ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

অংশগ্রহণমূলক জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা চাই

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১৪ জুন ২০১৭

অংশগ্রহণমূলক জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা চাই

(গতকালের পর) কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শুধু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেই এই গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন অনেক সময় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্পের অনুমোদন দিলেও সেটা ওই সংস্থা তার মতো করে দেয়। আবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগও তার মতো করে অর্থ সংগ্রহ করে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কোন ঋণ গ্রহণ করবে না। কিন্তু অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সেই সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে তার মতো করে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত প্রকল্পের জন্য ঋণ নিচ্ছে। এ নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজ তথা পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হলেও তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। আসলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সমন্বিত জাতীয় কোন দলিল বা পরিকল্পনা না থাকার কারণেই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এ বিষয়ে যে যার মতো কাজ করছে। দুর্যোগের সঙ্গেও জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক মিল আছে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই ঘন ঘন দুর্যোগ হচ্ছে। কিন্তু দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ের সঙ্গে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কর্মকা-ের সমন্বয় ঘটছে না। ইদানীং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তার মতো করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ন্যাপস তৈরি করতে হলে বড় মাপে জাতীয় পরিসরেই হওয়া উচিত। আমাদের সপ্তম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়ে গাইডলাইন দেয়া আছে। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই ন্যাপস করতে হবে। সেই সঙ্গে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ন্যাশনালি ডিটারমাইনড কনট্রিবিউশন (এনডিসি) তথা বাংলাদেশ নিজে থেকে কি পরিমাণ কার্বন নির্গমন হ্রাস করবে তার আলোকে তৈরি করতে হবে এই ন্যাপস। যার সঙ্গে দেশের বিনিয়োগ পরিকল্পনারও সাযুজ্য থাকা উচিত। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) পেতে এই পরিকল্পনা প্রণয়নে তাড়াহুড়ো করছে। তারা চাইছে, দ্রুত ন্যাপস তৈরি করে জিসিএফে জমা দিতে, যাতে এই তহবিল থেকে অর্থ প্রাপ্তির পথ সুগম হয়। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যদি কাজটি ঠিকমতো না হয়, তার জন্য আবার পড়ে পস্তাতে হবে। সবদিকে নজর দিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন কঠিন কাজ। সেই কাজটি যখন করা হচ্ছে সময় একটু বেশি লাগলেও একবারেই করা উচিত। সবপক্ষের সব মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে জাতীয় পর্যায়েরই একটি ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান প্রণয়ন করা উচিত। যাতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। সেক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা প্রণয়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে সামনে নিয়ে আসা উচিত। যাতে এটি একটি জাতীয় পরিকল্পনা হিসেবে প্রণীত হয় এবং সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তা অনুসরণ করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। আমরা ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যানকে কোন সাইডলাইন দলিল হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা এটিকে একটি জাতীয় পরিকল্পনা দলিল হিসেবে দেখতে চাই। এজন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে ওই কমিটির তত্ত্বাবধানে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হোক। যেখানে পরামর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গি নয়, প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হবে এবং সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। যাতে এই পরিকল্পনা ব্যবহার করে শুধু জিসিএফ-ই নয়, বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকেও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থ পাওয়ার পথ সুগম হয়। সব ধরনের তহবিল থেকে অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা কাজে লাগানো যায়। যেহেতু এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইউএনএফসিসিসির কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। ২০২০ সালের আগে এটি প্রণয়ন করলেই হবে, সেহেতু একটু সময় নিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করাই হবে যুক্তিযুক্ত কাজ। আর জিসিএফ থেকে প্রকল্পের বিপরীতে অর্থ পাওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে তা অব্যাহত থাকুক। কারণ, ন্যাপস হলেই যে জিসিএফ থেকে অর্থ পাওয়া যাবে, না হলে যাবে না এটা এমন কোন জরুরী বিষয় নয়। অনেক মন্ত্রণালয়েরই এ ব্যাপারে কিছু কিছু করার আছে। ফলে ন্যাপসকে একটি জাতীয় দলিলে পরিণত করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এছাড়া আমরা জানতে পেরেছি, সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জলবায়ু পরিবর্তন পরিকল্পনা-২০০৯ (বিসিসিএসএপি-২০০৯) পর্যালোচনা করতে যাচ্ছে। এই পর্যালোচনার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্রে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে সকল কৌশল ও কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল, তা পর্যালোচনা করা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কৌশলপত্রটি আধুনিকায়ন এবং জনগণের চাহিদা অনুসারে প্রয়োজনীয় কর্মসূচী গ্রহণ করা। কিন্তু আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, কৌশলপত্রটি পর্যালোচনার জন্য সরকার বিদেশী সাহায্য সংস্থার (জার্মান সাহায্য সংস্থা জিআইজেড) আর্থিক সহায়তায় এবং বিদেশী কনসালটেন্ট তথা বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র-২০০৯ পর্যালোচনার তাগিদ দিয়ে আসছিলাম। যেহেতু কৌশলপত্রটি প্রণয়নে তৎকালীন সময়ে দেশীয় বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনাবিদদের দ্বারা করা হয়েছিল, সেক্ষেত্রে পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও তাদের অথবা সরকারের নিজ দায়িত্বে অন্য কোন দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এই কৌশলপত্রের পর্যালোচনা প্রকৃতপক্ষেই একটি কার্যকর পদেক্ষপ হতে পারত। অতীত অভিজ্ঞতা হলো বিদেশী বিশেষজ্ঞ (যাদের দেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব কোন জ্ঞান নেই) দ্বারা প্রণীত কোন পরিকল্পনাই বাংলাদেশের জন্য সার্থক ফলাফল তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। জাতীয় পরিকল্পনায় ব্যর্থ দলিল প্রণয়নের উদাহারণ হিসেবে আমরা স্যাপ এবং পিআরএসপির কথা বলতে পারি। তাই বিসিসিএসএপি-২০০৯ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলপত্র। এটা যদি বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা এবং আধুনিকায়নের চেষ্টা করা হয়, তাহলে জাতীয় স্বার্থ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু বিদেশী সংস্থার আর্থিক সহায়তা নেয়ার কারণে এবং এর শর্ত হিসেবে বিসিসিএসএপি-২০০৯ পর্যালোচনায় এসব বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ কিছু দেশীয় লোকজন দ্বারা কিছু তথ্যভা-ার তৈরি করবেন এবং কতগুলো তথাকথিত তাত্ত্বিক উন্নয়ন মডেল ব্যবহার করে বিসিসিএসএপি-২০০৯ পর্যালোচনা করবেন। যেখানে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকৃত প্রভাব, উপকূলীয় জনগণের প্রকৃত চাহিদা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে সঠিক উন্নয়ন কৌশলের প্রতিফলন করবে না। বিসিসিএসএপি-২০০৯ বা জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র বাংলাদেশের জন্য একটি আন্তর্জাতিক দলিল। কারণ, এই কৌশলপত্রকে সামনে রেখেই সরকারকে ভবিষ্যতে বৈশি^ক বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণ করার জন্য ধনী দেশগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি বা নেগোসিয়েশন করতে হতে পারে, যে কারণেই এই কৌশলপত্রটি পর্যালোচনা অতি গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই এই দলিলটি যদি কথিত বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে এমন সব কৌশল প্রাধান্য পেতে পারে যার কারণে জলবায়ু বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর প্রকৃত উন্নয়ন চাহিদা বিপন্ন হওয়ার পাশাপাশি ধনী দেশসমূহের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বিসিসিএসএপি-২০০৯ পর্যালোচনা গুটিকয়েক কনসালটেন্ট বা বিশেষজ্ঞের একক কাজ নয়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহের টেকসই বাস্তবায়নে সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় জড়িত এবং সেক্ষত্রে তাদের অংশগ্রহণ, বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার বা বিনিময় করা সর্বোপরি উন্নয়ন বিষয়ক সরকারের সকল নীতিমালা কিভাবে এই কৌশলপত্রের সঙ্গে সমন্বিত হবে তা একটি জরুরী বিবেচনার বিষয়। দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশলপত্র-২০০৯ পর্যালোচনা এবং আধুনিকায়ন করার দাবি জানাচ্ছি। যাতে বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর প্রকৃত উন্নয়ন চাহিদা প্রতিফলিত হয়। (সমাপ্ত) লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×