ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এগিয়ে যাবার বাজেট

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১০ জুন ২০১৭

এগিয়ে যাবার বাজেট

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ১ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় বাজেট ২০১৭-১৮ সংসদে উপস্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের এবারের বাজেটের আকার হলো ৪ লাখ কোটি টাকার ওপরে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বাজেট পেশকালে সংসদ সদস্যগণ টেবিল চাপড়ে অভিনন্দন জানান। আবুল মাল আবদুল মুহিতের এটি ১১তম বাজেট। বিএনপি আমলের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানও অনুরূপ সংখ্যক বাজেট দিতে পেরেছিলেন। তবে তাতে কোন গৌরব ছিল না। সাইফুর রহমানের সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ফাইভ প্লাস/মাইনাস। মুহিত সাহেবের পুরো সময়টাই ছিল সামনে এগোবার সিক্স-প্লাস। প্রবৃদ্ধি বাড়তে বাড়তে এখন ৭.২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যদিও এই হার প্রত্যাশার বিপরীতে কম। আমরা যদি পেছনে তাকাই দেখতে পাব ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জিডিপি ছিল ৭.৭ মতান্তরে ৯.২। এই হার অব্যাহত গতিতে বছর বছর উন্নীত হলে ১৯৯৬-৯৭ সালেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারত। জাতির দুর্ভাগ্য, তা হতে পারেনি। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধু যখন তার সোনার বাংলা গড়ার পথে এগোচ্ছিলেন ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করে জাতির সোনালি অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়া হয়। এখানটায় এলে অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যাচ্ছিল যেন। একটি বাজেট কেবল একটি সরকার পরিচালনায় আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়-এটি একটি দর্শন, যে দর্শনের মূল কথা হলো বাজেটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, তেমনি রাজনীতি সংস্কৃতি তথা মূলধারাকে বিকশিত ও অগ্রসরমান করা। যে মূলধারা বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর জন্য অনেক রক্ত, অনেক সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। সিপিডি থেকে শুরু করে বিদেশী অর্থে লালিত মতলববাদীরা বললেন, এই বাজেট অবাস্তব, হিসাবে মেলাতে না পেরে গোঁজামিল দেয়া হয়েছে, অবাস্তব উচ্চাভিলাষ এতে স্থান পেয়েছে। বিএনপির কাছে তো বাজেটই নয়, বরং ইলেকশনের আগে (২০১৯ সাল) মানুষকে ব্লাকমেইল করার বাজেট। অবশ্য এবার আর ‘গরিব মারা বাজেট’ জোর দিয়ে বলে না। কারণ, শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০১৭ তিন মেয়াদে বাংলাদেশকে উন্নয়নের এমন উচ্চতায় তুলে এনেছেন যে, গরিব জনগোষ্ঠীসহ দেশে তো বটেই বহির্বিশ্বের জন্য ঈর্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ আজ ভারত, চীনসহ অনেক সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এবারের বাজেটের আকার হলো ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এটাকে কেউ উচ্চাভিলাষী বলছেন। তারা জেনে ভান করেন না, না-জেনে বলেন জানি না। বাজেট তো উচ্চাভিলাষীই হবে নইলে উচ্চ প্রবৃদ্ধিই বা কিভাবে অর্জিত হবে, দেশই বা কিভাবে এগিয়ে যাবে? যে জাতি স্বপ্ন দেখে না বা যে জাতি বড় হতে চায় না তার ক্ষেত্রে হয়তো বাজেট হবে আয় করলাম খরচ করলাম ব্যস। কিন্তু তা না। বাংলাদেশের প্রথম বাজেট যা তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী এবং মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ যে বাজেট দিয়েছিলেন তার আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা মাত্র। হানাদার পাকিস্তানী জল্লাদদের ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়ে এর চেয়ে বড় বাজেট দেবার উপায়ও ছিল না। আর আজ ৪ লক্ষাধিক কোটি টাকা। আগেই বলেছি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে কিংবা দীর্ঘ একুশ বছর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসন না চললে আজ জিডিপির আকারই বলা হোক আর বাজেটের আকারই বলা হোক অনেক বড় হতে পারত। একটি জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে একজন মানুষের প্রয়োজন হয়, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল বলে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন বলেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ এবং আমরা উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি। নইলে বড় বড় কামান-বন্দুকঅলা কত এলো গেল, সঙ্গে সঙ্গে দেশটাকেও রসাতলে রেখে গেল। আর তাকে টেনে তুলে হাঁটাতে হলো শেখ হাসিনাকেই। তথাকথিত অর্থনীতিবিদ বা গবেষকরা এবারের বাজেটের ওপর সমালোচনা করতে গিয়ে বেশি দূর এগোচ্ছেন না। আগে হলে বলতেন বড় বাজেট দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। বেচারারা এবার তাও বলতে পারছেন না। তারা দেখছেন শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার কী সাহসের সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করলেন। বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতাপশালী মহাজনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যে নেতা মাথা উঁচু করে বলেন, ঝড় যিধঃ, বি ংযধষষ নঁরষফ রঃ ড়হ ড়ঁৎ ড়হি সড়হবু. এ বছরই পদ্মা সেতুর উন্নত শির জাতি দেখবে। ব্রিজটি কেবল একটি পারাপারের মাধ্যম বা স্থাপনা নয়, এটি একটি জাতির সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। কাজেই সমালোচকদের মুখে কুলুপ পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। আগেই বলেছি, বাজেট কেবল আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়- দর্শন। যদ্দুর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর। সেই সরকারের প্রথম বাজেট দেন শহীদ অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া। তাজউদ্দীন আহমদ থেকে কিবরিয়া, কিবরিয়া থেকে মুহিত- বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর মতো প্রথম দুইজনকে হত্যা করা হলো। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ঠেকানো গেল না। ঠেকানো যায় না। তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটের বাইরে (যদ্দুর মনে পড়ে) সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা গ্রামে পাঠানো হয়েছিল। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদি খাতে ঐ টাকা খরচ করা হয়। এতে বাজেটের অতিরিক্ত সাড়ে দশ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ গ্রামীণ অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করে তোলে। তখনও মহাজনরা বাধা না দিলে সরল মনে মেনে নেয়নি। অবশ্য তারা তখন আমাদের বাজেটের বিরাট অংশ শেয়ার করত বলে তাদের কেয়ার করতে হতো। শেখ হাসিনার সরকারের দর্শন ছিল বলেই এই বরাদ্দ দিতে পেরেছিলেন। তাছাড়া এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন বড় অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালানো যায় না। সেই যে গ্রামীণ অর্থনীতি ও জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করল (ইতিবাচক অর্থে), মাঝে দিয়ে ২০০১ থেকে ২০০৬ এবং ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বৈরী সময় না এলে আজকে যেই সমৃদ্ধি তা আরও বেশি বৃদ্ধি পেত। তারপরও বলব, এখন আর কি গ্রাম কি শহর মানুষ না খেয়ে থাকে না, কেউ এখন আর খালি পায়ে হাঁটে না, বেকারের সংখ্যা ‘মহান হবার মানসিকতা’ ছাড়া কোথাও নেই, গ্রামীণ জীবনে তো কৃষি শ্রমিক পাওয়াও দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও শহরের মতো জিনস-কেডস, সালোয়ার-কামিজ পরে স্কুলে যায়, ঘুরে বেড়ায়। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন পাল্টে দিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা কারও কারও কাছে ঠাট্টার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর আজ শহর তো শহর, গ্রামের ছেলে-বুড়ো প্রায় সবার হাতেই সেলফোন, কারও কারও হাতে ট্যাব, কিছু কিছু বাড়িতে ল্যাপটপ রয়েছে। এখন গ্রাম থেকেই ছেলেমেয়েরা অনলাইনে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরির দরখাস্ত করতে পারে। মানুষের গড় মাথাপিছু আয় ১৬০২ মার্কিন ডলার, গড় আয়ু ৭০-এর ওপরে আমরা এগিয়ে চলেছি। এবারের বাজেটে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা শোনা গেছে ভ্যাট আর ব্যাংক আমানতের ওপর শুল্ক ধার্য করা নিয়ে। ব্যবসায়ীদের দাবি ছিল ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমানো। তা কমানো হয়নি, অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ব্যাংক আমানতে এক লাখ টাকার ওপর বছরে ৮০০ টাকা কাটা হবে ঐ এ্যাকাউন্ট মেনটেন করার জন্য। বস্তুত আগেই ছিল ৫০০ টাকা, তার সঙ্গে ৩০০ টাকা যোগ হয়েছে। এতে মধ্যবিত্তের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে আভাস দিয়েছেন মাত্র তো বাজেট দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা হবে, সমালোচনা হবে, মানুষের সুপারিশ আসবে, তখন দেখা যাবে। অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেবার ইঙ্গিত। এ দেশের রাজনীতিতে পেছন পেছনে দৌড়ানো বিএনপির বক্তব্য হলো সরকার নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী বাজেট দিয়েছেন। এ বাজেটের সময়কাল জুন ২০১৮, তারপরই ২০১৯-এর প্রথম অথবা ’১৮-এর শেষের দিকে নির্বাচন হবে। বিএনপি মনে করে সরকার নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য এত বড় অঙ্কের বা আকারের বাজেট দিয়েছে। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার নয়। সাহস, সামর্থ্য, দক্ষতা আছে বলে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ কী ‘সংসার বিবাগি’ কোন দল যে অন্যের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে? তারা তো চাইবেই আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে। এবং আসবেও। এর চেয়ে বড় বড় বাজেট দেবে। সে জন্য দলটি রাজনীতির পাশাপাশি জাতীয় বাজেটের মতো জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করবেই। তাছাড়া এদেশের জনগণ তো জিয়া-এরশাদ-খালেদার শাসন দেখেছে? তারা কি পেরেছে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে? খালেদা জিয়া তো ১৯৯১-৯৬ সময়ে এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদ শেষে যথাক্রমে ৪০ এবং ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি রেখে গিয়েছিল। সারের জন্য কৃষক গুলি খেয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। আজ আর সার-বীজ-কীটনাশকের জন্য মানুষকে এখানে ওখানে দৌড়াতে হয় না। এখন খাদ্যোৎপাদন ৪ কোটি টন। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া বিদ্যুত উৎপাদন এরশাদের রেখে যাওয়া ৪২০০ মেগাওয়াটও ধরে রাখতে পারেনি। আর আজ উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ হাজার মেগওয়াট। কেবল তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শেখ হাসিনা যেমন দেশ ও জাতিকে পাপমুক্ত করেছেন, তেমনিভাবে জঙ্গী দমন করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সাংস্কৃতিকভাবে দেশ এগিয়ে চলেছে। কেউ কেউ হেফাজতকে টেনে তাকে ও তার সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান। কিন্তু জনগণ দেখেছে কিভাবে ২০১৩-র ৫মে সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছেন। এবারের বাজেটের পরপরই ভিশন ২০-২১ অর্থাৎ ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্র্তি বা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করে নতুনভাবে শক্তি সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাবেন এবং ৫+৫=১০টি জাতীয় বাজেট দিয়ে এক উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দেবেন। ঢাকা ॥ ৮ জুন ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×