ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সামাজিক যোগাযোগ এবং কমিউনিটি ব্যাংকিং প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ২ জুন ২০১৭

ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে সামাজিক যোগাযোগ এবং কমিউনিটি ব্যাংকিং প্রয়োজন

(শেষাংশ) লিডবিরটর (১৯৯৭) অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সামাজিক উদ্যোক্তা উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। তার এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। যখন কোন উদ্ভাবন ঘটে থাকে, তখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এ উদ্ভাবনী শক্তিকে মানুষ যদি তার ও সমাজের উন্নয়ন কর্মকা-ে পরিচালিত করে তবে তা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। আবার খারাপ কাজে ব্যবহার করলে তা কিন্তু হিত সাধনের বিপরীতে ভিন্নমুখিতা দেয়। ফোলরি (২০১১)-এর দেখেছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক সঞ্চয়ের মাধ্যমে যারা এ ব্যবস্থার বাইরে আছেন তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর তাৎপর্য বহন করে থাকে যারা এ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত তাদের তুলনায়। তিনি আরও দেখিয়েছেন, চলে আসা সেফটি নেট ব্যবস্থা এবং সামাজিক কল্যাণের ফলাফল প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক বাজার ব্যবস্থার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। লিউ (২০১৬)-এর দেখিয়েছেন যে, ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকিংয়ের অতিরিক্ত খরচ কাম্য নয়। যদিও ক্ষুদ্র সঞ্চয় (যারা ব্যাংকিং সেক্টরের আওতায় নয়) তাদের উপকার সাধন করে থাকে। সরকার ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের সাবসিডি দিয়ে থাকে এবং ব্যাংকিং সেক্টরের ডিরেগুলেশনের মূল্যায়নও করেছে। শাম্মী আকতার (২০১৬)-এর মন্তব্য করেছেন যে, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড চিরস্থায়ী নয়, তথাপি সম্ভাবনার সুযোগও সীমিত। সময়ের পরিবর্তনে বয়স কাঠামো পরিবর্তিত হবে। যুব জনগোষ্ঠী বয়স্ক নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে, উৎপাদনশীলতা কমে যাবে, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সেবা খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আসলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ঠিকমতো নিতে না পারলে তা পরিণত হবে ডেমোগ্রাফিক বিস্ফোরকে। ১.৩৭% জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো দরকার এবং বিশেষ করে নিম্নবিত্তের সন্তান-সন্তুতির হার অনেক বেশি। কধহধহধরিনড়ড়হংড়স ধহফ অষর (২০১৬) বলেন যে, আরও নিবিড় ও বাস্তবমুখী নীতি বিশেষ করে স্বপ্রণোদিত উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক উদ্যোগ উন্নয়নের জন্য উন্নত করা উচিত। গবেষণা থেকে অভিজ্ঞতার আলোকে তারা মন্তব্য করেন যে, গ্রামীণ দরিদ্র সংগঠিত এবং স্বনিয়ন্ত্রিত কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন যা সামাজিক কল্যাণ এবং চধৎবঃড় ঙঢ়ঃরসধষরঃু নিশ্চিত করছে এমনভাবে এক সঙ্গে কাজ করছে। এছাড়াও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ অগ্রাধিকার এবং অন্তর্ভুক্তি পাওয়া উচিত দারিদ্র্য বিমোচন, সরকারী-বেসরকারী ও বিদেশী কৌশলগত মিত্রতার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ যা উন্নয়নশীলের দেশের জন্য প্রয়োজন হচ্ছেÑ দেশের ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরিকরণ যাতে মানুষের যোগ মূল্য সংযুক্ত হয়। বস্তুত, আখতার হামিদ খানের করা কুমিল্লা কো-অপারেটিভ মডেল তিন স্তর বিশিষ্ট হলেও এ ব্যবস্থায় মানুষের শোষণের মাত্রা সীমিত ছিল। অথচ এখন পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের কাঠামো সংস্কার সাধন এবং যোগ্য লোক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে নানা বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্রদের সুদের একটি বিশাল বোঝা ফেলে থাকে। নিম্ন জীবনযাত্রার ঘূর্ণায়মান চক্র ছেড়ে তারা কোথায় যাবেÑ সুতরাং ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য মোকাবেলার জন্য একটি সমাধান হতে পারে না। ‘দারিদ্র্য সব সময় চাপ দ্বারা ভারগ্রস্ত হয়ে সুদ শোধ করে থাকে। ফলে অধিক সুদে অনেক ক্ষেত্রেই অন্য এনজিও থেকে ধার নিয়ে শোধ করে থাকে।’ অবশ্য পূর্বতন মহাজনী ব্যবসা কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু সংখ্যক এনজিও গ্রহণ করেছে। দারিদ্র্য বিমোচনে বর্তমান সরকারের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজস্ব স্বকীয়তায় বলিয়ান হয়ে তথা সংরক্ষণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘আমরা সব দরিদ্র পরিবারের আয় এবং তা যাতে যথেষ্ট সংরক্ষণ করা যায় সে ব্যাপারে উদ্যোগী। সঞ্চয়ে উৎসাহিত করার জন্য অভিপ্রেত যা করণীয় ছিল তা করতে চাই। বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর আস্থাভাজন চক্রকে অতি তৎপরতা থেকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। রাজনৈতিক দর্শনই বর্তমানে সামাজিক পুঁজি গড়ে উঠতে সহায়তা প্রদান করছে যা জনমানুষের বহুমুখী দারিদ্রতা থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হচ্ছে। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, নৌপথ চালুকরণ, নদীতে ড্রেজিং ঠিকমতোকরণ, বায়ু দূষণমুক্ত রাখাসহ অবশ্যই সামাজিক উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও সুষম বণ্টন ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের সংখ্যা যেভাবে হ্রাস পাচ্ছে তা বস্তুত সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের পাশাপাশি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আট ধাপ অবস্থান উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। কমিউনিটি ব্যাংকিং তৃণমূল পর্যায়ে করা গেলে গতিময়তা পাবে। এক্ষেত্রে আমাদের গ্রামীণ এলাকার পোস্ট অফিসগুলোকে এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে কমিউনিটি ব্যাংকিংয়ে স্বেচ্ছায় একই অঞ্চলে বসবাসরতদের জন্য ব্যাংকিং উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন এবং রেগুলেটার নির্ধারণ করা দরকার। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় সামাজিক বুদ্ধিমত্তা। রিগো (২০১৪) মন্তব্য করেছেন যে, সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে চলার মতো গুণ এবং সমাজের অন্যদের সঙ্গে একীভূতভাবে কর্মসম্পাদন করার ক্ষমতা বোঝার দরকার রয়েছে। রিগোর এ বক্তব্য অতিশয় তাৎপর্যম-িত। আমরা যদি মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখব, অগ্রসরমান জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে সামাজিক বুদ্ধিমত্তা একটি অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আসলে যুথবদ্ধভাবে সমাজে বাস করতে গেলে সামাজিক বুদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন হয় যা সমাজের নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ ভাল না হলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর শক্তিশালী গ-ি ভাঙ্গা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এবং ডাকঘরসমূহের মাধ্যমে বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে দেশের উন্নয়নে অন্তর্ভুক্তি ঠিক থাকবে এবং ব্যাংকিং বিধানসমূহ মেনে স্বল্প খরচে এলাকাভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তবে দেখব, পারমাণবিক বোমা উদ্ভাবনের পর নাগাসাকি ও হিরোশিমাতে তা মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আবার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের মাধ্যমে জনকল্যাণে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে সামাজিক উদ্যোক্তারা সমাজে দক্ষতা, কার্যকারিতার মাধ্যমে যোগ মূল্য সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়ে থাকে। এ কারণে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের অবশ্যই যাতে বিনিয়োগ করে পুঁজি সংগ্রহ করে কর্মসংস্থান স্বল্প পরিসরে করা যায় সে উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমানে সরকার ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ওপর জোর দিচ্ছেন। এটি সামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একত্রিত করে সামাজিক পুঁজিতে রূপান্তর ও পাশাপাশি মানব পুঁজি এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন, কর্মদক্ষতা ও কার্যকারিতা পরিদর্শন করা সম্ভব হয়। ক্ষুদ্র সঞ্চয় পরিণত হতে হবে পুঁজি গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে। সামাজিক উদ্যোক্তাকে অবশ্যই সামাজিক উন্নয়নে জনগণের প্রয়োজনের নিরিখে স্বল্পমূল্যে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এ জন্য সরবরাহজনিত সমস্যা দূরীভূত করতে হবে। ক্ষুদ্র সঞ্চয়-ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার আয় প্রবাহ বাড়ানো এবং পাশাপাশি ভোগ ব্যবস্থায় উন্নতকরণ দরকার। সামাজিক পুঁজি, সামাজিক ব্যবসা এবং সামাজিক বুদ্ধিমত্তা যখন মানুষের হিত সাধনে এক সঙ্গে কাজ করে তখন মানুষ সমস্যামুক্ত হয়। সঞ্চয় সরবরাহজনিত ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মাঝখান থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করছে। তারপরও ৩০-৪০ বছর আগে কৃষক, মৎষ্যজীবীসহ অন্যান্য পেশার লোকের আগের মতো ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই বণ্টন ব্যবস্থাকে সুষম ও জনমুখী করার প্রয়োজন রয়েছে। নচেৎ এ ব্যবস্থাপনায় যে ত্রুটিসমূহ চিহ্নিত হবে প্রকারান্তরে তা বাজার ব্যবস্থাপনার সব ত্রুটিবিচ্যুতিকে দূর করবে না; বরং তথ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা বহাল থাকবে। এ জন্য অবশ্য সরকার মধ্যস্বত্বভোগীদের দূর করার প্রয়াসও গ্রহণ করেছে এবং সরাসরি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থাপনায় জোর দিচ্ছে। ধীরে ধীরে গ্রামীণ অর্থনীতি যত শক্তিশালী হচ্ছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপাদানসমূহ তত নানামুখী পরিবর্তনশীলতার মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা কাজ করে থাকে এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সুযোগ পাচ্ছে। সঙ্গে সামাজিক শিক্ষা-মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ, সুকুমার প্রবৃত্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে জাগ্রত করে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় ক্ষমতায়ন, ক্রয়ক্ষমতা এবং সামাজিক উদ্যোক্তা একত্রিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থাপনাকে একটি দেশের উন্নয়নে কাজ করে অতি দারিদ্র্য কিংবা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি দেয়। এ ক্ষেত্রে মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের অথবা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অথচ সহস্রাব্দ বছর পূর্বে প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, মিত্র এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সচরাচর সামাজিক যোগাযোগ নির্ভর করত দেখা-সাক্ষাত মাধ্যম হিসাবে। বর্তমানে বিশ্বায়নের এ যুগে বিশ্ব একটি ছোট গ্রামে পরিণত হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। কমিউনিটি ব্যাংকিং ভিন্ন পন্থায় যারা এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় আতে সহায়তা করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালীকরণ, ভৌত অবকাঠামো সুসংহতকরণ এবং জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে সম্পৃক্তকরণ করা। তবে সামাজিক মাধ্যম যেন নারী ও শিশুদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। (সংক্ষেপিত) লেখক : শিক্ষাবিদ
×