ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

মনের অতলে...

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ৯ জুন ২০১৭

মনের অতলে...

মানুষের দেহে মন সবচেয়ে রহস্যময় একটি বিষয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন সবখানেই মন একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে; কারণ মানুষকে জানতে, বুঝতে ও সুস্থ রাখতে মনকে জানার একটা প্রয়োজনীয়তা আছে কিন্তু বিজ্ঞান সব শাখায় অভূতপূর্ব উন্নতি করলেও মানুষের মনকে জানতে এখনও অনেকটাই অপারগ। কিন্তু প্লেটো, এরিস্টোটল থেকে শুরু করে দেকার্ত, হবস, ইয়াং, ফ্রয়েড, লাকা অনেক বিশ্বখ্যাত দার্শনিক মন সমন্ধে জানার জন্য নানামুখী তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে গেছেন; তাতে মনের ব্যাপারে বেশকিছু জানা গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনকে পুরো জানার চেষ্টা থেকে গেছে অনুৎঘাটিত। প্লেটো, এরিস্টোটল প্রমুখ দার্শনিকরা মনকে বা আত্মাকে আধ্যাত্মিকরূপে কল্পনা করেছেন। ভারতীয় দর্শনে মনকে মানবদেহের অবিনাশী রূপ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে ভারতীয় দার্শনিকের মতে আত্মা দেহ ও মনকে চালিত করে। মনের একটা গুণ রূপে চৈতন্যকে গণ্য করা হয়। দেকার্তের মতে মন একটি অনুভবের বিষয়। তার বিখ্যাত উক্তি ঈড়মরঃড় বৎমড় ংঁস বা ও ঃযরহশ ঃযবৎবভড়ৎব ও ধস দেকার্তের মতে বস্তু চিন্তা করতে পারে না তাই তার অস্তিত্ব জড় আর মানুষ চিন্তা করতে পারে তাই সে অস্তিত্বনির্ভর। দেকার্তের মতে চেতনাই জীবন। লকের মতে মন চিন্তা শক্তি, অনুভব ও ইচ্ছা শক্তি কেন্দ্রিক। বার্কেলও মনকে আধ্যাত্মিকরূপে দেখেন। তার মতে আমরা মন দেখতে পারি না শুধু এর ধারণা পেতে পারি। তবে ফ্রয়েড মন ও মনঃসমীক্ষণের ব্যাপারে সবার চেয়ে বেশি কাজ করেছেন এবং যুগান্তকারী কিছু তত্ত্ব দিয়ে গেছেন যাকে ভিত্তি করে মন নিয়ে নানা গবেষণা এখনও চলছে। একটা প্রশ্ন যদি করা হয় মন আমাদের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে না আমাদের দেহ মনকে? একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে- ধরুন আমি বাসা থেকে হেঁটে দোকানে গেলাম এখানে আমার দেহটাই মূল ব্যাপার আপাতদৃষ্টিতে, কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখতে পারব প্রথমে আমাদের মনে একটা চিন্তন আসে সেটা থেকে সিদ্ধান্ত এবং পরিশেষে মনই আমাদের দেহকে নির্দেশ দেয় দোকানে হেঁটে যাবার জন্য তাই দোকানে যাওয়া যতটা শারীরিক ততটাই মানসিক। শরীর খারাপ থাকলে মন খারাপ থাকে আবার বিপরীতভাবে মন খারাপ থাকলে শরীর। দোকানে হেঁটে যাওয়াটা ঘটছে মনের যে স্তরে তাকে আমরা বলি সচেতন স্তর কিন্তু বিশ্লেষকরা দেখেছেন মনের শুধু সচেতন স্তর নয় এর আরও অনন্য স্তর রয়েছে। যেমন- অচেতন, অর্ধচেতন ও নির্জ্ঞান স্তর। মন আর চেতনা কি এক জিনিস? দেকার্ত, লক প্রমুখ দার্শনিক চেতনা আর মনকে এক মনে করতেন কিন্তু বর্তমানে অনেক দার্শনিকের মতে তা ভুল। মন ও চেতনা সমব্যাপক নয়। চেতনাকে বিভিন্নভাবে স্তরায়িত করা