ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ইতিহাসে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর প্রথম জোড়া সেঞ্চুরি ॥ ঐতিহাসিক বিজয়

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ১০ জুন ২০১৭

বাংলাদেশের ইতিহাসে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর প্রথম জোড়া সেঞ্চুরি ॥ ঐতিহাসিক বিজয়

মিথুন আশরাফ কার্ডিফ থেকে ॥ ঝড়ের পর সব অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মিলে সেই অন্ধকার দূর করে দিলেন। শুধু দূরই করলেন না, দুইজনই সেঞ্চুরি করে বাংলাদেশকে ম্যাচই জিতিয়ে দিলেন। পঞ্চম উইকেটে সাকিব-মাহমুদুল্লাহর ২২৪ রানের রেকর্ড জুটিতে নিউজিল্যান্ডকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ইতিহাসই গড়ে ফেলল বাংলাদেশ। সাকিব-মাহমুদুল্লাহই ইতিহাস গড়লেন। শেষ মুহূর্তে সাকিব ১১৫ বলে ১১ চার ও ১ ছক্কায় ১১৪ রান করে আউট হলেও মাহমুদুল্লাহ ১০৭ বলে ৮ চার ও ২ ছক্কায় ১০২ রান করে অপরাজিত থাকেন। সমীকরণ ছিল এরকম, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বিদায় নেবে বাংলাদেশ। জিতলে সেমিফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে। তখন আজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া হারলে সেমিফাইনালে চলে যাবে বাংলাদেশ। ভাল কিছুই হলো। অসাধারণ কিছুই মিলল। ২০০৫ সালে যেমন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার নিউজিল্যান্ডকেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করে দিল। আজ অস্ট্রেলিয়া হারলেই বাংলাদেশ সেমিফাইনালে চলে যাবে। অসাধারণ বোলিং করলেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও তাসকিন আহমেদ। একাদশে পরিবর্তন করেই দুর্দান্ত বোলিং মিলল। প্রায় দুই বছর পর আবার চার পেসার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ বাজিমাতও করল। মেহেদী হাসান মিরাজ ও ইমরুল কায়েসের পরিবর্তে তাসকিন ও সৈকতকে নামিয়ে বোলিংয়ে ভাল ফলও মিলল। ফিরেই সৈকত ৩ উইকেট ও তাসকিন ২ উইকেট শিকার করে নিউজিল্যান্ডকে ২৬৫ রানে বেঁধেও রাখলেন। ৮ উইকেটে ৫০ ওভারে এ রান করল নিউজিল্যান্ড। যে নিউজিল্যান্ড একটা সময় ৩০০ রান করে ফেলবে ভাবা হচ্ছিল, সৈকত ও তাসকিনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ২৬৫ রানে আটকে রাখা গেল। কিন্তু বাংলাদেশের শুরুর দিকের ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ হলেন। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ মিলে পরে আশা দেখান। শুধু আশাই দেখান না, জয়ই তুলে নেন। দুইজন মিলে হাফসেঞ্চুরি করেন। সেঞ্চুরিও করেন। পঞ্চম উইকেটে নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ জুটিও (২২৪ রান) গড়েন। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় উইকেট জুটিতে করা মুশফিক ও তামিমের ১৭৮ রানের জুটিকেও পেছনে ফেলেন। দুর্দান্তভাবে এগিয়ে চলেন। খেলা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। একটা সময় জয়ও হাসিল করেন। নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ইতিহাসও গড়ল বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে কোন টেস্ট খেলুড়ে দলকে হারাল। তামিম ইকবাল টানা দুই ম্যাচে দারুণ ব্যাটিং করেছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯৫ রানের ইনিংস খেলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এসে রানের খাতা খোলার আগেই আউট হয়ে যান। ইমরুল কায়েসকে একাদশ থেকে বাদ দিয়ে সাব্বির রহমান রুম্মনকে তিন নম্বর পজিশনে খেলানো হয়। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ। সৌম্য সরকারও একই পথের পথিক। ১২ রানে তিন উইকেট হারিয়েই চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ যেমন পেস আক্রমণ দিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ভোগায়। নিউজিল্যান্ডও তেমন করেই গতি দিয়ে বাংলাদেশকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। তামিম, সাব্বির, সৌম্যকে অসাধারণ তিনটি ডেলিভারিতে আউট করে দেন টিম সাউদি। যখন মুশফিকুর রহীম ও সাকিব আল হাসান মিলে একটু হাল ধরার আশা জাগান, এবার এ্যাডাম মিলনে এসে মুশফিককে সাজঘরে ফেরান। ৩৩ রানে যখন ৪ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ, তখনই যেন সবাই বুঝে যায় ম্যাচ বাঁচানো বাংলাদেশের জন্য কঠিন। তাই স্টেডিয়ামে আসা দর্শকরাও বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করেন। সেইসব দর্শকরা ভুল করেন। সাকিব, মাহমুদুল্লাহ যে ছিলেন, তা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন তারা। তারাও যে ম্যাচ জেতানোর যোগ্যতা রাখেন, তা যেন ভুলেই গিয়েছিলেন। দুইজন মিলে ম্যাচ জেতান। ম্যাচ জিততে যখন ৯ রান দরকার এমন সময় সাকিব আউট হয়ে যান। