ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

আমানতে আবগারি শুল্ক ॥ সিংহভাগ দিচ্ছে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা

প্রকাশিত: ০৩:২৩, ৯ জুন ২০১৭

আমানতে আবগারি শুল্ক ॥ সিংহভাগ দিচ্ছে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তরা

মাননীয় অর্থমন্ত্রী বরাবর যা করেন এবারও তাই করেছেন। একটি বড় বাজেট দিয়েছেন। বলা যায় এ যাবতকালের মধ্যে বৃহত্তম বাজেট, যার আকার খরচের দিক থেকে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন বাজেটে আয়ের প্রাক্কলন কত? মাত্র ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর অর্থ বিরাট ঘাটতি। ঘাটতির পরিমাণ কত? ঘাটতি হচ্ছে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ১৩ হাজার ৬০১ কোটি টাকা বেশি। টাকার অঙ্কে বেশি হলেও ‘জিডিপির’ তুলনায় বেশি নয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ‘জিডিপির’ ৫ শতাংশ। এবারও তাই। তবে ২০১৫-১৬ অর্থছরের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। সেই অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ‘জিডিপির’ তুলনায় তিন দশমিক ৮ শতাংশ। এই অর্থে বর্তমান অর্থবছর এবং আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতির পরিমাণ অর্থবছর এবং আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বেশি। বলা যায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ঘাটতির পরিমাণটাই সহনশীল ছিল, সুখপ্রদ ছিল। পাঁচ শতাংশ ঘাটতি একটু বেশির দিকে। তবে এ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ঘাটতির টাকা অপচয় করা হচ্ছে না। এটা যাচ্ছে উন্নয়ন ব্যয়ে। এ কথা পরিষ্কার আমাদের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই। উন্নয়নের বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) কখনও পুরো টাকা কখনও কখনও সিংহভাগ টাকা আসে ঘাটতি ফিন্যান্সিং থেকে। এটা আমাদের বাজেট কর্মকা-ের বড় দুর্বল দিক। তবে আশার কথা সরকার উন্নয়ন বাজেট দিন দিন বড় করছে। বেসরকারী বিনিয়োগ স্থবির বিধায় ‘এডিপি’ হয়ে উঠেছে উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি। এই দৃষ্টিতে দেখা যায় এডিপি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেশ বড় হয়েছে, যেমন হয়েছে সমগ্র বাজেট। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংশোধিত ‘এডিপির’ পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। লক্ষণীয় মূল বাজেটের তুলনায় কমেনি। অথচ বরাবর তা কমে। রজস্ব ঘাটতি হলেই সরকার ‘এডিপির’ আকার হ্রাস করে। ভিন্ন কথায় রাজস্ব ঘাটতির শিকার হয় উন্নয়ন কর্মসূচী। এবার তা হয়নি। এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ। তারা ইচ্ছা করলে ‘এডিপির’ আকার কমাতে পারত। তা করেনি। এর ফল অবশ্য অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে সাত দশমিক ২৭ শতাংশ যা সরকারী-বিনিয়োগের প্রতিফলন। দেখা যাচ্ছে এ প্রেক্ষাপটে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ‘এডিপির’র আকার হচ্ছে এক লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এসব তথ্য থেকে এটা প্রতীয়মান যে, সরকারকে বড় ধরনের ঋণে যেতে হবে আগামী অর্থবছরে। বৈদেশিক ও দেশীয় উৎস থেকে ঋণ হবে যথাক্রমে ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি ও ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। দেশীয় সূত্রে ঋণের কোন অসুবিধা নেই। সরকারী ব্যাংকে এবং