ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

তরুণ লেখকদের সাহিত্য ভাবনা ॥ চর্যাপদ’র ভূমি ॥ কবিতা জীবনকে আঁকতে পারা একজন ভ্যান গগ

প্রকাশিত: ০৭:০০, ৯ জুন ২০১৭

তরুণ লেখকদের সাহিত্য ভাবনা ॥ চর্যাপদ’র ভূমি ॥ কবিতা জীবনকে আঁকতে পারা একজন ভ্যান গগ

আমাকে প্রতিনিয়ত ঘিরে রাখে মেঘ, আমাকে অবিরাম স্পর্শ করে যায় জ্যোৎস্নামেয়েরা। আমি তীব্র রোদে পুড়তে থাকি, ভিজে জবজবে হতে থাকি আষাঢ়ের বৃষ্টিতে। যে আনন্দ মনের ভেতরে জমা থাকে, যে কষ্ট অনুভব করি রন্ধ্রে রন্ধ্রে-অথবা যে অনুভূতি না বোধ্য, না অবোধ্য-আমার কবিতার শব্দমালা সেসব বোধে ও আরাধ্যে, অনুভব ও অবচেতনে প্রকাশ করার দুঃসাধ্য এক চেষ্টায় থাকে। পৃথিবীর বিচিত্র পথে বিচিত্র উপকরণ আমি কবিতার জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরি। ক্লান্ত বলিরেখা, পদতলে পৃষ্ঠ পাতারা, কোমল উচ্ছ্বাস, জলের নামতা-কোনো কিছুই দু’চোখের দৃষ্টি এড়ায় না। পথে পথে ঘুরে আমি সযতনে স¯েœহে এসব উপকরণ মনের সাথে জড়িয়ে নেই। রাঙিয়ে রাখি ধ্বনি ও বর্ণমালায়। কবিতাকে যতই আমি রাঙাতে চাই, যতই প্রকাশ করতে চাই সুন্দর ও ঐশ^র্যেÑকিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেখি কবিতাই বারবার আমাকে রাঙায়, আমাকে সুন্দর করে তোলে। একটি কবিতাকে লেখার জন্যে কত কত কবিতা লিখেছি, কত পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, শব্দের পর শব্দের নহর বয়ে গেছেÑঅথচ সেই কবিতাটি লেখা হয়ে উঠেনি। আদৃত কবিতাটি লেখার জন্যে প্রতিদিনই আমি ধ্যানস্থ হয়ে বসি, সম্মুখে বকসাদা কাগজ, নিদ্রাহীন কলমÑলিখতে থাকি আর ভেসে যেতে থাকি অন্য কোনো এক ধূসর জগতে। সেখানে পৌঁছে দেখি কবিতা তো এক চিরহরিৎ বৃক্ষের নাম, শতপদী বৃক্ষÑযে বৃক্ষছায়া শীতল করে দেহ, মন মাতিয়ে রাখে শব্দের সৌরভেÑ যে বৃক্ষ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী, সবচেয়ে করুণও। তাকে না ধরা যায়, না তার কাছ থেকে দূরে সরা যায়। কবিতা আমাকে ঘাসের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখেÑআর আমি দাঁড়িয়ে থাকি আকাশ স্পর্শ করে সীমাহীন...। ...কবিতাÑগহীনের অনুভব, কবিতা জীবনকে আঁকতে পারা একজন ভ্যান গগ! ** দেহভিটা কথকের দাঁতে তোমার হাসিগুলো গেঁথে আছে স্থির যতœবান উইপোকাও শুনেনি সেইসব রাতের শীৎকার যারা নুয়ে পড়েন অজ¯্র চেরীফুলের স্বপ্ন নিয়ে অথবা রোদ হতে চাইতেন যেসব প্রেমিকযুগল তাদের মৃত্যুতে জ্যোৎ¯œারা আসেনি; কেবল শীতল উন্মাদের মতো বৃষ্টির ট্রেনে ভেসে