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ ম্যাচ শেষ করে আসেন। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত (৭*) বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ম্যাচ শেষ করেন। নিউজিল্যান্ডের ইনিংস শেষ হতেই কিন্তু আশা জেগে যায়। বাংলাদেশ বোলাররা যে দারুণ বোলিং করেন। একাদশে পরিবর্তন এনেই গর্জে উঠে বাংলাদেশ। দুই পরিবর্তন করা হয়। সৈকত ও তাসকিনকে একাদশে নেয়া হয়। তাতেই বাংলাদেশের বোলিং বদলে যায়। দুর্দান্ত বোলিং করে দেখান সৈকত ও তাসকিন। তাতে আশাও জাগে। রস টেইলর (৬৩) ও কেন উইলিয়ামসন (৫৭) ছাড়া আর কেউ নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। আসলে সৈকত (৩/১৩) ও তাসকিন (২/৪৩) মেলে ধরতে দেননি। যখনই নিউজিল্যান্ডের কোন ব্যাটসম্যান ব্যাট হাতে বড় ইনিংস খেলার ইঙ্গিত দেন, তখনই হয় তাসকিন, নয়ত সৈকত এসে সেই ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরান। ৪৬ রানের সময় লুক রনকিকে ফিরিয়ে দেন তাসকিন। তাতে বাংলাদেশও যেন একটু শক্ত অবস্থান খুঁজে পায়। রুবেল হোসেন গাপটিলকে দ্রুত ফেরান। কিন্তু সেই অবস্থান খুব বেশিক্ষণ বজায় থাকেনি। উইলিয়ামসন ও টেইলর মিলে একটা বড় জুটি গড়ে ফেলেন। তাতে করে বাংলাদেশও চাপে পড়ে যায়। উইলিয়ামসন ও টেইলরের তৃতীয় উইকেটে গড়া ৮৩ রানের জুটি নিউজিল্যান্ডকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৫২ রানে গিয়ে হাফসেঞ্চুরি করা উইলিয়ামসন রান আউট হলে যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররাও হাফ ছেড়ে বাঁচেন। এরপর আবার আরেকটি জুটির দেখা মিলে। এবার টেইলর ও ব্রুম মিলে ৪৯ রানের জুটি গড়েন। যখন এ জুটি এগিয়ে যেতে থাকে, তখন মনে হচ্ছিল, ৩০০ রান হয়ে যাবে। কিন্তু এরপরই বাংলাদেশ বোলাররা চাপ তৈরি করতে থাকেন। টেইলরকে আউট করে দেন তাসকিন। ব্রুমকে সাজঘরে ফেরান সৈকত। ৪৪ ওভারের প্রথম বলে ২২৮ রানের সময় ব্রুমকে আউট করে তৃতীয় বলে কোরে এ্যান্ডারসনকেও ফিরিয়ে দেন সৈকত। বাংলাদেশকে পুরোপুরি ম্যাচেও ফেরান। কিছুক্ষণ না যেতেই জেমস নিসামকেও সাজঘরের পথ দেখান সৈকত। তখন যেন সবার ভেতরই উত্তেজনা কাজ করতে শুরু করে দেয়। মুস্তাফিজ শেষ মুহূর্তে ইয়র্কারে এ্যাডাম মিলনেকে বোল্ড করে দেন। শেষ পর্যন্ত সাউদি (১০*) ও সেন্টনার (১৪*) মিলে নিউজিল্যান্ডকে ২৬০ রানের ওপরে নিয়ে যান। বাংলাদেশ কিংবা নিউজিল্যান্ড, দুই দলই ম্যাচটিতে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে। খেলারই কথা। যে দল জিতত, তাদেরই যে সেমিফাইনালে ওঠার সুযোগ ছিল। হারা দল বিদায় নিত। তাই নিউজিল্যান্ড টস জিতে আর দেরি করেনি। ব্যাটিং নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য কী, তা স্পষ্ট বোঝা গেছে। আগে ব্যাটিং করে যত বেশি রান করা যায়। এরপর বাংলাদেশকে চাপে ফেলে হারানোর চিন্তা। কিন্তু বাংলাদেশের দুর্দান্ত বোলিং হিসেব করলে নিউজিল্যান্ড তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে পারেনি। বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে মাশরাফি বিন মর্তুজা ও সাকিব আল হাসান সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শুক্রবার কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে যে বাংলাদেশ ম্যাচটি খেলতে নামে, এই ম্যাচটি খেলতে নামতেই ১৭৬ ম্যাচ খেলা হয়ে যায় মাশরাফি ও সাকিবের। মোহাম্মদ আশরাফুলের খেলা ১৭৫ ওয়ানডে ম্যাচকে টপকে ফেলেন মাশরাফি ও সাকিব। এমন ম্যাচে সাকিব আবার টানা ১০ ওভার বলও করেন। ম্যাচটি এমন ম্যাচ, যেটাতে জিতলে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা জিইয়ে থাকত বাংলাদেশের। মাশরাফি ও সাকিবের এমন ম্যাচের দিনে নিউজিল্যান্ডকেও বিপদে ফেলা গেছে। হারানোও গেছে। দুইদিন টানা বৃষ্টি হওয়ায় আউটফিল্ড খেলার উপযোগী ছিল না। তাই এক ঘণ্টা দেরিতে খেলা শুরু হয়। তাতেও পুরো ৫০ ওভারেই খেলা হয়। নিউজিল্যান্ড তাদের ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৬৫ রান করতে পারে। সৈকত ও তাসকিনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে এ রানে নিউজিল্যান্ডকে আটকে রাখা যায়। বাংলাদেশ আশাও দেখে। সেই আশার ভেলায় শেষ পর্যন্ত ভাসেও। সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ মিলে ইতিহাস গড়েন। দলকে জেতান। সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্নও জিইয়ে রাখেন।
×