ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ও ভারতে কম্বিং অপারেশন;###;দুই দেশের মধ্যে চুক্তির দুই বছরের মধ্যে আশাতীত সাফল্য

জাল মুদ্রার প্রবাহ কমে গেছে, শূন্যের কোঠায় নামতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩১ মে ২০১৭

জাল মুদ্রার প্রবাহ কমে গেছে, শূন্যের কোঠায় নামতে পারে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও চোরাচালান সংক্রান্ত চুক্তির দুই বছরের মধ্যে আশাতীত সাফল্য এসেছে। যা দুুই দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চুক্তির পর থেকে দুই দেশেই জালমুদ্রার প্রভাব কমিয়ে আনতে কম্বিং অপারেশন চলছে। এক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত তথ্য আদান প্রদান হচ্ছে। বাংলাদেশে চলমান অভিযানে জালমুদ্রার কারবারিদের গ্রেফতারের সংখ্যা মাসে ৬০ জন থেকে কমে ১০ জনে নেমে এসেছে। পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর আরও সতর্কতা অবলম্বন, সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফের যৌথ টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি, বিমানবন্দরে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে জালমুদ্রার প্রবাহ দিন দিন দুই দেশেই কমে যাচ্ছে। জঙ্গীরাই সবচেয়ে বেশি জালমুদ্রা তৈরি করে থাকে। বাংলাদেশ ও ভারতে জঙ্গী বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকায় জালমুদ্রা তৈরিকারক জঙ্গীরা গ্রেফতার হচ্ছে। ফলে জালমুদ্রার আগ্রাসন কমে গেছে। অভিযানের মুখে তৈরিকারক জঙ্গীদের অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছে। জালমুদ্রার প্রধান হোতা হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানীদের বাংলাদেশে যাতায়াতের ওপর বিশেষ বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশকে জালমুদ্রা পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে না এর সঙ্গে জড়িতরা। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরমধ্যে ১৪ নম্বর চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে। ওই চুক্তি হওয়ার পর থেকেই দুই দেশেই জাল মুদ্রার কারবারিদের ধরতে কম্বিং অপারেশন চলছে। এ সংক্রান্ত তথ্য দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে নিয়মিত আদান প্রদান হচ্ছে। ভারতের দেয়া তথ্য মোতাবেক দেশে অন্তত ১৫টি অভিযান হয়েছে। আবার বাংলাদেশের দেয়া তথ্য মোতাবেকও বহু অভিযান ভারতে পরিচালনা করেছে সে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছরে অন্তত সাড়ে ৫শ’ দেশী-বিদেশী জালমুদ্রা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। যারমধ্যে অন্তত সাড়ে ৪শ’ বিদেশী। এদের অধিকাংশই আফ্রিকান। উদ্ধার হয়েছে দেশী-বিদেশী বিপুল অঙ্কের জালমুদ্রা এবং জালমুদ্রা তৈরির সরঞ্জাম। জাল মুদ্রার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জালমুদ্রা সংক্রান্ত চুক্তির পর অভিযান আরও বাড়ানো হয়েছে। গত দুই বছর ধরে জালমুদ্রার কারবারিদের তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। গ্রেফতারের হারও আগের তুলনায় অনেক কম। যা জালমুদ্রার আগ্রাসন কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। জালমুদ্রা কারবারিদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে জানিয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে জানান, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী প্রায় ১৮শ’ জাল মুদ্রা কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রায় ৭ কোটি জালটাকা ও সমপরিমাণ জাল টাকা ছাপানোর সরঞ্জাম, ৫ কোটি জাল ভারতীয় রুপী, ৪ লাখ জাল ইউএস ডলারসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা। জাল মুদ্রা আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের বিধান রয়েছে। দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত থাকলে জালমুদ্রার প্রভাব দিন দিন কমে যাবে। পুলিশ ও বিজিবি সদর দফতর সূত্রগুলো বলছে, জালমুদ্রা সংক্রান্ত ঘটনায় এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে আড়াই হাজার গ্রেফতার হয়েছে। যার মধ্যে গত কয়েক বছরে গ্রেফতার হয়েছে সাড়ে ২৩শ’। আর বিগত দুই বছরে গ্রেফতার হয়েছে দুইশ’। যা আগের যেকোন বছরের তুলনায় অনেক কম। প্রতিমাসে জালমুদ্রা সংক্রান্ত ঘটনায় গ্রেফতারের হার গড়ে ১০ থেকে ১২ জন। যা আগে ছিল এর অন্তত পাঁচগুণ বেশি। বাংলাদেশের ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ থেকে হালনাগাদ জালনোট সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ মামলাই ২০১৫ সালের আগে দায়েরকৃত। ২০১৫ সালের পর মামলা হয়েছে মাত্র প্রায় আড়াই শ’। জাল মুদ্রার সঙ্গে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ৯টি শাখার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে ইতোপূর্বে জালনোটের গোপন লেনদেনও ধরা পড়েছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ৪ জন উর্ধতন কর্মকর্তাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, জালমুদ্রার কারবার ঠেকাতে নিয়মিত মনিটরিং চলছে। প্রতিটি ব্যাংকে এ সংক্রান্ত নোটিস জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে জালমুদ্রা বিশেষ করে জালটাকা চেনার উপায় সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। মুদ্রা লেনদেনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জালমুদ্রা শনাক্তকরণ বুথ স্থাপন ছাড়াও নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি যৌথ টাস্কফোর্স রয়েছে। টাস্কফোর্সটি জালমুদ্রার নানা বিষয় মনিটরিং করে। জালমুদ্রায় জঙ্গী অর্থায়ন ও চোরাচালানসহ নানা বিষয়ে তারা নিয়মিত মনিটরিং অব্যাহত