ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী জয়নুল আবেদীন বীরপ্রতীক

ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ৭ জুন ২০১৭

ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

(গতকালের পর) ট্রাফিক সাইন-সিগন্যাল, রোডমার্কিং প্রভৃতি যথাস্থানে, যথাযথভাবে যথাযথ নিয়মে স্থাপন করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন এ দায়িত্ব এতদিন থেকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে পালন করছে না। ফলে ট্রাফিক শৃঙ্খলা স্থাপনে বিঘœ ঘটছে। ঢাকা শহরের সড়কগুলোতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ব্যবহার হয় না। ট্রাফিক পুলিশ স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়ন না করে রাস্তায় দায়িত্বে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ (গধহঁষ ঝরমহধষরহম) করা তাদের বেশি পছন্দ। এখানে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের জন্য কোন জেব্রা ক্রসিং এবং স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যালের ব্যবস্থা নেই। সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব রয়েছে। পথচারীরা যত্রতত্র ও যখন তখন রাস্তা পারাপার করে। এসব কারণে যান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হয়। শহরে পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় সড়কের অনেকটা জুড়ে গাড়ি পার্কিং করা হয়। ফলে যানচলাচলের জন্য সড়কের সম্পূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয় না। বহুতল ভবন, মার্কেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডাক্তারদের চেম্বারগুলোর অধিকাংশের নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে সড়কে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে ভাল অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দূরবর্তী এলাকার ছেলেমেয়েরা নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করে পড়তে আসে। সকল এলাকায় মানসম্মত স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় স্বাস্থ্যসেবার জন্য নাগরিকদের দূরে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাজার করার জন্যও দূরে যেতে হয়। ফলে রাস্তার ট্রাফিকের চাপ বৃদ্ধি পায়। এগুলো ঢাকায় ট্রাফিক জটের কারণ। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে ট্রাফিকের সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ অধিদফতর, রাজউক, সিটি কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। সেটা কিভাবে সমন্বয় করা যাবে, সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হওয়া প্রয়োজন। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে স্থানীয় সরকারগুলো নিজ নিজ এলাকায় সেবাদানের দায়িত্ব পালন করে। শহরের মেয়রের অফিস থেকেই যেহেতু সকল সেবাখাত পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, সেজন্য সেখানে সমন্বয়ের সমস্যা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, সেজন্য সমন্বয় সমস্যা সৃষ্টি হয়। ট্রাফিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞগণ নানা সুপারিশ করে থাকেন। আমার মতো অবিশেষজ্ঞরাও এসব বিষয়ে মতামত দিয়ে থাকে। বলা যায়, নানা মুনির নানা মত। ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার জন্য বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ প্রায় সকলেই যানজটের জন্য প্রধানত পুলিশ প্রশাসনকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু পুলিশের পক্ষে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা একক প্রচেষ্টায় উন্নত করা সম্ভব নয়। ট্রাফিক সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশন এবং নির্বাচিত মেয়রদের যথেষ্ট করণীয় রয়েছে। ১। শহরের সড়কগুলোতে ট্রাফিক সাইন ও সিগন্যাল স্থাপন এবং রোডমার্কিং করা মেয়রের দায়িত্বে থাকলে, তার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ও দক্ষ জনবল থাকা প্রয়োজন। বর্তমান ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরের যে দু’জন নির্বাচিত মেয়র রয়েছেন, তারা যথেষ্ট কর্ম তৎপর। মেয়রদের অধীনেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ন্যস্ত থাকা উত্তম হবে। তারা বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে ট্রাফিক নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে পারেন। এ ব্যাপারে যদি মেয়রের সম্পূর্ণ এখতিয়ার ও ক্ষমতা না থাকে তবে সরকারের উচিত হবে রাজধানী শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নের স্বার্থে মেয়র অফিসকে এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করা। প্রয়োজনীয় দক্ষ লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। নির্বাচিত মেয়র জনস্বার্থে প্রয়োজনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে অস্থায়ীভিত্তিতে দক্ষ লোকবল নিয়োগ করতে পারে। সেটা বিধিসম্মত না হলেও অনৈতিক হবে না। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও হস্তক্ষেপে এ কাজ হতে পারে। ঢাকা আমাদের রাজধানী শহর। দেশের প্রশাসন এবং ব্যবসা বাণিজ্য এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তি এ শহরে বসবাস করে। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশেষ গুরুত্ব পাওয়া উচিত। ঢাকার সুনামের সাথে দেশের সুনামও জড়িত। ২। ক) পুলিশের দায়িত্ব হবে ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ট্রাফিক সাইন-সিগন্যাল নির্দেশাবলী এবং রোডমার্কিং গাড়িচালকগণ যাতে সম্পূর্ণ মেনে চলে সেটা নিশ্চিত করা। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল পুলিশকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলা যদি কোথাও কোন বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ কারণে সমস্যা সৃষ্টি করে, তবে সিটি কর্পোরেশন ও বিশেষজ্ঞ পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল সমন্বয় করতে হবে। কোনভাবেই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল অমান্য করা যাবে না। পুলিশের দায়িত্ব হবে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ মেয়রের অধীনে ন্যস্ত করা গেলে ভাল হয়। সেটা না হলেও মেয়র সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে পারে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করা। খ) বর্তমান অনেক ক্রসিংয়েই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে ৩/৪ মিনিটের সময় দেওয়া আছে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল মেনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হলে চৌরাস্তার ক্রসিংয়ে ট্রাফিক ১৫-২০ মিনিট স্থবির হয়ে থাকে। ম্যানুয়াল সিগন্যালিংয়ের কারণে ট্রাফিক আরও বেশি সময় স্থবির হয়ে যায়, যা অত্যন্ত বিরক্তিকর। সিগন্যাল ১ মিনিটের বেশি হওয়া উচিত নয় এবং স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল মেনে চলা হলে ট্রাফিক ফ্লো চলমান থাকবে। চৌরাস্তায় সাধারণত একদিকের ট্রাফিক চলমান থাকলে অন্য তিনদিক বন্ধ থাকে। একই সঙ্গে সোজা বাম ও ডানদিকের ট্রাফিক চলমান থাকে। চৌরাস্তা ক্রসিংয়ে সিগন্যাল টাইম ১ মিনিট হলে প্রতি ৩ মিনিটে সিগন্যাল পাওয়া যাবে। ট্রাফিক ফ্লো চলমান থাকবে। গাড়ির দীর্ঘ লাইন হবে না। যেখানে বামের লেন সবসময় খোলা থাকে, পুলিশের দায়িত্ব হবে সেটাকে চলমান রাখা। সেক্ষেত্রে নির্বাচিত মেয়র চলমান ঢাকার যে অঙ্গীকার করেছেন, সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। গ) ঢাকায় বেশ কিছু ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। নানা কারণে পথচারীরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে চায় না। অনেক স্থানেই ফুটওভার ব্রিজ নেই। পথচারীরা ট্রাফিকের সঙ্গে প্যারালাল অর্থাৎ ট্রাফিক যেদিকে যায়, তার সমান্তরাল পারাপার করে তাহলে সমস্যা হয় না। গাড়ির সামনে দিয়ে (ধপৎড়ংং ঃযব ঃৎধভভরপ) কোন পথচারী যেন পারাপার করতে না পারে, সেটা পুলিশকে নিশ্চিত করতে হবে। পথচারী পারাপারে যেখানে প্রয়োজন স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ঘ) রাস্তায় যদি বাম দিকের ট্রাফিক খোলা থাকে পুলিশের দায়িত্ব হবে বামের ট্রাফিক যেন চলমান থাকে সেটা নিশ্চিত করা। ঙ) রাস্তায় যদি রোডমার্কিং থাকে, থাকা আবশ্যক, পুলিশের দায়িত্ব হবে চালকগণ যাতে রোডমার্কিং সঠিকভাবে অনুসরণ করে, তা নিশ্চিত করা। ডানে ট্রাফিকের জন্য ডান দিকের একটি বা দুটি লাইন চিহ্নিত থাকবে। একইভাবে সোজা ও বামে ট্রাফিকের জন্য লাইন চিহ্নিত থাকবে। ডানের গাড়ি যদি সোজা বা বামের লাইনে এসে দাঁড়ায়, তবে পুলিশের দায়িত্ব হবে সেগুলোকে সোজা বা বামে যেতে বাধ্য করা এবং বামের লাইন পরিষ্কার রাখা। তাহলে ঢাকায় ট্রাফিক কিছুটা হলেও চলমান থাকবে এবং ট্রাফিক শৃঙ্খলার উন্নতি হবে। চ) দীর্ঘদিন থেকে শুনছি, টঙ্গী থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট রুট’ হবে। কিন্তু সেটা এখনও সম্ভব হয়নি। বাসগুলো যেন রাস্তার বামপাশ দিয়ে চলে। বামদিকে চলতে হবে, কারণ রাস্তায় বাস যাত্রী ওঠানামা করায়। সে ব্যাপারে নির্দেশনা জারি করা বা সম্ভব হলে ডিভাইডার নির্মাণ করে বাসের জন্য পৃথক লেন তৈরি করা, যেভাবে রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। তাহলে বাসগুলো যখন তখন লেন পরিবর্তন করে ট্রাফিক জট তৈরি করতে পারবে না। পুলিশকে সেটার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বাসগুলো যেন ‘বাস বে’ ছাড়া রাস্তায় দাঁড়াতে না পারে, সেটাও পুলিশকেই দেখতে হবে। প্রয়োজনীয় স্থানসমূহে ‘বাস বে’ তৈরি করার জন্য সিটি কর্পোরেশনকেই দায়িত্ব নিতে হবে। ৩। যানজটের আরেকটি কারণ হল, একই রাস্তায় যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যান চলাচল করা। মেয়র চাইলে ঢাকা শহর থেকে অযান্ত্রিক যানবাহন (রিকশা, রিকশা ভ্যান, ঠেলাগাড়ি প্রভৃতি) তুলে দিতে পারেন। কাজটি অজনপ্রিয় হলেও এটা করতেই হবে। স্বল্প সময়ে এ কাজ করতে গেলে হয়ত বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সংশ্লিষ্টদের যথেষ্ট সময় দিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে অযান্ত্রিক যান ঢাকা শহর থেকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রিকশা উঠে গেলে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষদের কষ্ট হবে, বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে, এসব চিন্তা করলে কখনও কাজ করা যাবে না। পশ্চিম বাংলার বামপন্থী সরকার কলকাতা থেকে সকল অযান্ত্রিক যানবাহন তুলে দিয়েছিল। অযান্ত্রিক যানবাহন তুলে দেয়া সম্ভব হলে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা কয়েক লাখ কমে যাবে। রিকশা চালকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু সেটার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ বর্তমানে যারা আছে তাদের কর্মসংস্থান করা হলে, অন্যরা এসে একই কাজে যুক্ত হবে। হকারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বর্তমানে গ্রামগঞ্জে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। কৃষি কাজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। ঢাকা শহরে যারা অযান্ত্রিক যান চালায়, তাদের নিজ নিজ এলাকাতেই কাজের সুযোগ রয়েছে। সরকার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প চালু করেছে। তারা সেটারও সুযোগ নিতে পারে। বর্তমানে দেশের সর্বত্র দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। সরকার