ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস আজ

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ১৫ জুন ২০১৭

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস আজ

মোরসালিন মিজান ॥ বর্ষা এসেছে। সচরাচর যে আনন্দ নিয়ে আসে, আবেগ আর উচ্ছ্বাসে বাঙালীকে যেভাবে ভাসায়, এবার তা হয়নি। নবধারা জলে পুলক নেই কোন। বেদনাবিধুর বর্ষা এসেছে। প্রাক-বর্ষার অবিরাম বৃষ্টি শুধু বৃষ্টি হয়ে নেই। বৃষ্টির চোখে জল। এরই মাঝে পাহাড় ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আর তারপর আনুষ্ঠানিক শুরু হলো বর্ষার। আজ বৃহস্পতিবার ১ আষাঢ়, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। প্রতিবছর এ দিনে বিপুল উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নিজস্ব আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়া হয় বর্ষাকে। এবার উৎসব অনুষ্ঠান থাকলেও, মূলত চোখের জলে প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নেবে বাঙালী। অবশ্য প্রকৃতিপ্রেমীরা এ জন্য বর্ষাকে দোষারোপ করতে নারাজ। চট্টগ্রামের দুর্যোগকে তারা মনুষ্যসৃষ্ট বলেই জ্ঞান করছেন। পাহাড় কাটা, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপনের দায় তারা বর্ষাকে দিতে চান না। বরং প্রকৃতির প্রতি সবার আরও সদয় হওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা। আজকের দিনে বৃষ্টিভেজা দিনের সুখস্মৃতিগুলো স্মরণ করতে চান। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। বর্ষা মৌসুম শুরুর একদিন আগে বুধবারও বিপুল বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বিকেল বেলার ভারি বর্ষণ আরও বর্ষণের আভাস দিয়েছে। এদিকে, বৃষ্টি মানেই প্রাণের ছোঁয়া। অনন্য ঋতুর আগমণে এরই মাঝে নতুন প্রাণ পেয়েছে প্রকৃতি। কবিগুরুর ভাষায়, ‘তামার মন্ত্র বলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-/মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা ...। এরই মাঝে বেলী, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। আর মিষ্টি হাসি হয়ে যথারীতি ফোটেছে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।’ ময়ূর পেখম মেলে নাচতে শুরু করেছে। বর্ষার এই চিত্ত চাঞ্চল্য থেকেই কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে...।’ ময়ূরের মতোই বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুলে যাওয়ার সময় কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা। আর যতœ করে ব্যাগে পুড়ে রাখে রঙ্গিন ছাতাটি। তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। এই তো বর্ষার সৌন্দর্য! মানুষের মনেও আশ্চর্য দোলা দিয়ে যায় বর্ষা। সে কথা জানিয়ে নজরুল লিখেছিলেনÑ ‘রিম্ঝিম্ রিম্ঝিম্ ঘন দেয়া বরষে।/কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে...।’ একই আবেগ থেকে উকিল মুন্সি গেয়ে ওঠেন, ‘যেদিন হইতে নয়া পানি আইলো বাড়ির ঘাটে সখি রে/ অভাগিনীর মনে কত শত কথা ওঠে রে...।’ বর্ষা বাঙালীকে আবেগঘন করে। ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা প্রেমের বোধকে জাগিয়ে তুলে। কবিগুরুকে তাই লিখেছেনÑ তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা...। একই অনুভূতি থেকে নজরুল লিখেছেন- রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝরে শাওন ধারা।/গৃহকোণে একা আমি ঘুমহারা।/ ঘুমন্ত ধরা মাঝে/জল-নূপুর বাজে,/বিবাগী মন মোর হলো পথহারা...। ঠিক পরের স্তবকে প্রিয়ার সান্নিধ্য লাভের আকুলতার কথা জানিয়ে কবি লেখেনÑ চেনা দিনের কথা ভেজা সুবাসে,/অতীত স্মৃতি হয়ে ফিরে ফিরে আসে।/এমনি ছলছল ভরা সে- বাদরে/তোমারে পাওয়া মোর হয়েছিল সারা ...। কবি নির্মলেন্দু গুণ আরও নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, বর্ষাই একমাত্র নারী। একমাত্র রমণী। তিনি আমাদের প্রিয় দ্রৌপদী। বাকি পাঁচ ঋতু হচ্ছে মহাভারতের পঞ্চপা-ব! হয়ত এ কারণেই বর্ষায় বিরহ বেড়ে যায়। পুরনো বিয়োগ ব্যথা বুকে বাজে। অভিন্ন অনুভূতির কথা জানিয়ে বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতি লিখেছেনÑ এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা ভাদর/ মাহ ভাদর/ শূন্য মন্দির মোর...। হয়ত একই কারণে মহাকবি কালিদাস দেশান্তরিত