বেসরকারী ব্যাংকে-উভয় ক্ষেত্রেই টাকার পাহাড় জমে আছে। সরকার যেখান থেকে ঋণ নিতে পারে ব্যাংকগুলো বরং খুশিই হবে। অন্যদিকে বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ীরা ‘চিল্লাচিল্লি’ করবে না। কারণ ব্যাংকে ব্যাংকে এত টাকা উভয়পক্ষ প্রচুর ঋণ নিলেও টাকায় টান পড়বে না। তবে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে আমানতকারীরা ঠকে। কারণ সরকার ঋণ নেয় অল্পসুদে। আবার এই সুুদের হারের উদ্ধৃতি দিয়েই লোকেরা বলে, সরকারের জন্য সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া ব্যয়বহুল, ব্যাংকঋণ কম ব্যয়বহুল। অথচ এখানে যে আমানতকারীরা ঠকে তার কথা কেউ বলে না। আমানতকারীরা ঠকে কারণ ব্যাংকের সুদ আয় কম হলে ব্যাংকও আমানতকারীদের সুদ কম দেয়। এ পেক্ষাপটে বৈদেশিক ঋণের প্রশ্নটিকে বিবেচনা করলে বোঝা যাবে আগামী অর্থবছরে ওই ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। চলতি অর্থবছরে যেখানে ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা সেখানে আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রাক্কলন হচ্ছে ৫১ হাজার ৯২ কোটি টাকা। অনেকের সন্দেহ এত ঋণ বিদেশে পাওয়া যাবে না। আমি এ সন্দেহ করি না। আমার প্রশ্ন অন্যত্র। আমরা কিন্তু বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য ব্যবহারে অদক্ষ। প্রচুর ঋণ ও সাহায্য অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে এর পরিমাণ যে বিশাল তাতে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। এমতাবস্থায় ব্যবহারের দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি বৈদেশিক ঋণের ইস্যুটিকে দেখছি। বাজেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কার কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে এবং কার জন্য ওই টাকা খরচ করা হচ্ছে। এবং খরচের ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন খরচ ঠিকমতো করা হচ্ছে কিনা, এক টাকার কাজ দুই টাকায় করা হচ্ছে কিনা। আমার বরাবর ধারণা, এসব ক্ষেত্রে আমাদের সরকারী নীতি বহুলাংশে ‘ধনীবান্ধব’, গরিব-মধ্যবিত্তবান্ধব নয়। রাজস্ব সংগ্রহের যে প্রচেষ্টা তা থেকে এ কথা পরিষ্কার। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট থেকে দেখা যায় মোট রাজস্বের ৬২ শতাংশই যোগান দেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের’ রাজস্বের ৩৬ দশমিক ৮ শতাংশ আসবে মূল্য সংযোজন কর থেকে। ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ আসবে আয়কর থেকে। আমদানি শুল্ক থেকে আসবে ১২ দশমিক ১ শতাংশ রাজস্ব। সম্পূরক শুল্ক থেকে আসবে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ টাকা। বাকি ১ দশমিক ৩ শতাংশ টাকা আসবে অন্যান্য উৎস থেকে। সব মিলিয়ে তারা যোগান দেবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এসব হিসাবে কোন ‘গলদ’ নেই। দৃশ্যত সব ঠিক আছে। কিন্তু নীতিগতভাবে বিবেচনা করলে প্রশ্ন জাগে, কার কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার গরিবের, মধ্যবিত্তের, নিম্নমধ্যবিত্তের সরকার। এক সময় বলা হতো আওয়ামী লীগ ‘লুঙ্গিওয়ালাদের পার্টি’। সম্ভবত এখনও তাই। অতএব প্রশ্নÑ রাজস্বের টাকা গরিবরাই দেবে, না ধনীরা দেবে? এটা রাজস্ব আদায়ের নীতি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার আগের বাজেটগুলোতে রাজস্ব আদায়ে সমতার নীতির কথা বলেছেন, ন্যায়বিচারের কথা বলেছেন। এসব প্রেক্ষাপটে বাজেট প্রস্তাব বিবেচনা করলে