যুব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে ভিত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। এতে দেশের উন্নতি হবে, তাদেরও আয় বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে রিকশা, ঠেলাগাড়ি চালানোর মতো কষ্টকর ও অমর্যাদাকর কাজ না করে তারা কলে-কারখানায় কাজ পেতে পারে। স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য রিকশার পরিবর্তে সিএনজি অটোরিকশা ব্যবহার করা যাবে। বর্তমানে ঢাকা শহরে রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া প্রায় সমান। তবে সিএনজি যেন স্বল্প দূরত্বেও চলাচল করে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ৪। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে যদি প্রত্যেক ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কাঁচাবাজার করা যায়, তবে রাস্তায় ট্রাফিক চাপ কমবে। মেয়র চাইলে নিজস্ব প্রচেষ্টায় এ কাজ করতে পারে। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সেটা করেছেন। ৫। ট্রাফিক জটের অন্য কারণগুলোর মধ্যে রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করা, রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রীসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখা, ফুটপাথে হকার বসা প্রভৃতি দায়ী। প্রয়োজনীয় স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ের যথেষ্ট ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। রাস্তার যেন নির্মাণ সামগ্রী রেখে বা অন্য কোনভাবে যান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। ৬। প্রধান সড়কগুলোতে ভিআইপি চলাচলের কারণে রাস্তায় যানজট হয়। ভিআইপিগণ অনেকে সময় উল্টো পথেও চলাচল করে থাকেন, যা মোটেই শোভনীয় নয়। উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে রাস্তার ডান পাশের লেন পুলিশের জন্য নির্ধারিত থাকে। আমাদের এখানেও প্রধান সড়কে ডান পাশের লেনটি পুলিশের জন্য নির্ধারিত থাকা উচিত, যাতে যে কোন জরুরী প্রয়োজনে পুলিশ দ্রুত চলাচল করতে পারে। ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে এক এক পাশে চার থেকে পাঁচটি লেন রয়েছে। সর্ব ডানের লেনটি ইমারজেন্সী লেন হিসেবে চিহ্নিত করা বাঞ্ছনীয়। ভিআইপি, পুলিশ, এ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী এই লেনটি ব্যবহার করবে। এ গাড়ীগুলো যখন হুটিং করে (ভেঁপুু বাজিয়ে) যাবে, তখন ডানের লেনের গাড়ি বামে সরে গিয়ে রাস্তা খালি করে দিতে হবে। এটা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ভিআইপি, এ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি দ্রুত চলাচল সম্ভব হবে। ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি যানজট হয় রেলক্রসিংগুলোতে। বর্তমান সরকারের উদ্যোগে অনেক স্থানে ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সেখানে যানজটের অনেকটা অবসান হয়েছে। তবে ওভারপাসগুলো সু-পরিকল্পিত ও সু-সমন্বিত না হওয়ায় সেগুলোতেও সর্বোত্তম সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। কুঁড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিংয়ে যে ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়েছে, সেটি বনানী রেলক্রসিং অতিক্রম করে মহাখালী রেলক্রসিংয়ের ফ্লাইওভারের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হলে বর্তমান কাকলীর ক্রসিংয়ের যে তীব্র যানজট হয়, সেটার নিরসন হতো। বনানী ফ্লাইওভারটি সেনানিবাসের ভিতর দিয়ে মাটিকাটা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। সেটার তেমন প্রয়োজন ছিল না। সেটা না করে বনানী ফ্লাইওভার কাকলী ক্রসিং অতিক্রম করে সৈনিক ক্লাব রেলক্রসিংয়ে ল্যান্ডিং দেয়া হলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেত জনগণ। সবচেয়ে বেশি যানজট ছিল যাত্রাবাড়ীতে। সেখানে