এলো মুমূর্ষু গ্রাম, আততায়ীর রক্ত! তখনো আলোর ফুৎকারে রাত হয়নি দেহভিটায় আঁতকে উঠেনি হাবিয়ার কষ্টেরা... তখনো আকাশ চিরে মাঝিরা জাগেনি কেবল তুমিই প্রথম জেনেছিলেÑ দিনেরা বেঁচে নেই। খুন হয়েছে নিঃশ্বাসগুলি... ** রোদের গল্প রোদ যতটুকু পালিয়ে যেতে চায় বনে মেঘ তাকে ঘিরে রাখে ততোটুকু মায়ায় আমাদের রোদ ও মেঘ কিছুই নেই মাথার উপরে যে আকাশ দ্বিধাগ্রস্ত দাঁড়িয়ে আমরা হাত বাড়িয়েও তাকে ছুঁতে পারি না। আমরা অমলকান্তির মতো রোদ হতে প্রার্থনা করি প্রেমের চৌচির মাঠে দাঁড়িয়ে মেঘ হতে আরতি করি আমরা প্রার্থনা করি নূহের মতো দিগন্তব্যাপী প্রলয়ে জীবন থেকে কিনেছি জীবন, কিনেছি তীব্র দাহ-সন্তাপ যতটুকু পালিয়ে যাই সবুজ বৃক্ষের দিকে, রৌদ্র ছুঁতেÑ ততটুকু পোড়ে শরীর ততটুকু উত্তাপে। ** জ্যোৎ¯œার প্রতিবেশী রোদে শয্যা পেতে জেগে আছি যা ছিলো ভুল, যা দহন পুড়ে যায় তীব্র কিরণে, অনর্গলÑ ঝরে ঝরে পড়ে নূপুরের দোল ভেসে যায় পাখিদের পালক, নৈঃশব্দে যা ছিলো নদী, যা রমণ মুছে থাকে দুপুর জানালায়, প্রতিদিন; খসে পড়ে বসন ছাই ওড়ে প্লাবিত দেহে যা ছিলো প্রেম, যা শঙ্খবালা নিভে যায় প্রেম গোপনে, বড় ব্যথাভরা দিনেÑ রোদে শয্যা পেতে তবু জেগে আছি যা ছিলে তুমি, যা আমি জ্যোৎ¯œার প্রতিবেশী পাশাপাশিÑপুরনো রাতে! ** পা ফেলে এসেছি রোদের উপর নিজেকে রেখে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকি দূরে দেহসমেত পার হলাম কত পোড়া জমি, বসন্তহীন পৃথিবী আমি তখনও বলেছিÑ শান্ত হওÑ মৃত্যুর মতো স্থির; আমার আত্মা আর ঝড় আঁকেনি তরুণী ঠোঁটে হাসিমুখ ছড়িয়ে দিয়েছি উঠানে, বধির বৃষ্টিতে আমি ঈশ্বরে রেখেছি বাজি, জীবন দাও, জীবনের নহর যায় বয়ে! পা ফেলে এসেছি রোদের উপর, সেই যৌবন মেখে তোমার মন তো কবেই রাখা ইসরাফিলের ফুৎকারে, ফুঁ দাওÑ এবং দেখ, ধ্বংস ও পতন জলে স্নান শেষে আত্মার বাইরে দেহ আমার, দাঁড়িয়েছে দেখ! ** পাখিরা সব উড়ে গেছে পাখিরা সব উড়ে গেছে দূরে গ্রাম ছেড়ে আকাশের নীল ঘুড়ি ন্যাংটো ঘুরছে শো শো, বাতাসে আধুনিক বালকের দু’হাত ভরা রক্ত, প্রাণহারা শৈশবে ওড়ছে মাছি ভনভন, ঘুম ভেঙে যায় সাইরেনেÑ চোখ পেতে দেখি অজস্র কাক, লাশের মিছিলে বেঘোর ঘুমোচ্ছে পুতুলখেলা, ভালোবাসার দিন- তখনো ঝুমঝুম নূপুর বাজে পতিতার পায়ে, সাজে কথারা গায়ে নিয়ে বিভ্রম শাড়িÑপার্লার দেখে বাড়ি ফিরে গেছে যাবতীয় কোমল মুখ আর নাটোরের বনলতা সেন। ফিরে আসি ইটের নগরে, ফিরে যাই গ্রামে দেখি, পাখিরা সব উড়ে গেছে গ্রাম ছেড়ে দূরে, বহুদূরে...
×