রেখেছেন। এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চুক্তির পর দুই দেশের নানা তৎপরতার কারণে এখন মাসে ১০/১২ জন জালমুদ্রার কারবারিও গ্রেফতার হয় না। অথচ আগে মাসে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন গ্রেফতার হতো। চুক্তির পর থেকে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে ভারতের সঙ্গে। বৈঠকে পাকিস্তানের জালমুদ্রা কারবারিরা অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ ও ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি, দ্ইু দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল করে দেয়া এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটনানোর লক্ষ্যে জালমুদ্রা পাচার করে থাকে বলে বার বার আলোচিত হয়েছে। এরসঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র আছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সর্বশেষ বাংলাদেশে পাকিস্তানী কূটনীতিক ফারিনা আরশাদ ও মাযহার খানকে জালমুদ্রা ও জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধিতে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রত্যাহার করার পর বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায়। সিআইডির সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ ও ভারতে উদ্ধার হওয়া জালমুদ্রার অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে আসা। জেএমবি, পাকিস্তানী ও ভারতীয় জঙ্গী গোষ্ঠী নিখুঁত জালমুদ্রা তৈরিতে সক্ষম। যা ল্যাবরেটরিতেও ধরা পড়ে না। এরমধ্যে পাকিস্তানে তৈরি ভারতীয় জালরুপী অত্যন্ত নিখুঁত। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জঙ্গীরা জড়িত। বাংলাদেশে ও পাকিস্তানী জাল মুদ্রা কারবারি এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ উত্তর প্রদেশের ছাছানি থেকে প্রায় ১৫ লাখ জালরুপীসহ ভারতীয় মুজাহিদীন ইয়াসিন বকতালকে গ্রেফতারের পর জঙ্গীদের নিখুঁত জালমুদ্রা তৈরির বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। পাকিস্তানের তৈরি জালমুদ্রা বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশ করানো হতো। ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করার পর বাংলাদেশে জালমুদ্রার প্রচলন অস্বাভাবিক হারে কমতে শুরু করেছে। জালমুদ্রার চক্রগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। জঙ্গী অর্থায়ন ও চোরাচালানে জালমুদ্রা ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ভারতীয় জালরুপী তৈরি হয়ে তা বাংলাদেশের যশোর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, শেরপুর ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করানো হতো বলে অভিযোগ ছিল। এখন সে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানা স্থাপনের অর্থের একটি বড় যোগান এসেছিল জালমুদ্রা থেকে। জালমুদ্রা জেএমবির অর্থের অন্যতম উৎস বলে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) এবং দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে। ভারতীয় মুজাহিদীনদেরও অর্থের অন্যতম উৎস জালরুপী। এসব জালমুদ্রা সীমান্ত পথে আদান প্রদান হয়। এজন্য চোরাচালানপ্রবণ স্থল সীমান্তে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেসব সীমান্তে পয়েন্টে জালমুদ্রা পাচার হয়, সেসব সীমান্ত ভারত সরকারের তরফ থেকে যে সময়ে চোরাচালান হয়, সেই সময়ে প্রকার সীল করে দেয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব পয়েন্টে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ (বিজিবি) সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ (বিএসএফ) সেদেশটির সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই যৌথ টহল ও স্থায়ী চেকপোস্ট বসানোর প্রস্তাব রয়েছে। এসব পয়েন্টে নির্দিষ্ট সময়ের পর অনেকটা কার্ফ্যু জারির বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলছে দুই দেশের মধ্যে। ভারতের রাজস্ব মহাপরিচালকের গোয়েন্দা পরিদফতরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, জালরুপী ভারতীয় অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। জালরুপীর কারণে ভারতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে। এর কারণে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের যোগসূত্র বাড়ছে। জালমুদ্রার অধিকাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে চোরাচালানের ক্ষেত্রে। চোরাচালানের পণ্য বেচাকেনার সূত্র ধরে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইউএই ও মালয়েশিয়া থেকে ভারতে জালরুপী প্রবেশ করছে। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে দেশগুলোকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে ভারতের তরফ থেকে। এ ব্যাপারে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (সংঘবদ্ধ অপরাধ) নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবব্দুল্লাহেল বাকী জনকন্ঠকে বলেন, দুই দেশের সরকারের সদিচ্ছার কারণে এবং কম্বিং অপারেশন চলমান থাকায় বাংলাদেশে জালমুদ্রার প্রবাহ কমে গেছে। ভারতেও জালমুদ্রার প্রভাব হ্রাস পেয়েছে বলে সেদেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তাদের জানিয়েছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও ভারতে জালমুদ্রার আগ্রাসন শূন্যের কোটায় চলে আসবে। দুই দেশের সরকারই জালমুদ্রা প্রতিরোধে রীতিমত কড়াকড়ি আরোপের সঙ্গে সঙ্গে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রতিটি ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একসঙ্গে কাজ করছে। চুক্তি বাস্তবায়নে দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ ও অভিযান অব্যাহত আছে।
×