ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রস্তাব ৯ মাসের মধ্যে কার্যকরের পদক্ষেপ

দ্রুত কর্মসংস্থান বাড়াতে চাইছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ জুন ২০১৭

দ্রুত কর্মসংস্থান বাড়াতে চাইছে সরকার

এম শাহজাহান ॥ কর্মসংস্থান বাড়াতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রস্তাব ৯ মাসের মধ্যে কার্যকর করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। শ্রম বাজারে প্রতিবছর ২০ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হচ্ছে ১৬ লাখ কর্মীর। বাকি ৪ লাখ শ্রমিকের বিদেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে। গত অর্থবছর শেষে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগের বাধাসমূহ অপসারণে সরকারী উদ্যোগ, সুদের নিম্নগতি প্রভৃতি কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে এসেছে। আর এ কারণে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে গতিশীলতা তৈরির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ার নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এদিকে, প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে। কর্মসৃজনের মাধ্যমে ভোগ চাহিদার ধারাকে সমুন্নত রেখে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আর তাই বাজেটে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৬ জারি করা হয়েছে। এ আইনের বিধানমতে বিনিয়োগ বোর্ড ও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের কার্যক্রম একীভূত করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) গঠন করা হয়েছে। বিডা ওয়ানস্টপ সার্ভিস আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইন অনুযায়ী একজন বিনিয়োগকারীর প্রয়োজনীয় আন্তঃমন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সকল সেবা কর্তৃপক্ষ নিজেই সম্পাদন করবে। এভাবে একটি বিনিয়োগ প্রস্তাব ৯ মাসের মধ্যে কার্যকর করা সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ, যেখানে সরকারী খাতের বিনিয়োগ ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমরা মোট বিনিয়োগকে জিডিপির ৩১ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। তিনি বলেন, শ্রম বাজারে ২০ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হচ্ছে প্রতিবছর। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের চাহিদা রয়েছে ১৬ লাখ। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান তৈরিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে বর্তমান অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন জোরদার হচ্ছে। জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের হিস্যা দিন দিন বাড়ছে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মূলধনঘন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৯৫ লাখ। এর আগের ২০১৩ সালের জরিপে এই সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। বিবিএস বলছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত দেড় বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ১৪ লাখ, যা নতুন কর্মসংস্থান বলে মনে করে বিবিএস। কিন্তু এ হিসাবে গরমিল আছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম বড় খাত। কিন্তু রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর গত চার বছরে এই খাতে খুব বেশি নতুন কর্মসংস্থান হয়নি। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তৈরি পোশাক খাত আর আগের মতো শ্রমঘন নেই। এসব কারখানায় মানুষের পরিবর্তে মেশিনের ব্যবহার বাড়ছে। দেশে ২৬ লাখ বেকার নতুন শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৬ লাখ। যদিও এই হিসাব নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে তুমুল বিতর্ক রয়েছে। তারপরও এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগও পান না। বেকারত্বের এই হিসাব আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) দেয়া মানদ- অনুযায়ী। আইএলও মনে করে, সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ না করলে ওই ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয়। তবে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, ৯ শতাংশ। এর মানে হলো স্নাতক কিংবা আরও উচ্চতর ডিগ্রীধারী প্রতি ১০০ জনে ৯ জন বেকার। এছাড়া কোন ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ বেকার। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি বেকার। ২০১৩ সালের ওই হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আবার এদেশের ৮৬ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। আর আনুষ্ঠানিক খাতে মাত্র ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ কাজ করে। দেশের কৃষি খাত এখনও কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। এ খাতেই প্রায় ৪৩ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়। আবার ২০ শতাংশ কাজের ক্ষেত্র হলো শিল্প খাত। এছাড়া সেবা খাতে প্রায় ৩৭ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। শ্রমশক্তি জরিপে বিবিএস বলেছে, গত দুই বছরে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। দুই বছরে শ্রমবাজারে পুরুষের অংশগ্রহণ তেমন বাড়েনি, যতটা বেড়েছে নারীর। এছাড়া তরুণদের বড় একটি অংশ বেকার। যারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত তাদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। এদিকে কর্মসংস্থান বাড়াতে প্রস্তাবিত বাজেটে আত্ম-কর্মসংস্থানের দিকে গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে সরকারীভাবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচীর মাধ্যমে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণে জোর দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে শ্রম বাজার সম্প্রসারণের জন্য বেশকিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারী পর্যায়ে শ্রম কূটনীতির প্রয়োগ নিশ্চিতসহ শ্রম বাজার অন্বেষণে বেসরকারী খাতকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
×