হয়েছে যেমনটা আগে বললাম। চেতনা হলো মনের এক ধরনের বোধ বা অবগতি। চেতনা চিন্তা অনুভূতি, ইচ্ছা ইত্যাদি উৎপত্তি করে। ল্যাডের মতে ঘুমের পরবর্তী অবস্থা হচ্ছে চেতনা। চেতনা মনের গভীরের একটি অবস্থা। দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মন অনেক কিছুকে ধারণ করে তার মাঝে চেতনা, স্মৃতি, ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা, আত্মদর্শন, চিন্তা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। মানুষ সৃষ্টির সেরা তার বুদ্ধি, চিন্তা, চেতনা রয়েছে আর এটি মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মানুষের বেশকিছু জৈবিক চাহিদা রয়েছে। এগুলো পূরণ করার জন্য মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়াকলা করে থাকে এবং মানুষ নানা ধরনের আচরণ করে থাকে। জৈবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা, তৃঞ্চা, ঘুম, যৌনতা ও রেচন প্রভৃতি। এ চাহিদাগুলো যখন পূরণ হয়ে যায়, তখন মানুষ মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নানারকম কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। এভাবে মানুষ কখন কেন জৈবিক আচরণগুলো করে এবং তারপর কখন কীভাবে কেন সে মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগুলো করা শুরু করে তা জানার জন্য মনঃবিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। মানুষ কখন কেন জৈবিক আচরণগুলো করে এবং তারপর কখন কীভাবে কেন সে মানবিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আচরণগুলো করা শুরু করে, তা জানার জন্য যে মনোবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ, সেটি মানবিক পদক্ষেপ (ঐঁসধহরংঃরপ অঢ়ঢ়ৎড়ধপয) হিসেবে সুপরিচিত। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জৈবিক চাহিদাগুলো পূরণ করেই মানবিক বৈশিষ্ট্যের দিকে অগ্রসর হওয়া। সাংস্কৃৃতিক চর্চা, বৈজ্ঞানিক চর্চা, দার্শনিক চর্চা, সাহিত্য চর্চা, গল্প করা, আয়েশ করা প্রভৃতি মানবিক পদক্ষেপজনিত আচরণ। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রেমপ্রীতি, স্নেহ, ভালবাসা, মমতা ও প্রশান্তি, প্রভৃতি ধনাত্মক বিষয়গুলো বিকশিত হয় এবং ক্রোধ, হিংসা প্রভৃতি ঋণাত্মক বিষয়গুলো দূরীভূত হয়। তবে জৈবিক চাহিদা পূরণ না হলে মানুষ মানবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য অগ্রসর হতে চায় না। যেমন, যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে রয়েছে সেখানে সঙ্গীতচর্চা, বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। আবার সবকিছু পাবার পরেও মানব মন অস্বাভিক আচরণ করতে পারে এগুলো কেন ঘটে তা জানার জন্য বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিকরা বিভিন্নভাবে মানুষের মন নিয়ে শতশত বছর ধরে গবেষণা করে যাচ্ছেন। তবে আশ্চর্যের বিষয় মন মানুষের দেহের কোন জায়গায় থাকে তা আজ অবধি জানা সম্ভব হয়নি। তবে আধুুনিক বিজ্ঞানীদের মতে মস্তিষ্কই মনের প্রধান স্থল; হৃদয় নয়। আমাদের যে মন আছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের শরীর কারণ আমাদের শরীর খারাপ হলে মন খারাপ হয় আবার নানা রকমের রোগ যেমন হিস্টিরিয়া, দুশ্চিন্তা, বিষাদময়তা, অস্থিরতা, নিউরোটিক আচরণ বা উদ্বায়ুরোগ ইত্যাদি থেকে বোঝা যায় মন একটি গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক অবস্থা। