তাদের সেটা নাই। আবুল কালাম আজাদ বলেন, চিকিৎসকদের চেম্বারে রোগী আসছে। লক্ষণ হলো অনেক জ্বর, গোড়ালিসহ বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা। কেউ কেউ ৪-৫ দিনের মধ্যে সেরে উঠলেও কিছু ক্ষেত্রে ৪-৬ মাসও সময় লাগতে পারে। অনেকে চলাফেরাও করতে পারে না। এজন্য এটাকে অবজ্ঞা করতে পারি না। শুভ্রতার প্রতীক সাদা এ্যাপ্রোন পরিহিত মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা মহানগরীর ৯২ এলাকায় ঘুরে ঘুরে এ অভিযান চালাবেন। এ কার্যক্রম সফল করতে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে আজ থেকে তিন দিনব্যাপী (১৪, ১৫ ও ১৬ জুন) অভিযান বিষয়ে ওরিয়েন্টশন ও প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা ঈদের ছুটি কাটাতে বাড়ি যাওয়া বিলম্বিত করে এ কর্মসূচীতে অংশ নিতে রাজি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, অনুকূল পরিবেশ পাওয়ায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী মশার প্রকোপ বেড়েছে। ফলে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়েছে। চিকুনগুনিয়া রোগের প্রথমদিন থেকেই রোগীর অনেক বেশি তাপমাত্রায় জ্বর ওঠে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। আর প্রায় তা ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উঠে যায়। একই সঙ্গে প্রচ- মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, বিশেষ করে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা হয়। এজন্য গ্রামগঞ্জে অনেকে একে ল্যাংড়া জ্বরও বলে। জ্বর চলে যাওয়ার পর শরীরে লাল র‌্যাশ ওঠে। জ্বর ভাল হলেও রোগটি অনেকদিন ধরে রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য কোন ভাইরাসে এতটা ভোগান্তি হয় না। সচেতন হতে হবে, তবে এই ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই। চিকুনগুনিয়া থেকে বাঁচতে সতর্কতা হিসেবে করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলছেন, মশার কামড় থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের বারান্দা, আঙ্গিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচদিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নিচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে । যেহেতু এই মশাটি দিনের বেলায় কামড়ায়, তাই দিনের বেলায় কেউ ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা মারার জন্য স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। ছোট বাচ্চাদের হাফপ্যান্টের বদলে ফুলপ্যান্ট পরতে হবে, আর সবার খেয়াল রাখতে হবে যেন মশা ডিম পাড়ার সুযোগ না পায়। তাহলেই এই রোগটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ঢাকার ধানম-ি, কলাবাগান, গ্রীনরোড, হাতিরপুল, লালমাটিয়া, মালিবাগ ইত্যাদি এলাকা থেকে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে বেশি যাচ্ছে। এছাড়া নারীদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হার তুলনামূলক বেশি। এই রোগের কোন নির্দিষ্ট প্রতিকার নেই। লক্ষণ দেখে চিকিৎসা ঠিক করা হয়। এ বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডাঃ তাহমিনা শিরিন বলেন, এ বছর মৌসুমের আগেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাই মশার উপদ্রব বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি। এ জন্য প্রত্যেককে তার আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। কোথাও যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময়ের জন্য জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর এই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায় এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা রয়েছে।
×