একে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলা যায় না। উদাহরণ? মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। আমি ভ্যাটের হারের প্রশ্নে যাচ্ছি না। ভ্যাটের টাকা কারা দেবে? পরিষ্কারভাবে এটা ‘ভোগকর’। ‘ব্যয়কর’ এটা। এটা পরোক্ষকর। এই করের বোঝা ধনী ও গরিব সমানভাবে বহন করবে। দেশের বৃহত্তম ব্যবসায়ী হাউজের মালিক যে হারে ভ্যাট দেবে তার অফিসের পিয়নও সেই হারে ভ্যাট দেবে। তাহলে এখানে ন্যায্যতা কোথায়, ন্যায়বিচার কোথায়। দেখা যাচ্ছে শুধু ভ্যাট নয়, আয়করেও তাই হচ্ছে, আয়কর ক্রমাগতভাবেই ‘উৎসে কর কাটা’য় পরিণত হচ্ছে, সর্বত্র অগ্রিম আয়কর কাটার ধুম। যিনি আয়করের মধ্যে জীবনেও পড়বেন না, তার কাছ থেকেও অগ্রিম আয়কর কেটে নেয়া হচ্ছে। অথচ এবার দেখলাম গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের আয়কর হ্রাস করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ তাদের এত সুযোগ-সুবিধা কেন? গার্মেন্টস রফতানি কী তাদের অবদান, না ৪০ লাখ শ্রমিকের অবদান? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। সরকার কী রাজস্ব আদায়ের কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট নাকি মামলায় আটকা। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণের টাকা মামলায় আটকা। ধনীরা আয়কর প্রদান আটকে রাখছে মামলা করে। এসব কয়েকটি উদাহরণ। দেশের সর্বোচ্চ আয়কর দাতা জর্দার ব্যবসায়ী! সেখানে পাঁচ, দশ হাজার কোটি টাকা ‘টার্ন ওভারের’ কোম্পানির মালিক নেই। গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানম-ির বাড়ির মালিকরা ‘সম্পদকর’ (সারচার্জ) দেন না, দেন বেসরকারী কর্মকর্তারা যারা আয় লুকাতে পারেন না। এরই মধ্যে আরেকটি উদাহরণ দিই। এর থেকে পরিষ্কার হবে রাজস্ব কোত্থেকে আদায় হচ্ছে। আবগারি শুল্ক নিয়ে এবার ভীষণ হৈচৈ। ব্যাংক আমানতের ওপর এটা ধার্য করা আছে বহুদিন থেকে। এবার করের হার বা শুল্কের হার বাড়ানো হয়েছে মাত্র। এতে সরকার বাড়তি কর বা রাজস্ব কত পাবে? ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে মোট ৮৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৬টি হিসাব আছে। যেগুলোতে এক লাখ এক টাকার ওপরে আমানত আছে। সরকার এসব এ্যাকাউন্ট থেকে আবগারি শুল্ক আদায় করবে কত? মাত্র ৩৫৫ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এবারই ওই প্রশ্নÑ এই ৩৫৫ কোটি টাকার মধ্যে কে কত টাকা দেবে। দেখা যাচ্ছে এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত যাদের আমানত তারা শুল্ক দেবে ২১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এখন প্রশ্ন, এরা কী ধনাঢ্য লোক, বিত্তবান লোক? এক লাখ কেন, দশ লাখ টাকায় গোপীবাগে একটা ৪০০ বর্গ ফুট ফ্ল্যাটের অর্ধেকও পাওয়া যাবে না। পাকিস্তান আমলে লাখ টাকার মালিক হলে বাড়িতে ঘিয়ের বাতি জ্বলত। এখন শত কোটির মালিক হলেও তা জ্বলে না। টাকার অবমূল্যায়ন এত হয়েছে। আমি ওই ইস্যুতে যাচ্ছি না। আমি শুধু আবগারি শুল্কের কথাই বলছি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে সরকার যে ৩৫৫ কোটি টাকা তোলার প্রস্তাব করছে তার ২১৯ কোটিই আসবে মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তের কাছ থেকে। এই ঘটনা সর্বত্র। এমতাবস্থায় সরকারকে বলব আগামীতে এমন বাজেট করতে যার দ্বারা ধনীরা বেশি বেশি কর দেয়, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত রেয়াত পায়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×