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রখ্যাত ফরাসী চিকিৎসক ও ¯œায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ শার্কো ফ্রয়েড যার ছাত্র ছিলেন তারা দেখলেন এবং এই ব্যাপারে উৎসাহী হলেন যে মানুষের বিভিন্ন মানসিক রোগ থেকে মানুষের মনের ব্যাপারে জানা যাবে। শার্কো সেই সময়ের বিখ্যাত মনোরোগ চিকিৎসক কিন্তু তার কাছে কিছুদিন থেকে ফ্রয়েড দেখলেন যে তার যে চিকিৎসা পদ্ধতি সম্মোহনবিদ্যা তাতে অনেক ত্রুটি রয়েছে তাই ফ্রয়েড অন্য পথে হাঁটলেন। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে শার্কো ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণের পথিকৃত ছিলেন আর ফ্রয়েড ছিলেন অমিত প্রতিভার অধিকারী আর কাজে নিরলস। এর আগে প্লেটো মনের তিনটি আকাক্সক্ষার ব্যাখ্যা করেছিলেন। প্রথমত তিনি বলেন, মানুষের মনের প্রথম ইচ্ছা তার প্রবৃত্তির নিবৃতি করা; দ্বিতীয়ত, তার সংরক্ষণীল মনোভাব এবং তৃতীয়ত জানার ও সত্যর প্রতি আগ্রহ। প্রথমটি দিয়ে তিনি বোঝাতে চান মানুষ চায় সে অবশ্যই তার প্রয়োজনীয়তা নিবারণ করা যেমন খাওয়া, পান, বংশবৃদ্ধি, আশ্রয় এবং দেহের সুস্থতা রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত, এই ক্ষেত্রে মানুষ কাজের তাড়না, রাগ, সাহস, মূল্যবোধ দেখানো ও অনিয়ম ইত্যাদির প্রতি প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখায়, তৃতীয় যে মনের আকাক্সক্ষার কথা বলেন তা হলো- মানুষের মন বুঝতে চায় ও সত্যের অনুসন্ধান করে। অপরদিকে, মানুষের মনের বিভিন্ন আবেগ, অনুভূতি, না বলতে পারা কথা, বিস্মৃতি ফ্রয়েডের গবেষণার বিষয়বস্তু হলো। মানসিকভাবে অস্থিতিশীল ব্যক্তিরা নানা কারণে তাদের আসল সমস্যার কথাটি প্রকাশ করতে পারে না- ফ্রয়েড বলেন মানুষ বিভিন্ন কারণে নানা কথা ভুলে যায়; যেমন কেউ তার প্রেমিকার বাড়িতে গেছে আসবার সময় তার ঘড়িটা ফেলে আসল এটা ঘটে কারণ সেই মানুষটির মনের একটি অংশ তার প্রেমিকার বাড়িতে আবার যেতে চায় তাই সে নিজের অজান্তে কিন্তু সেই ভুলোমনের ইচ্ছেতেই সেই ঘড়িটি তার প্রেমিকার বাড়িতে রেখে আসে। আবার অনেকে অতীত গ্লানীময় স্মৃতি মনে আনতে পারে না এটি সে করে না তার আসংজ্ঞান মন বা ঢ়ৎব-পড়হংপরড়ঁং এটা ঘটায় কারণ সে তা মনে করলে মানসিকভাবে অতৃপ্ত হয়ে পড়বে। ফ্রয়েড বিরেচন পদ্ধতি বা ঈধঃযধৎঃরপ গবঃযড়ফ এর মাধ্যমে এর সমাধান করতে চাইলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেন। গবেষক ব্রয়ারও ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখেন। ব্রয়ার লক্ষ্য করেন মানসিক রোগীরা রুদ্ধ আবেগ, অবদমিত ইচ্ছা, প্রকাশ করতে না পারা অনুভূতির কারণে মানসিকভাবে ভারসাম্য হয়ে পড়েন। অনেক রোগী