যাত্রীদের সব সময় কয়েক ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের ফলে যাত্রাবাড়ীতে যে তীব্র যানজট ছিল, সেটার অবসান হয়েছে। যাত্রাবাড়ী অতিক্রম করতে যেখানে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগত, সেখানে এখন মাত্র ১০-১৫ মিনিটে অতিক্রম করা যায়। অনেকে ফ্লাইওভারের বিরোধিতা করে থাকে। তাদের বক্তব্য, ফ্লাইওভারে নাকি শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকও ধনিক শ্রেণী সুবিধা পেয়ে থাকে। সাধারণ জনগণের তাতে লাভ হয় না। তাদের এই বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত হয়নি। ফ্লাইওভারগুলোতে যেমন ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে, তেমনি বাসও চলছে। এতে শহরের যানজট অনেকটাই নিরসন হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বিমানবন্দর থেকে শনির আখড়ার কুতুবখালী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের। সম্ভবত কাজও শুরু হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যানজট আরও কমে যাবে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ঢাকার প্রধান সড়কটিতে বর্তমানে কাকলী ক্রসিং, বিজয়সরণি ক্রসিং এবং সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে সবচেয়ে বেশি যানজট হয় এবং অনেক সময় অপচয় হয়। এই তিনটি ক্রসিংয়ে যদি ফ্লাইওভার বা ইউলুপ নির্মাণ করা হয়, তবে ঢাকার প্রধান সড়কটিতে তেমন যানজট থাকবে না। সরকার জরুরী ভিত্তিতে এ কাজটি করতে পারে। বর্তমান সরকারের মেয়াদকালেই এ কাজ শেষ করা সম্ভব। শহরের রাস্তাগুলোতে প্রয়োজনীয় ট্রাফিক সাইন-সিগন্যাল স্থাপন এবং রোডমার্কিং করা হলে এবং পুলিশ যদি সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে, তবে ঢাকার যানজট সহনীয় হতে পারে। স্মরণে রাখতে হবে, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার চাপ অধিক, প্রয়োজনের তুলনায় সড়কের স্বল্পতা রয়েছে। ফলে এখানে দ্রুত গতির ট্রাফিক হয়ত সম্ভব হবে না। তবে ট্রাফিকের বিশৃঙ্খলা ও বিরক্তিকর যানজট অবস্থার অবসান সম্ভব। ট্রাফিক শৃঙ্খলা স্থাপন করে যানজট নিয়ন্ত্রণ এবং চলমান ঢাকা গড়ে তোলার ব্যাপারে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন তথা নির্বাচিত মেয়রের যথেষ্ট করনীয় রয়েছে। ঢাকা উত্তর দক্ষিণের নির্বাচিত মেয়রদ্বয়ের যানজট মুক্ত বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তোলার যে ইচ্ছা রয়েছে, সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য তাদের যথেষ্ট তৎপর হতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা শুধু পুলিশের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। যানজট নিরসনে সরকার এলিভেটেড রেললাইন নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে। গণপরিবহন হিসেবে এ রেল ব্যবস্থা নাকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে আমাদের ধারণা এটা হয়ত ঢাকা শহরের কিছুটা শোভা বর্ধন করবে, কিন্তু গণপরিবহনে কতটা কার্যকর হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। বর্তমানে টঙ্গী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রেলের ডবল লেন রয়েছে। কমিউটার ট্রেন ব্যবস্থা চালু করে যদি প্রত্যেক ঘণ্টায় টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত কমিউটার ট্রেন চালু করা যায়, তবে সড়কের ওপর ট্রাফিকের চাপ অনেক কমে যাবে। দীর্ঘ পরিকল্পনার অধীনে যদি মাটির নিচ দিয়ে মেট্রোরেলের ব্যবস্থা করা যায় এবং উত্তরা থেকে থেকে বাড্ডা হয়ে যে রাস্তা মালিবাগ মতিঝিল গুলিস্তান নিউমার্কেট মিরপুর হয়ে উত্তরা পর্যন্ত একটি সার্কুলার মেট্রোরেল ব্যবস্থা যদি নির্মাণ করা সম্ভব হয়, তবে ঢাকা শহরের চলাচল ব্যবস্থা স্বল্পব্যয় সাপেক্ষে এবং অনেক আরামদায়ক হবে। (সমাপ্ত) লেখক : সাবেক ডি.আই.জি
×