ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সূচিত অগ্রগতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা ॥ খলীকুজ্জমান

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২ জুন ২০১৭

সূচিত অগ্রগতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা ॥ খলীকুজ্জমান

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটকে পূর্বাপর বাজেটের ‘সূচিত অগ্রগতি ধরে রাখার প্রচেষ্টা’ বলে মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ। একইসঙ্গে আগামী অর্থবছরের এই বাজেটে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা ত্বরাণি¦ত করার প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়েছে বলে মত তার। নতুন অর্থবছরের ঘোষিত এই বাজেটে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জনসক্ষমতা বাড়ানো ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার বিশাল অঙ্কের বাজেটের আকার প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ড. খলীকুজ্জমান বলেন, ‘আশা বা স্বপ্নকে আমি বড় রাখার পক্ষপাতি। কারণ দেশের অর্থনীতি প্রতিনিয়তই সম্প্রসারিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে কাজ ও কর্মকা- সম্প্রসারিত হচ্ছে। সুতরাং এদিক থেকে বাজেটের আকার সঠিক অবস্থানেই আছে।’ আগামী অর্থবছরের ঘোষিত এই বাজেটের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদের মন্তব্য, ‘১৫ শতাংশ ভ্যাট মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে খানিকটা প্রভাব রাখলেও সামগ্রিক অর্থনীতিতে তা তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না।’ তাৎক্ষণিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় জনকণ্ঠকে তিনি এসব কথা বলেন। ইস্কাটনের নিজ বাসভবনে জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, বাজেট যেভাবে বিন্যাস করা হয়েছে অর্থমন্ত্রী তা আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন। অর্থাৎ এই বাজেটে যা দেখা গেছে তা অর্থমন্ত্রীর অলোচনার প্রেক্ষিতে প্রত্যাশিতই। মোটা দাগে ওই আলোচনার বাইরে তেমন কিছু নেই। তিনি বলেন, বাজেটের আকার নিয়ে নানা জন নানা কথা বলছে। আমি আশা বা স্বপ্নকে বড় রাখার পক্ষপাতি। আমি স্বপ্নকে বড় রাখতে চাই। কারণ দেশের অর্থনীতি প্রতিনিয়তই সম্প্রসারিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে কাজ ও কর্মকা- সম্প্রসারিত হচ্ছে। সুতরাং এদিক থেকে বাজেটের আকার সঠিক অবস্থানেই আছে। বাজেটে বিশেষ নজর দেয়া তিনটি দিক উল্লেখ করে দীর্ঘ ৩০ মিনিটের সাক্ষাতকারে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের গবর্নিং বডির চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে তার মধ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি একটি। বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বাজেটে উল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করার ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। বিদ্যুত প্রাপ্তি বাড়ানো, গ্যাসের অনুসন্ধান ও এলএমজি সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুত আনার ঘোষণা রয়েছে। গ্যাসের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে ও সমুদ্রে অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে। নতুন রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ ও রেলপথের উন্নয়নের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। মূলত এই ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের অভ্যন্তরে বেসরকারী ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। সরকারী বিনিয়োগ তো বাড়ছেই। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে জনসক্ষমতা বাড়ানোর উপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার মান বাড়ানোর কথা উল্লেখ আছে। যুগোপযোগী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নের কথা। প্রশিক্ষণে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ ও ‘ন্যাশনাল হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলমেন্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়েছে এবং কার্যকর করা হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর জোর দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তথ্য প্রযুক্তির বিস্তারে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে শিক্ষিত বেকারত্ব যেমন বেড়েছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নয় সে রকম বেকারত্বও অনেক বেড়েছে। তাছাড়া বছরে ২০ লাখ মানুষ শ্রম বাজারে যোগ দিচ্ছে। তারমধ্যে ৪ লাখ বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছে। বাকি ১৬ লাখের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। নীতি হিসেবে শ্রমগণ প্রযুক্তির কথা বলা হয়েছে। এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির কার্যকরভাবে ত্বরাণি¦ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মানবসক্ষমতা ও কর্মসংস্থান টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই পথে এগুতে হলে সবাইকে নিয়ে এগুতে হবে। সবার অন্তর্র্ভুক্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজেটে এ বিষয়ে সচেতনতা রয়েছে বলে পরিলক্ষিত হয়। উল্লেখযোগ্য, আরেকটি বিষয় হচ্ছেÑ দরিদ্র এবং পিছিয়ে পরাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বিধবা এবং বয়স্ক ভাতা প্রাপ্তদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসবভাতা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি এগুলো বাস্তবতার আলোকে প্রত্যাশিত ছিল। বাজেট বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আক্ষেপের সুরে অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, আমরা অতীতে লক্ষ্য করেছি বাজেট বাস্তবায়নে প্রথমদিকে গতি খুব শ্লথ থাকে। প্রথম ৬ মাসে তেমন কোন কাজ হয় না। গৃহিত প্রকল্প বাস্তবায়নে শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়া করে অর্থ ব্যয় করা হয়। বাজেটে চলমান কিছু প্রকল্প থাকে এবং থাকে নতুন কিছু প্রকল্প। নতুন প্রকল্প তৈরি করতে সময় নেয়া হয় এবং অর্থায়ন পেতে সময় লাগে। বছর শেষ হয়ে আসে কিন্তু কাজ শুরু হয় না। চলমান প্রকল্পগুলোতেও নানা ধরনের দীর্ঘসূত্রতা থাকে। প্রতিবছরই আমরা লক্ষ্য করি যে, অর্জন আরও বেশি হতে পারত, যদি এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যেত। উন্নয়ন প্রশাসন সাধারণ প্রশাসন থেকে ভিন্ন অঙ্গিক ও ধারণার হওয়া বাঞ্ছনীয়। উন্নয়নের ক্ষেত্রে দ্রুত ও সময়মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। অন্যথায় খরচ বাড়ে। একইসঙ্গে যে সফলতা আগে পাওয়া যেত তা দেরিতে আসে কিংবা কোন সফলতাই পাওয়া যায় না কখনও কখনও। আমি আশা করব, আগামী বছর অতীত থেকে ব্যতিক্রম হবে। যেটাই হবে আগামী বছরের চমক। তবে...! ভ্যাট প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ড. খলীকুজ্জমান বলেন, ভ্যাট তো ভোক্তার দেয়। এটা নিয়ে ব্যবসায়ীদের হইচই করার কিছু নেই। নতুন ভ্যাট আইন যাতে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় আমি সেই পক্ষে। ১৫ শতাংশ তো চলেই এসেছে, এতে হয়তবা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে খানিকটা প্রভাব রাখতে পারে, তবে তেমন কিছু হবে না বলে আমি মনে করি। ঘোষিত বাজেটের ব্যতিক্রম উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাজেটে সূচিত অগ্রগতি ধরে রাখা এবং ত্বরাণি¦ত করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। ঘাটতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ষাটের দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই ছাত্র বলেন, ৫ শতাংশ ঘাটতি সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য। ঘাটতি নিয়ে কোন সমস্যা নেই, যেহেতু এটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। একটু থেমে হেসে হেসে বলেন, তবে ঘাটতি না থাকাই ভাল। আর প্রবৃদ্ধি বিষয়ক অপর এক প্রশ্নের জাবাবে প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজেট যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় তবে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে কোন সমস্যা দেখি না।
×