আছে সে মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে কিন্তু সে নিজে জানে না তার মানসিক কোন ব্যাপারটি তাকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে; সেক্ষেত্রে ওষুধ নয় রোগীকে মানসিকভাবে সাহায্য করে তার রোগ মুক্তি ঘটাতে হবে। একজন হয়ত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল; কোন এক ঘটনা তাকে অস্থির করে তুলছে কিন্তু সে তার এই ব্যাপারটিতে পুরোপুরি অজ্ঞাত। হয়ত অসুস্থ হবার আগে তার কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিল- তার ভাইয়ের সঙ্গে তার ঝগড়া হয়েছিল, সে একজনের সঙ্গে প্রতারণা করেছিল, তার মেয়ে অসুস্থ, তার অফিসের অনেক কাজ পড়ে আছে এগুলোর কোন একটা বা সবগুলো তার মনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। রোগী কিন্তু মানসিক উৎকণ্ঠা ও জটিলতায় ভুগছে কিন্তু নিজেই জানে না তার এই সমস্যার মূল কারণ কী। এক্ষেত্রে রোগীর প্রতিটি বিষয় রোগীকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে এবং ওষুধ নয়- তাকে মানসিকভাবে সহযোগিতা করে তার রোগ থেকে তাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। চংুপযরপধষ গবপযধহরংস ড়ভ ঐুংঃবৎরপধষ চযবহড়সবহধ গ্রন্থে ব্রয়ার ফ্রয়েড যুগ্মভাবে এই চিকিৎসা পদ্ধতির কথা প্রকাশ করেন। ফ্রয়েড দেখলেন রোগী তার সামাজিক, নৈতিক, পারিপার্শ্বিক কারণে তার অনেক বিষয় অবদমন করে রাখে হয়ত সজ্ঞানে অথবা অবচেতনে (ফ্রয়েড অবশ্য অবচেতন শব্দটি ব্যবহার করতেন না) এতে রোগীর চিকিৎসা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। ফ্রয়েড আরও দেখলেন সম্মোহন, বিরেচন, স্মৃতি জাগানিয়া এই প্রক্রিয়ায় রোগীর সাময়িক রোগমুক্তি ঘটে কিন্তু রোগী পুরোপুরি সুস্থতা পান না রোগটি আবার কোন এক সময় ফিরে আসে। ফ্রয়েড রোগীকে তার অতীতের সব ঘটনা বর্ণনা করতে বললেন তা যে ঘটনাই হোক। সামান্য, অসামান্য, গুরুত্বহীন, লজ্জার, ভয়ের, অপরাধের তার ব্যক্তিগত কর্ম ও চিন্তায় ঘটে যাওয়া সব বিষয়কে ফ্রয়েড অবাধভাবে রোগীকে বলতে বলতেন। তিনি রোগীকে একটি অল্প আলোকিত, রুদ্ধ ঘরে নিয়ে শরীর ও মন শিথিল করতে নির্দেশ দিতেন বাইরে থেকে যাতে কোন শব্দ বা উদ্দীপক তার মনে রেখাপাত না করে তার ব্যবস্থা করতেন। রোগী এই সময় প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, সামাজিক-অসামাজিক, প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক, শ্লীল-অশ্লীল, কোন কথা বলা বাদ দেবেন না। তিনি মনে যা আসবে নির্বিচারে বলে যাবেন। রোগী অবাধ স্বাধীনতায় তার মনের সব কথা বলতে বলতে রোগী তার মনের অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত হতো, নির্ভার হতো এবং ফ্রয়েড রোগীর মনের মাঝে যে সমস্যাগুলো তা বের করে আনতে সক্ষম হতেন। এটা এক ধরনের এনার্জি হিলিং এতে রোগীর মানসিক বোঝা লাঘব হয়ে রোগী ধীরে ধীরে শারীরিক শিথিলতা অনুভব করে ও মানসিক ও শারীরিকভাবে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে থাকে। ফ্রয়েড এইভাবে যে চিকিৎসা শুরু করলেন এতে