ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল হলে ইতিহাসের বিরাট ভুল হবে ॥ এ্যাটর্নি জেনারেল

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২ জুন ২০১৭

সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল হলে ইতিহাসের বিরাট ভুল হবে ॥ এ্যাটর্নি জেনারেল

আরাফাত মুন্না ॥ মার্শাল ল’র মাধ্যমে গঠন করা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল বহাল রাখা হলে এটা ইতিহাসের বিরাট ভুল হবে বলে মন্তব্য করেছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আপীল বিভাগের বিচারপতিদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ইতিহাস যেমন বিচারপতি মুনিমের কথা বলে, তেমনি আপনাদের কথাও বলবে। আপনারা কেন সংসদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?’ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্টের বাতিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপীল শুনানির একাদশতম দিনে সমাপনী বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। অন্যদিকে সংসদের প্রতি অবিশ্বাস দেখানোকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা এই সংবিধান পেয়েছি। এই সংবিধানের মাধ্যমেই সংসদের সৃষ্টি।’ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এসকে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত আপীলের শুনানি শেষ হয়েছে। পরে প্রধান বিচারপতি রায় সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) বলে জানান। ফলে সাংবিধানিক এই ঐতিহাসিক মামলার রায় যে কোন দিন দিতে পারেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ছাড়া বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। এদিন রাষ্ট্রপক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিটকারীদের বক্ষে সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বৃহস্পতিবার শুনানির শুরুতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের সংশোধন নিয়ে আলোচনা না করে হাইকোর্ট তার রায়ে কোন ব্যবস্থা ভাল সেটা নিয়ে আলোচনা করেছে। যদি হাইকোর্ট সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ ও সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রায়ে আলোচনা করত সেটা ছিল যুক্তিযুক্ত।’ তিনি বলেন, ‘কারণ শুধু সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ভাল কি না সেটা এই মামলার বিচার্য বিষয় নয়। এই ব্যবস্থা উঠে গেলে কি ক্ষতি হবে তা নিয়েই হাইকোর্টের রায়ে আলোচনা করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় সংসদের ওপর কেন এত অবিশ্বাস? তার কোন উত্তর রায়ে কেউ দিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা এই সংবিধান পেয়েছি। এই সংবিধানের মাধ্যমেই সংসদের সৃষ্টি। তাই এ সংসদের প্রতি অবিশ্বাস দেখানো অত্যন্ত দুঃখজনক।’ মুরাদ রেজা বলেন, ‘আদি সংবিধানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যদি মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে থাকতে পারে তাহলে এমন কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে এই অনুচ্ছেদকে সাংঘর্ষিক বলা হচ্ছে। সবসময়ই যুক্তি এসেছে মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না। তখন আল্ট্রাভাইরাস (সাংঘর্ষিক) না হলে হঠাৎ এখন কেন আল্ট্রাভাইরাস হবে?’ তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের মূল অংশের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেই বিচার করতে হবে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রয়োজনেই সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল করা হয়েছিল। এখন এর প্রয়োজন নেই।’ মুরাদ রেজা বলেন, ‘সামরিক শাসনের কারণে একটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তখন আমরা সুপ্রীমকোর্টের কোন সাহায্য পাইনি। একজন প্রধান বিচারপতি রাতের অন্ধকারে গিয়ে সামরিক আইনের প্রধান প্রশাসক হয়েছিলেন। সেই কালো অধ্যায়ের সময়ে করা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা সুপ্রীমকোর্ট রেখে দিল।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা কোনভাবেই মার্শাল ল’র অধীনে ফিরে যেতে চাই না।’ এ সময় মুরাদ রেজা বলেন, ‘তখন তো বিচার বিভাগের কেউ সাহস করে বলেননি কেন জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে বলবো না?’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথাই তো বলছেন। সংসদ ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন ও সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে, এটাই তো বলছেন?’ জবাবে মুরাদ রেজা বলেন, ‘৯৬ অনুচ্ছেদ আগে যা ছিল চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমে সেখানে হাত দেয়া হলো। এটা মৌলিক কাঠামোর অংশ ছিল না বলেই সেখানে হাত দিতে পেরেছিল? তখন বিচারপতি ইমান আলী বলেন, ‘তাহলে কি ৯৬ ওই অংশটুকু অসাংবিধানিক বা সাংঘর্ষিক ছিল?’ মুরাদ রেজা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এটা কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। চাইলে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে। কিন্তু এরপর সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনীতে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছি।’ মুরাদ রেজা বলেন, ‘কিন্তু এই মামলায় হাইকোর্ট তো বলেছে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়া যাবে না। সুপ্রীমকোর্ট সবসময়ই সংবিধানের সঙ্গে ছিল। যখনই কোন অবৈধ হস্তক্ষেপ হয়েছে আপনারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৯৬ অনুচ্ছেদে আপনারা মার্জনা করেছেন। বৈধ হলে কি সেটা মার্জনা করার প্রয়োজন ছিল? সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল অবৈধ ছিল বলেই আপনারা মার্জনা করেছেন। ওই সংশোধনী যদি মৌলিক কাঠামোর অংশ হতো তাহলে মার্জনা করার প্রয়োজন হতো না। ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই উল্লেখ করে মুরাদ রেজা বলেন, ‘বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেয়ার ক্ষেত্রে বিচারকদের মধ্যে এত ভয় কেন? আপনারা শপথই নিয়েছেন ভয়-ভীতির উর্ধে উঠে বিচার করবেন। আপনাদের সামনে আলো ছাড়া অন্ধকার নেই। পেছনে কোন খড়গ নেই। তারপরও কেন এত ভয়? ভয়-ভীতি থাকলে তো শপথ থাকে না। সংবিধান অনুযায়ী আপনাদের বিচার করে যেতেই হবে।’ তিনি বলেন, ‘ফ্লোর ক্রসিংয়ের প্রশ্নটা তখনই আসবে যখন ইমপিচমেন্টের প্রশ্ন থাকে। ইমপিচমেন্ট শুধু রাষ্ট্রপতিকে করা হয়। সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আপনাদের আরও বেশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। সংসদকে চ্যালেঞ্জ বা অপমান করার ক্ষমতা কারও নেই। বিচার বিভাগেরও নেই। সংসদকে অপমান করবেন না।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কে অপমান করেছে বলুন।’ জবাবে মুরাদ রেজা আদালতে মতামত দেয়া এ্যামিকাস কিউরিদের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘একজন বাদে সবাই। তারা তো আদালতের বন্ধু। তাদের আলোচনা হওয়ার দরকার ছিল অবজেক্টিভ, সাবজেক্টটিভ না। তারা উন্নত মানের এ্যাডভাইস দিলে আপনারা উন্নত মানের রায় দিতে পারতেন।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কি এগুলো বলার জন্য এসেছেন? রিপ্লাই দেন। অমরা তো হিউম্যান বিং ভুল হতেই পারে। এ জন্যই তো লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করতে বলেছি।’ এ সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, ‘এ্যামিকাস কিউরিরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি এটা বলা ঠিক না। তারা ভুল না ঠিক বলেছে সেটা আমরা দেখব।’ এরপর সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে এ সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি ২৭ সভা করেছে। আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারপতি, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয়েছে।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি যদি এটা নিশ্চিত করতে পারেন অধস্তন আদালত বিষয়ক আদি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। তাহলে আমি আপনার সঙ্গে আছি।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি তো আইন প্রণেতা নই।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘শুধুই কি ১১৬ তে হাত দিয়েছেন, পিএসসি, নির্বাচন কমিশন বিষয়ক অনুচ্ছেদ নিয়েও আপনাদের চিন্তা করতে হবে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নটি জড়িত। আমরা যখন সংবিধানের ব্যাখ্যা দেব তখন পুরো সংবিধানকেই পর্যালোচনা করবো। আমরা শুধুই বিচারকের বিষয়ে চিন্তা করছি না। সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। যদি অভিভাবকই হই তাহলে শুধু বিচার বিভাগই নয়, দেশের ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করতে হবে।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘জনগণ কোথায় গেল? সবার ওপরে জনগণ। জনগণ আছে বলে সংসদ, বিচার বিভাগ আছে।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জনগণের কল্যাণের কথাই আমরা চিন্তা করছি। জনগণের অধিকার রক্ষায় অধস্তন আদালতের বিচারকরা কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্য আমাকে অধস্তন আদালত পরিদর্শনের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হচ্ছে।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমরা অনুন্নত দেশ। আমাদের আর্থিক অবস্থা দেখতে হয়। উন্নত দেশের এ্যাটর্নি জেনারেলরা কিভাবে চলেন আর আমাদের দেশে এ্যাটর্নি জেনারেলরা কিভাবে চলেন।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘৮০ ভাগ মামলাই তো ওইসব আদালতে।’ শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘৯৬ (৩) এ বলা নেই যে, বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদ তদন্ত করবে। মূলত আইনেই বলা থাকবে তদন্ত প্রক্রিয়ার কথা। আইন প্রণয়নের আগে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকদের মতামত নেয়া হবে। এর আগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার অবকাশ নেই। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ। তারা নিজেদের বিচার নিজেরাই করবে এটা ন্যায়বিচার, আইনের শাসনের পরিপন্থী। বিচার করতে গিয়ে আপনারা আবেগের উর্ধে নাও উঠতে পারেন। এ কারণেই তো বিভিন্ন মামলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিব্রত বোধ করে থাকেন।’ এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বিচার করে থাকে জনগণ। জনগণের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। কিন্তু বিচারকদের কোন জবাবদিহি নেই, বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। নির্বাহী বিভাগের কেউ অবৈধ কাজ করে থাকলে তার বিচার করে থাকে বিচার বিভাগ।’ এ সময় বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘এটা ব্যক্তির বিচার করা হয়। আর সব বিভাগ তো নিজেদের বিচার নিজেরাই করে।’ প্রধান বিচারপতি এ বক্তব্যকে সমর্থন করেন। এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘একজন জেলা জজ যদি অসদাচারণ, অনিয়ম করে তবে তার বিচার তো আপনারাই করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা ঠিক না। স্থানীয় সংসদ সদস্যরা এক স্কুলকে বাদ দিয়ে আরেক স্কুলকে এমপিওভুক্ত করে থাকেন। বিভিন্ন পরিপত্র জারি করেন। এ নিয়ে হাজার হাজার মামলা আমাদের সামনে আসে। তখন তো আমরাই বিচার করি।’ শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারকরা দশটার পরিবর্তে সাড়ে দশটায় বসল এটা কে দেখবে? সংসদ সদস্যরা এসে দেখবে না ?’ এ সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্্হাব মিঞা বলেন, ‘ক্ষমতা যদি নিয়ে যান তাহলে জাজদের তদারকি করবে। কোন বিচারপতিই প্রধান বিচারপতির অধীন না। তারা স্বাধীন। কেউ মানবে না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কয়দিন আগে ভারতে কি হয়েছে? কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে দিয়েছেন। কারণ ওই বিচারক জানেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির নেই।’ এ সময় এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা কেন এত শঙ্কাবোধ করছেন?’ জবাবে বিচারপতি ওয়াহ্্হাব মিঞা বলেন, ‘১২টায় বেঞ্চে বসবে, দুই-তিন বছর পর রায় লিখবেন তখন বুড়ো আঙ্গুল দেখাবে। তখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ পুনর্গঠন ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি বলেছেন, যে কোন নাগরিক সংসদে গিয়ে একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবেন। এটা হলে তো শেষ করে দেবেন।’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘শেষ হবে কেন? আজকে যদি মার্শাল ল’র মাধ্যমে যেই সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধান করা হয়েছে তা যদি রাখা হয়, তাহলে এটা হবে ইতিহাসের বিরাট ভুল। ইতিহাস যেমন বিচারপতি মুনিমমের কথা বলে তেমনি আপনাদের কথাও বলবে। আপনারা কেন সংসদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না?’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ ধরনের বক্তব্য দেয়া ঠিক না।’ জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনারা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে আমার কাছে এটাই মনে হচ্ছে।’ এরপর এ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টকে কিছু অভিমত নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছিল। কিন্তু ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ কোন রিভিউ আবেদন করেনি। শর্তসাপেক্ষে মার্জনা করেছে বলে রাষ্ট্রপক্ষ যা বলছে তা সঠিক না। রাষ্ট্রপক্ষ জুডিসিয়াল কাউন্সিল নিয়ে রিভিউই করেনি।’ তিনি আরও বলেন, সুপ্রীমকোর্ট যখন কোন রায়ে সিদ্ধান্ত দেন সেই সিদ্ধান্ত বিলুপ্ত করে সংসদ কোন আইন করতে পারে না। এই সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের যে বিধান এটি ১৬ কোটি জনগণ না হলেও ১০ কোটি মানুষ এর পক্ষে আছে।’ পরে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল আইনজীবীদের ধন্যবাদ দিয়ে রায় সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। এর বিরুদ্ধে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে হাইকোর্টে ওই রায় আসে। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ৮ মে পেপারবুক থেকে রায় পড়ার মাধ্যমে এই মামলার আপীল শুনানি শুরু হয়। এরপর ৯ মে দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি হয়। এ দুইদিন রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা হাইকোর্টের রায়ের ওপর আদালতে শুনানি করেন। এরপর ওইদিনই আদালতে চারজন এ্যামিকাস কিউরি তাদের লিখিত মতামত জমা দেন। তারা হলেনÑ সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, এম আই ফারুকী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। সেদিন আদালত ২১ মে শুনানির পরবর্তী দিন নির্ধারণ করেন। এর আগে গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় আপীল শুনানিতে সহায়তার জন্য ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেন আপীল বিভাগ। তারা হলেনÑ সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, এ এফ হাসান আরিফ, এম আই ফরুকী, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী ও আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।
×