ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফের নব্য জেএমবির মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টা ॥ নিউমার্কেট এলাকা থেকে আটক ৬

ওরা বিশিষ্ট এক আলেমকে হত্যা করে নাশকতার চেষ্টা চালাতে চেয়েছিল

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৩ জুন ২০১৭

ওরা বিশিষ্ট এক আলেমকে হত্যা করে নাশকতার চেষ্টা চালাতে চেয়েছিল

গাফফার খান চৌধুরী/আজাদ সুলায়মান ॥ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে নব্য জেএমবি। তারা গোপনে সংগঠিত হয়ে চোরাগোপ্তা হামলার পাশাপাশি বড় ধরনের নাশকতা চালানোর চেষ্টা করছে। জঙ্গীদের তৎপরতার বিরুদ্ধে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানে ঢাকা থেকে পুলিশের হাতে মসজিদের ইমামসহ নব্য জেএমবি ছয় সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। তারা একজন বিশিষ্ট আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা মোতাবেক একত্রিত হয়েছিল। তাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকার সিএমএম আদালত। আর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত নব্য জেএমবির শরীয়াহ বোর্ডের আমীর শায়খ মামুনুর রশীদের পরিকল্পনায় বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা চলছিল। অন্যদিকে রাজশাহীতে নব্য জেএমবির একটি আস্তানার সন্ধান মিলেছে। আস্তানা থেকে উদ্ধার হয়েছে অস্ত্র-গোলাবারুদ। গ্রেফতার হয়েছে নব্য জেএমবির তিন জঙ্গী। আস্তানাটি থেকে উদ্ধার হয়েছে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের নারী ও শিশুসহ নয় আত্মীয় স্বজনকে। গ্রেফতারকৃত নব্য জেএমবি সদস্যদের বরাত দিয়ে এমন তথ্যই জানানো হয়েছে পুলিশ ও র‌্যাবের তরফ থেকে। সারাদেশে চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় রবিবার রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট থানাধীন নিউ সুপার মার্কেট এলাকায় হানা দেয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একটি দল। অভিযানে গ্রেফতার হয় জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য জাহিদুল ইসলাম ওরফে জোহা ওরফে মাশরুর (২৩), আবু বকর সিদ্দিক ওরফে আবু মোহাম্মদ (১৯), মোহাম্মদ উল্লাহ আদনান (১৯), মেহেদী হাসান ইমন ওরফে আবু হামজা (২১), খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে আবু মুসাব (১৯) ও শামসুদ্দীন আল আমিন ওরফে আবু আহমদ (২২)। তাদের কাছ থেকে জব্দকৃত মোবাইল ফোন ও নোট বুকে জঙ্গীবাদের আলামত, উগ্রমতবাদ প্রচারের কাগজপত্র, পেনড্রাইভ ও মেমোরি কার্ড উদ্ধার হয়েছে। যাতে জঙ্গীবাদের নানা আলামত রয়েছে। সোমবার দুপুরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান এবং ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে জানান, গ্রেফতারকৃত আদনান নিউমার্কেট এলাকার একটি মসজিদে তারাবির নামাজ পড়ান। ইমাম আদনানের মাধ্যমে তারা গ্রেফতারকৃত অন্যরা সেখানে সমবেত হতো। তারাবি নামাজের সূত্র ধরে নব্য জেএমবির সদস্যরা ওই মসজিদে একত্রিত হতো। তারা নিয়মিত মসজিদে বৈঠক করত। গোপন সেই বৈঠকে তারা দেশের একজন খ্যাতিমান ওলামাকে হত্যার চক্রান্ত করছিল। তবে কৌশলগত কারণে টার্গেটকৃত ওই ওলামার নাম প্রকাশ করা হয়নি। ওই ওলামা ইসলামে জঙ্গীবাদের জায়গা নেই বলে প্রচার চালিয়ে থাকেন। মনিরুল ইসলাম জানান, জেএমবির কেন্দ্রীয় কমিটি বা মজলিশে শূরার সদস্য সংখ্যা এখন পাঁচজন। তাদের একজনের নাম সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ। আর তাদের পরের স্তরের আরেক নেতা হলেন সাদী ওরফে আবু জান্দাল ওরফে আবু দারদা ওরফে আবু। আবু অস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগান দিয়ে থাকে। আবুই মূলত এ ছয় জনকে একত্রিত করেছে। এ ছয় জন মিলে একজন ওলামাকে হত্যার চেষ্টা করছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক গ্রেফতারকৃতরা ওই ওলামার বাড়িও ইতোমধ্যেই রেকি করেছে। পুরো হত্যাকা- সফল করার বিষয়েও গ্রেফতারকৃতরা একাধিকবার বৈঠক করেছে। জঙ্গীবাদবিরোধী অবস্থানের কারণে ওই ওলামাকে হত্যার টার্গেট করেছিল গ্রেফতারকৃতরা। গত বছর রোজার মধ্যে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার বর্ষপূর্তিতে নতুন করে নাশকতা করার জন্য সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছে জঙ্গী সংগঠনগুলো। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়েও গ্রেফতারকৃতরা মসজিদে আলাপ আলোচনা করেছে। আল-কায়েদা, আল-কায়েদা ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, আইএসসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন অনলাইনে রোজার মাসে তাদের ভাষায় যারা মুরতাদ, তাদের বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছে। আইএস বা আল-কায়েদার সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গীদের সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। তবে আদর্শিক সম্পর্ক থাকায় তারা সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে কাজ করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকায় জঙ্গীদের শক্তি কমে গেছে। জঙ্গীদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে গেছে। জঙ্গী সংগঠনগুলো নতুন করে সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণে তা সফল করতে পারছে না জঙ্গী সংগঠনগুলো। পুরনো সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা করতে তারা নাশকতা চালিয়ে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, নব্য জেএমবির ছয় সদস্যকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। নিউমার্কেট থানায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম শাখার উপপরিদর্শক (এসআই) মনিরুল ইসলাম তাদের সোমবার বিকেলে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম নূর নাহার ইয়াসমিন প্রত্যেককে তিন দিনের করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতে আসামিদের পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন না। অন্যদিকে চলমান অভিযানে রাজধানীর ডেমরার একটি বাসা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় নব্য জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের শরীয়াহ বোর্ডের আমীর শায়খ মামুনুর রশীদ ওরফে শায়খ মামুন (৩৪)। র‌্যাব জানায়, মামুন ২০০২ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার একটি কওমী মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস পড়াশুনা শেষ করে। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভারতের উত্তর প্রদেশে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মিরপুর হযরতপুর ১২ নম্বর পল্লবীতে হাদিস বিষয়ক গবেষণা করে। শায়খ মামুন কোরানে হাফেজ, হাদীস বিষয়ে পারদর্শী ও দক্ষ অনুবাদক। পেশাগত জীবনে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষক। ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৭ বছর ঢাকার সায়েদাবাদের বায়তুন নূর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। এরপর থেকে তিনি ডেমরার মারকাজুল হিকমা ওমর ফারুক কওমী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। শায়খ মামুন ২০১৪ সালে জেএমবির তৌহিদ ও ইমাম ওরফে দারা-কুতনির মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়ায়। ২০১৫ সালে জেএমবির সারোয়ার-তামীম গ্রুপে যোগদান করেন। ২০১৬ সাল থেকে শরীয়াহ বোর্ডের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শরীয়াহ বোর্ডে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য কাজ করেন। শরীয়াহ বোর্ড মূলত বিভিন্ন ভাষায় ম্যাগজিন ও গণমাধ্যমে উগ্রমতবাদ বিষয়ক লেখা বাংলায় অনুবাদ করে থাকে। অনুবাদ করা লেখা বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ, মজলিশে নানাভাবে প্রচার করা হয়। শায়খ মামুন আরবি ভাষায় প্রকাশিত উগ্রমতবাদের লেখা অনুবাদ করতেন। তার সঙ্গে সাজিদ নামে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারীদের একজনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। স্টাফ রিপোর্টার টাঙ্গাইল থেকে জানান, সারাদেশে চলমান অভিযানের ধারাবাহিকতায় রবিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি বেসরকারী ছাত্রাবাসে হানা দেয় পুলিশ। ছাত্রাবাস থেকে ১৩ হাত বোমা ও বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই উদ্ধার হয়। গ্রেফতার হয় টাঙ্গাইল জেলা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতিসহ ২৮ শিবির নেতাকর্মী। সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে টাঙ্গাইল সদর মডেল থানার ওসি নাজমুল হক ভুইয়া জানান, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সন্তোষ সেনানগর বাজারে অবস্থিত হাফিজুর রহমানের বাসায় কয়েকজন ছাত্র মেসে ভাড়া থাকত। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালালে হাতবোমা ও জিহাদী বইপত্রসহ ২৮ শিবির নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। দুপুরে আদালত গ্রেফতারকৃতদে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
×