সম্মোহনের কোন ব্যাপার নেই, লুপ্ত স্মৃতি পুনরুদ্ধারের কোন শ্রমসাধ্য চেষ্টা নেই। এখানে থাকে রোগীর অবাধ স্বাধীনতা, সে যা মনে আসে, তাই বলে যেতে পারে; ফ্রয়েড এই পদ্ধতির নাম দিলেন অবাধ-ভাবানুষঙ্গ পদ্ধতি (ঋৎবব-ধংংড়পরধঃরড়হ সবঃযড়ফ)। পরবর্তীতে এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত ফ্রয়েড এই পদ্ধতিকেই মানসিক রোগ চিকিৎসার প্রধান পদ্ধতি বলে গণ্য করতেন এবং নতুন একটি তত্ত্ব দাঁড় করালেন; যাকে পরবর্তীতে মনঃসমীক্ষণ বলা হলো এবং আধুনিক কোয়ান্টাম মেথড ও ক্লিনিকাল সাইকো থেরাপি ফ্রয়েডের এই ধারার ফল। ফ্রয়েড যখন তার মনঃসমীক্ষণের মতবাদ দেন সেই সময়টাকে নিউটনের যুগ বলা যায় ওই সময়ের বেশিরভাগ গবেষণা নিউটন দ্বারা প্রভাবিত; ফ্রয়েডও হয়ত তার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। নিউটন দেখালেন প্রতিটা কাজের পেছনে শক্তি নিহিত। নিউটনের সূত্র মতে একটি শরীরে যদি তাপ কমে যায় তবে অন্য একটি শরীরে তা স্থান্তরিত হয়। তাই ফ্রয়েডও মানসিক শক্তি (ঢ়ংুপযরপ বহবৎমু) নামক একটি ক্রিয়া শক্তির কল্পনা করেছিলেন। প্রত্যেক মানসিক চাহিদার সঙ্গে একটি মানসিক শক্তি যুক্ত এই হচ্ছে এই তত্ত্বের মূল কথা। একজনের মনে যদি কোন প্রকারের মানসিক শক্তি বা ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা পুঞ্জিভূত হয়ে পড়ে তা নানাভাবে লক্ষণ প্রকাশ করে এর একটি হচ্ছে রোগলক্ষণ ; রোগ এভাবে মানসিক চাহিদাকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত করে। তাই ফ্রয়েড মানসিক শক্তির সঠিক বণ্টনের উপর জোর দিয়েছিলেন। ফ্রয়েড যে জন্য বিশ্বখ্যাত ও প্রয়োজনীয় হয়ে আছেন তা হলো মানুষের প্রবৃত্তির বর্ণনা চেষ্টার কারণে। তার তিনটি ‘আধ্যাত্মিক যন্ত্রপাতি’- বর্ণনা হলো ‘ইড’(ওউ), ‘ইগো’(ঊমড়) এবং ‘সুপারইগো’ (ঝঁঢ়বৎ-বমড়)। ফ্রয়েডের মতে আমাদের নির্জ্ঞান মন দুভাগে ভাগ করা যায় একটি আমাদের প্রবৃত্তি আর একটি আমাদের অবদমিত কামনা বাসনা এই নির্জ্ঞান স্তরের নাম তিনি দেন ‘ইড’(ওউ)। ইউরোপ জুরে তার তার যে ধারণাটি বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে তা হলো মানুষ তার অবদমিত ইচ্ছাকে প্রকাশ করতে না পেরে বা অবদমন করতে করতে এক সময় মানসিক ও শারীরিকভাবে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে- অতিমাত্রায় অবদমন মানুষকে এমনকি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন করে তুলতে পারে। অবাঞ্ছিত কামনা বাসনা আমরা নির্জ্ঞান স্তরে পাঠিয়ে দেই। কামমূলক যে প্রবৃত্তি তাকে ফ্রয়েড বলেন ইরোস (ঊৎড়ং) বা ফবংঃৎঁপঃরাব রহংঃরহপঃ এ দুটিকে একত্রে ফ্রয়েড বলেন ‘ইড’ (ওউ)। আর সচেতন যে মানসিক ক্রিয়া দুটির কথা ফ্রয়েড বলেন তা হলো ‘ইগো’ (ঊমড়) এবং ‘সুপারইগো‘ (ঝঁঢ়বৎ-বমড়)। এই তিনটির মিলিত রূপ একজন পরিপূর্ণ ব্যক্তিসত্তা। ইড চষবধংঁৎব চৎরপরঢ়ষব মেনে চলে যা ইচ্ছা তাই করতে চায়; আবেগ এর কেন্দ্রে। শিশুরা ইড বা আদিম কামনা দ্বারা চালিত। কিন্তু শিশু যখন বড় হয় বাস্তবের সম্মুখীন হয়, সামাজিকতা বুঝে তখন সে বুঝতে