ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের গিফটে এখন বগুড়ার চিকন সেমাই

প্রকাশিত: ০৬:৪৪, ১৪ জুন ২০১৭

 ঈদের গিফটে এখন বগুড়ার চিকন সেমাই

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার চিকন সেমাই ঐতিহ্যের দইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। একদা যে সেমাইয়ের কদর ছিল স্বল্প রোজগেরে মানুষের কাছে সেই চিকন সেমাই এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পৌঁছেছে। গ্রামের হাটবাজার থেকে নগরীর শপিংমল হয়ে রাজধানীর পাঁচ তারকা খচিত হোটেলে মেলে। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সকলের ঘরে বগুড়ার চিকন সেমাই এখন সমান জনপ্রিয়। বর্তমানে বগুড়ার এই চিকন সেমাই ঈদের ‘গিফটের’ খাতায় নাম লিখিয়েছে। নিকট অতীতে বগুড়ার গ্রামের নারী কাপড় কাচার বড় পিঁড়ি পরিষ্কার করে তার ওপর ময়দা ছেনে হাতের তালুর ডলান দিয়ে বানাত এই সেমাই। নিখুঁত হাতের কাজে সেমাই এতটাই চিকন হয়ে উঠত যে ভাবনাতেও আসত না হাতে বানানো। খুব বেশি দিনের কথা নয়। গত শতকের ’৮০-এর দশকেও কদর ছিল না। বলা হতো গরিবের সেমাই। ঈদের দু’একদিন আগে গ্রামের কিষান বধূর হাতে তৈরি সেমাই কৃষক ডালায় ভরে কাঁধে তুলে নিয়ে আসত শহরে। বাজারে বসার জায়গা পেত না। বসত পথের ধারে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীও এই সেমাই কিনত না। দিনমজুর, স্বল্প আয়ের লোকজনই ছিল এই সেমাইয়ের ক্রেতা। দামও কম। বগুড়াসহ কয়েকটি অঞ্চলে রমজান শেষের এই ঈদের আরেক পরিচিতি ‘সেমাইয়ের ঈদ’। যারা বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকেন তারাও ঈদ মৌসুমে স্বজনদের কাছে এয়ার ফ্রেইটে চিকন সেমাই পাঠানোর ইনডেন্ট দিয়ে বসে। বগুড়ার মানুষের আত্মীয়স্বজন যারা কর্মক্ষেত্র ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় থাকেন ঈদে নিজের বাড়িতে আসতে না পারলে তাদেরও এই চিকন সেমাইয়ের আবদার। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এই চিকন সেমাই মধ্যবিত্তের ঘরে প্রবেশ করতে থাকে। শহরের বাজারের কিছু দোকানিও একটু করে এই সেমাই তোলে। একই সময়ে বগুড়ার কালিতলা এলাকার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ দুই অশ্বশক্তির মোটরেচালিত সেমাই বানানোর যন্ত্র আবিষ্কার করে। দিনে দিনে গ্রামে ও শহরে যন্ত্রে এই চিকন সেমাই তৈরির বিস্তার ঘটে। চাহিদাও বাড়ে। বগুড়া ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যায়। চাহিদার প্রয়োজনে সেমাই তৈরির যন্ত্র বড় আকারে বিদ্যুতে চালিত আধুনিকায়ন হয়ে যায়। এরপর চিকন সেমাইকে আর পেছনের ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে ভর বছর বগুড়ার চিকন সেমাই মেলে। শহরের বাজার ছাড়াও ডিপার্টমেন্ট স্টোর, শপিংমলে পাওয়া যায়। প্রতিবছর রমজান শেষের ঈদে চিকন সেমাইয়ের চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ট্রাকে করে এই সেমাই যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলায়। চাহিদার প্রয়োজনে ঈদের প্রায় দুই মাস আগে চিকন সেমাই তৈরির হিড়িক পড়ে। বগুড়ার প্রতিটি জায়গায় গুচ্ছ গ্রামের মতো ‘সেমাই পল্লী’ গড়ে উঠেছে। শহরতলির সাবগ্রাম, বেজোড়া, শ্যাওলাগাতি, কালিসামাটি, ফুলবাড়ি, ফুলতলা এলাকাগুলোতে সেমাই শ্রমিকরা সেহরির পর কাজ শুরু করে। টানা চলে বিকেল পর্যন্ত। প্রতিটি ছোট কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৫শ’ কেজি করে সেমাই তৈরি হয়। বর্তমানে প্রতিদিন চিকন সেমাই উৎপন্ন হচ্ছে ৬০ থেকে ৮০ মেট্রিক টন (৬০ থেকে ৮০ হাজার কেজি)। বগুড়ার চিকন সেমাই কুটিরশিল্পে পরিণত হয়েছে। গ্রামের অনেক বাড়িতেও ঈদ মৌসুমকে সামনে রেছে ছোট যন্ত্রে সেমাই তৈরি হয়।
×