যক্ষকে বর্ষাকালেই বিরহে ফেলেছিলেন। এমন দিনে সবচেয়ে আপনজনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা থেকে লোককবি দুর্বিন শাহ লেখেনÑ প্রাণ সখিরে, আষাঢ় মাসে নতুন জোয়ার, ডুবায় গাঙ্গের দুটি পাড়/খেলব সাঁতার কারে সঙ্গে লইয়া...। রবীন্দ্রনাথের বলাটি এ রকমÑ বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে/ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল...। আর নজরুলের সেই বিখ্যাত গান তো সকল বিরহীরÑ শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না/বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না...। কবি অন্যত্র লিখেছেন, ‘অথৈ জলে মাগো, মাঠ-ঘাট থৈ থৈ/আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই...।’ এভাবে অসংখ্য কবিতারও জন্ম হয় বর্ষায়। বলা হয়ে থাকে, বর্ষা ঋতুতেই জীবনের প্রথম কাব্য রচনা করেন বাংলার কবিরা। পরিণত কবিও বর্ষাকে আশ্রয় করেন। আলাদা করে বলতে হয় হাওড় অঞ্চলের কথা। বর্ষায় হাওড়ের চেহারা আমূল বদলে যায়। গ্রীষ্মে হাওড়ের যে অংশ পায়ে হাঁটার পথ, বর্ষায় তা অথৈ জল নদী। শুকনো মৌসুমে যে জায়গায় হালচাষ করে কৃষক, ভরা বর্ষায় সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরে জেলে। বর্ষায় ভাঁটি অঞ্চলের বাবা-মায়েরা নৌকোয় করে তাদের মেয়েকে নাইওর আনার ব্যবস্থা করেন। সেই দৃশ্য দেখে ভাঁটির বাউল উকিল মুন্সি গেয়ে ওঠেনÑ গাঙে দিয়া যায়রে কত নায়-নাইওরির নৌকা সখি রে/মায়ে-ঝিয়ে বইনে-বইনে হইতেছে যে দেখা রে ...। বর্ষায় এসব অঞ্চলে প্রচুর বিয়ের প্রচলন আছে। নৌকো করেই বর যান বিয়ে করতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এই সাতটি জেলার লোককবিরা বর্ষা দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। তাদের কালজয়ী সৃষ্টি সে কথা বলে। তবে বেশি বৃষ্টি টানা বর্ষণের কারণে বর্ষা প্রায়শই দুর্যোগের হয়েও ওঠে। এবারের পূর্বাভাসটিও খুব ভাল নয়। পাহাড়ে একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না বাংলাদেশ। বর্ষায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা যেমন থাকে তেমনি, ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে ভেসে যায় দেশের নিম্নাঞ্চল। অনেকে তাই আতঙ্কে পার করেন বর্ষাকাল। একই কারণে সারাবছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। শাহ আবদুল করিম সে অবস্থা তুলে ধরে বলেছিলেনÑ আসে যখন বর্ষার পানি ঢেউ করে হানাহানি/ গরিবের যায় দিন রজনী দুর্ভাবনায়/ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না/বর্ষায় মজুরি পায় না গরিব নিরুপায়...। একইভাবে ঝড়ে খেই হারানো জেলের নৌকোটিও ফেরে না কত দিন! আর কর্দমাক্ত পথে পা পিছলে পড়ার গল্পত প্রতিদিনের। তবে সুন্দরের বর্ষাই সকলের চাওয়া। অতুলনীয় ঋতুর কাছে কবিগুরুর প্রার্থনাটি এ রকমÑ এমন দিনে সকলের সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধারায়,/বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা...। বর্ষাবরণ উৎসব প্রতিবারের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরণ করে নেয়া হবে প্রিয় ঋতুকে। আজ সকালে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বর্ষা উৎসবের আয়োজন করবে উদীচী। সকাল ৭টায় যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান। একক কণ্ঠে বর্ষার গান করবেন দেশের শিল্পী মাহমুদ সেলিম, ছায়া কর্মকার, অনিমা মুক্তি গোমেজ, বিমান বিশ্বাস, মহাদেব ঘোষ প্রমুখ। কবিতায় বর্ষা বন্দনা করবেন বাচিক শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, বেলায়েত হোসেন ও ডালিয়া আহমেদ। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবে বহ্নিশিখা ও স্বপ্নবীণা। নৃত্য পরিবেশন করবে স্পন্দন। বর্ষা উৎসবে বেলায়েত হোসেনের গ্রন্থনায় বিশেষ গীতি-আলেখ্য ‘বিহ্বল বর্ষায়’ পরিবেশন করবেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকবে বর্ষা কথন। এতে অংশ নেবেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, সফিউদ্দিন আহমদ। নিজেদের পছন্দ মতো সময়ে বর্ষাবরণ উৎসবের আয়োজন করবে ছায়ানট। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীও দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে বলে জানা গেছে।
×