পারে তার সমস্থ প্রবৃত্তিগত চাহিদা সম্পন্ন হবে না। পরিণত বয়সে একজন তার নিরাপত্তার মানসে নতুন চিন্তাধারা লাভ করে ফ্রয়েড একে বলেন অহম বা ‘ইগো’ (ঊমড়) এটি জবধষরঃু চৎরহপরঢ়ষব দ্বারা চালিত; এটি বাস্তব পৃথিবীকে বুঝে তাই সংযত হয়ে কাজ করতে চায়। এটি যুক্তি ও কা-জ্ঞান মেনে চলে। ‘সুপারইগো’ একটি ব্যক্তিকে ভাল কাজ করার দিকে তাড়িত করে। এটা কামনা, বাসনা, অযৌক্তিক চাহিদা এড়িয়ে চলে। এটি মূল্যবোধ, আদর্শ, সামাজিকতার দিকে মনকে নিয়ে যায় ও ‘ইড‘ (ওউ কে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তাররা একটি বিশ্বয়কর আবিষ্কার করেছেন সম্প্রতি। আমাদের মন, শরীর ও আত্মা সবসময় সরলরৈখিকভাবে চলে না এদের ছন্দপতন আমাদের বিভিন্ন মানসিক পীড়ন দিতে পারে। বর্তমানে যেমন হলিস্টিক সাইকোথেরাপির মাধ্যমে অনেক রোগের উপশম হচ্ছে- আমরা যদি বলি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ একজনের এমনকি ক্যান্সার রোগও সাড়িয়ে তুলতে পারেন প্রথমে শুনলে অবাক লাগলেও এটাও সত্যি হতে পারে। হলিস্টিক থেরাপির মাধ্যমে আমেরিকার আইওয়াতে অনেক রোগীকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে সুফল পাওয়া গেছে। এখানে ঞধষশ ঞযবৎধঢ়ু, ঐবধৎঃগধঃয, ঊঋঞ, গরহফভঁষ ঞৎধরহরহম, ঈৎবধঃরাব অৎঃং এর মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা করা হয়। প্রকৃতি ও সৃজনশীল শিল্প আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ডাচার ক্লেটনার ২০০ রোগীকে প্রকৃতির মাঝে, আনন্দ, মজা, গান, শিল্প, সমবেদনা, তৃপ্তি ও অভিভূত করা ইতিবাচক নিসর্গ ও পরিবেশে রেখে দেখেছেনে পরবর্তীতে অনন্য রোগীদের চেয়ে এই সমস্থ রোগীদের টিস্যুতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গেছে; সাইডাকিন বা সাইটাকিন(পুঃড়শরহব) টিস্যু যা অন্য কোষে প্রভাব ফেলে তা অনেক সবল হয়ে উঠেছে; এটা খুব আধুনিক একটি উদ্ভাবন যেখানে ওষুধ ছাড়া মানসিকভাবে রোগীকে আনন্দঘন পরিবেশে রেখে অনেক বড় ধরনের রোগ থেকে নিরাময়ের ইঙ্গিত মিলেছে এমনকি কোষ ঘটিত। এই পরীক্ষাটি রোগীর হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, ক্ষয়রোগ, এবং আলঝেইমারও নিরাময়ের ইঙ্গিত দিয়েছে। ডা. জেনিফার স্টেলার কানাডিয়ান এই ভদ্র মহিলা যিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন বলেছেন আমরা যদি মনের আবেগগুলোকে সবল রাখতে পারি তবে তা সুস্থ শরীরের পূর্বশর্ত। এটি মানুষের নানা ধরনের বিষণœতা দূর করে অন্য রোগ থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। তবে মানসিক বিশ্লেষণের যে বিষয়টি বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে সেটি হলো অবচেতন মন। কারও কারও মতে ফ্রয়েডই এই মতের প্রবক্তা তবে ফ্রয়েড অবচেতন বা ংঁন-পড়হংপরড়ঁং এই বচনটি নিজে ব্যবহার করেননি তিনি মনের এই দিকটাকে চৎব-পড়হংপরড়ঁং বা আসংজ্ঞান বলতেন। তবে ধরে নেয়া যায় যে ফ্রয়েড যে মনের নির্জ্ঞান স্তরের কথা বলে গেছেন তা এখন অবচেতন হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। কোয়ন্টাম