ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

জঙ্গীবাদের স্বরূপের সন্ধান এবং সমূলে উৎপাটনে করণীয়

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১০ জুন ২০১৭

জঙ্গীবাদের স্বরূপের সন্ধান এবং সমূলে উৎপাটনে করণীয়

(গতকালের পর) জামাতুল মুসলেমিন নামে এক জঙ্গী সংগঠন ২০০৭ সালে কার্যক্রম শুরু করে যা পরবর্তীতে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম নামে কার্যক্রম চালায়। এদেরকে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদের ইতিহাসে চতুর্থ পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এরা মূলত আল কায়েদার অনুসারী। আনসারউল্লাহ বাংলা টিম নামটি এরা নিয়েছে ইরাকী কুর্দীদের বিদ্রোহী অংশ আনসার উল ইসলাম থেকে। যদিও এরা আল কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী। তবে এরা আধ্যাত্মিক নেতা মানে ইয়েমেনভিত্তিক আল কায়েদার প্রধান আনওয়ার আলওয়াকিকে। সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এরা ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দলে টানার প্রচেষ্টা চালায়। এমনকি মসজিদকেও এরা মতাদর্শ প্রচারের কাজে ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের যুবকদের উগ্রপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলাফতী শাসন প্রতিষ্ঠা করা এদের উদ্দেশ্য, যার জন্য তারা এই দেশে দশ লাখ সদস্য সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এদের হামলার মূল লক্ষ্য হলো অসাম্প্রদায়িক, মুক্ত চিন্তার অনুসারী, ব্লগার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে এরা সাইলেন্ট কিলিং মিশন শুরু করে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ঐ বছরের আগস্ট মাসে বরগুনার একটি মসজিদে জঙ্গী হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনাকালীন সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ ত্রিশজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারপরও এদের দৌরাত্ম্য কমেনি। এরা একে একে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, সানিউর রহমান, অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রী, ওয়াসিকুর রহমান, নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, নাজিম উদ্দিন সামাদ, ফয়সাল আরেফিন দীপন, জুলহাস মান্নান, তনয়সহ আরও অনেকের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। এই জঙ্গী সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এদেশে জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের পঞ্চম প্রজšে§ আমরা দেখি নব্য জেএমবির উত্থান। ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ হামলার পরই গোয়েন্দা তদন্তে জানা যায়, নব্য জেএমবি নামের জঙ্গী সংগঠন কথিত জিহাদের নামে ২০১৩ সালে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে। তামিম মাস্টারমাইন্ড আর এ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা আবুল কাশেম ওরফে বড় হুজুর। জেএমবির আমির কারাবন্দী মাওলানা সাইদুরকে অস্বীকার করে জেএমবি থেকে বেরিয়ে আবুল কাশেম তামিমের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নব্য জেএমবি গঠন করে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নিয়ে আলাদাভাবে তৎপরতা শুরু করে। তাদের তৎপরতা যে কতটা নৃশংস ও ভয়াবহ তা প্রমাণ করে গুলশানের হলি আর্টিজানের অত্যন্ত হৃদয়বিদারক হামলা। জঙ্গীরা নয়জন ইতালি, সাতজন জাপানি, তিনজন বাংলাদেশী এবং একজন ভারতীয় নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ঐ হামলায় দুইজন পুলিশও প্রাণ হারিয়েছিল। এর দিন সাতেক পরেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে এরা হামলা চালিয়ে পুলিশসহ চারজনকে হত্যা করে। এরা বিদেশী নাগরিক, ধর্মযাজক, ব্লগার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সাধারণ মানুষদের হত্যা করার জন্য বিভিন্ন সময় হামলা চালায়। এদের অর্থায়ন করে ডা. রোকনউদ্দিন খন্দকার, তানভীর কাদেরী ও মেজর জাহিদুল ইসলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর জঙ্গী-বিরোধী অভিযানে একে একে তামিম, মেজর জাহিদ, মারজান, সারোয়ারসহ বেশ কয়েকজন প্রথমসারির নেতা নিহত হলে বেশ কিছুদিন নিষ্ক্রিয় ছিল এই সংগঠনটি। কিন্তু গত মার্চে ঢাকার আদালত থেকে হাজিরা দিয়ে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পথে টঙ্গিতে মুফতি হান্নানকে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে এরা। এর কয়েকদিন পর কুমিল্লার চান্দিনায় পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালিয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠার বিষয়টি জানান দেয়। ঐ মাসেই তারা আত্মঘাতী হামলা চালায় ঢাকায় এরা র‌্যাবের নিমার্ণাধীন সদরদফতরে ও বিমানবন্দর এলাকায় পুলিশ চেকপোস্টের কাছে, যা প্রমাণ করে নব্য জেএমবি এখনও সক্রিয়। আশার কথা নব্য জেএমবিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যে কোন সময়ই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের ইতিহাস পর্যালোচনায় যে পাঁচটি প্রজš§ তুলে ধরা হয়েছে, এরা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী সংগঠন যারা ভয়ংকর হামলা চালিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ করেছে এবং যারা আন্তর্জাতিকভাবে মদদপুষ্ট। এরা বাংলাদেশের স্থিতিশীল পরিবেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিন্তু ড. আবুল বারাকাতের তথ্য মোতাবেক একশ বত্রিশটির মধ্যে আরও যে একশ সাতাশটি জঙ্গি ও মৌলবাদী সংগঠন রয়েছে তারাও ফেলনা নয় কোনো দিক দিয়েই। এদেরকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। এরা ঐ জঙ্গি সংগঠনগুলোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ দিয়ে তাদের শক্তিকে বাড়িয়ে তুলছে। আবার নিজেরাও ফনা তোলার জন্য মুখিয়ে অপেক্ষা করছে কাক্সিক্ষত সুযোগের অপেক্ষায়। আরেকটি বিষয় হলো, সকল জঙ্গির একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে জেএমবি, নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতারা। কারণ তারা চাচ্ছে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে নৃশংসতর প্রক্রিয়া অবলম্বনের মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে এবং ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক খেলাফতী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যেমে দেশের উন্নয়নের গতিকে রোধ করে দেশকে মান্ধাতার আমলে নিয়ে গিয়ে তাদের পেয়ারে পাকিস্তানের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। ড. আবুল বারাকাতের মতে, ইতোমধ্যে তারা মাও সেতুংয়ের মতো গ্রামের পর গ্রাম দখল করে সেই কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। বিষয়টি উদ্বিগ্নের তবে আশাহত হওয়ার কারণ নেই এই কারণে যে, ঐক্যবদ্ধ বাঙালির সহজাত অসাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবিরোধী মনোভাব, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের নিয়ে গঠিত সরকারের ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও নির্মূলের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনোভাবের কারণে লাখো শহিদের রক্তের স্রোতধারায় অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম সোনার বাংলায় খেলাফতী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না। তাছাড়া বাংলার প্রতিটি ইঞ্চিতে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ছড়িয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যার নেতৃত্বে পাকিস্তানি ভাবাপন্ন রাজনীতিবিদদের ষড়যন্ত্রে হারিয়ে যেতে বসা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরে এসেছে মানুষের মাঝে। আজ বাংলার প্রতিটি আনাচে-কানাচে বেজে ওঠে, অনুরণিত হয় মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্যের সুর। মানুষের মাঝে সৃষ্ট হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দৃপ্ত শপথ। তাই মৌলবাদী জঙ্গিরা যতই চেষ্টা করুক না কেন তাদের প্রচেষ্টা যে বৃথা যাবে তা বলা যায় নিদ্বির্ধায় । চলবে... লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাবি
×