মেথড, ক্লিনিকাল সাইকো-এনালাইসিস মনের এই অবচেতন দিকটি ধরেই আধুনিক উপায়ে মানুষের রোগমুক্তিতে অনেক সাফল্য পেয়েছে। অবচেতন মন মানুষের এক আশ্চর্য ও রহস্যঘেরা বিষয়। অবচেতন মনে এমন কিছু থাকে যা মানুষ নিজেই জানেনা; বিস্মৃতি থেকে স্মৃতিতে জাগরণ আর স্বপ্ন দেখা ইত্যাদি অবচেতন মনে ঘটে থাকে। স্বপ্ন মানুষের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলোকে পূর্ণতা দেয়- এটা ফ্রয়েড বলে গেছেন। অবচেতন মন সত্য মিথ্যার পার্থক্য বোঝে না। তাই আমরা যখন কোন মুভি দেখতে বসি তখন যদিও জানি এটা বানোয়াট আমরা এটা দেখে রোমঞ্চিত, ভীত, পুলকিত, বিনোদিত বা সিক্ত হই; কারণ এটা ঘটে অবচেতন মনে। হাসির সিনেমা দেখলে আমরা হাসি, বেদনার সিনেমা দেখলে ব্যথিত হই- এটাও অবচেতনভাবে ঘটে। একজনকে যদি বার বার বলা হয় আপনি খুব ভাল তবে ধীরে ধীরে সে ভাল ব্যবহার করা শিখবে; খারাপ দিকটা ত্যাগ করবে। শিশুকাল থেকে একটা শিশুকে যেভাবে বড় করা হবে বাকি জীবনটা সে তেমনি আচরণ করবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন যুদ্ধবিমান বোম ফেলতো অনেক শিশু আনন্দিত হতো কারণ তার কাছে এটি খেলার বিষয়ের মতো কিন্তু তার বাবা মা সেই শিশুগুলোর কথা ভেবে আতঙ্কিত হতো স্বাভাবিকভাবেই। একটি শিশুর অবচেতন মনকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে যে ধারণায় ঋদ্ধ করা হয় বাকি জীবন সে সেভাবেই বেড়ে ওঠে। একজন অসুস্থ রোগীকে একজন ডাক্তার বলেন আপনার অবস্থা খুব খারাপ তাহলে সেই রোগী ভেঙ্গে পড়বেন কিন্তু যদি তাকে বলা হয় আপনি ভাল আছেন তবে সে আশ্বস্ত হবে। কারণ এটি তার অবচেতন মন গ্রহণ করবে ও তার দেহের উপর তার সমরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। আধুনিক মনোবিজ্ঞান আবার আধ্যাত্মিক শক্তির গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে আর এটা করা হচ্ছে অবচেতন মনের দ্বারা। অবচেতন মন যেহেতু সত্য মিথ্যার পার্থক্য বোঝে না এবং পুনরাবৃত্তি প্রক্রিয়া মেনে চলে ও তার মস্তিষ্কে জমা রেখে দেয় তাই বার বার একটা কথা মানুষের মনে ঢুকিয়ে দিলে সে এটির প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং তার চরিত্র, মন ও শরীরের ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে অন্য মানুষ নয় একটি মানুষ নিজেই নিজের অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রিত করে অনেক বিষয়ে সুফল পেতে পারে যাকে বলা হয় ধঁঃড় ংঁমমবংঃরড়হ দেয়া। আমি নিজেই আমাকে কোন ব্যাপারে বুঝিয়ে আমার মন, চিন্তা, কর্ম, বর্তমান অবস্থা, ব্যক্তিত্বকে পাল্টে দিতে পারি; কারণ মনকে বারে বারে যদি বলি আমি আগের চেয়ে অনেক সুখী হয়েছি পুনরাবৃত্তির এই ধারা আমাকে সত্যি সুখী হতে সাহায্য করবে। তবে মন, সচেতন অথবা অবচেতন বা নির্জ্ঞান সমন্ধে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্তে বিশ্লেষকরা আসতে পারেননি যতদিন যাচ্ছে গবেষণা আগাচ্ছে কিন্তু মানুষের মন এখনও বিস্ময় হয়েই থাকছে। [তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট]
×