ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম দিনই জমজমাট চকবাজার

বাহারি খাবারের পসরা, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৯ মে ২০১৭

বাহারি খাবারের পসরা, পুরান ঢাকার ঐতিহ্য

মোরসালিন মিজান ॥ রোজার সঙ্গে উদরপূর্তি করে খাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। একজন রোজাদার সূর্যদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্থ পর্যন্ত অভুক্ত থাকেন। বর্জন করেন যাবতীয় ভোগবিলাস। এই চর্চার মধ্য দিয়ে সংযমের শিক্ষা গ্রহণ করেন। অনাহারী মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। সিয়াম সাধনার এই মৌলিক উদ্দেশের কাছে ইফতার তাই গৌন। গৌন বিষয় হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায়শই তা হয় না। সারাদিন না খেয়ে থাকার পর অনেকেই ভাল কিছু, বিশেষ কিছু খেতে চান। এই ভাল এবং বিশেষ খাবারের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ চকবাজারে। পুরনো ঢাকার বিপুল-বিশাল আয়োজন এখন ঐতিহ্যের অংশ। মুঘলদের খাবার। নবাবদের ভোজনবিলাসের সংস্কৃতি। এখনও ধরে রেখেছেন প্রবীণ বাবুর্চিরা। বর্তমানে ঘরোয়া আয়োজনে চকবাজারের দু’চার আইটেম রাখা প্রায় আবশ্যক হয়ে গেছে। প্রথম রোজার দিন তো চকের ইফতার না হলেই নয়। পুরান ঢাকার মানুষ জোহরের নামাজ শেষ করেই বাজার দেখতে বের হয়ে পড়েন। দূর-দূরান্ত থেকেও আসেন রোজাদাররা। পছন্দের ইফতারসামগ্রী কেনে বাড়ি ফেরেন। সব মিলিয়ে অন্য রকম আবেদন নিয়ে হাজির হয় চকের ইফতার। রমজানের প্রথম দিন রবিবার এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, দারুণ জমে উঠেছে বাজার। সরু গলি দিয়ে অন্য সময় গাড়ি, রিক্সা সবই চলে। এখন সেখানে দেড় শ’র মতো অস্থায়ী দোকান। চুলা জ্বালিয়ে চোখের সামনেই তৈরি করা হচ্ছে ইফতার সামগ্রী। গরমাগরম অবস্থায় বেচাবিক্রি! বাহারি খাবার। তেমনি আকর্ষণীয় উপস্থাপনা। চেনা, অল্প চেনা ও অচেনা খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে গোটা এলাকায়। ক্রেতার উপস্থিতি এত যে, পা ফেলা মুশকিল হয়ে যায়। চকবাজারে ছোলা থেকে শুরু করে আচার পর্যন্ত সাজানো। দারুণ স্বাদের সঙ্গে আভিজাত্য যোগ হওয়ায় এসব খাবার আর সাধারণ থাকে না। জিলাপির কথাটাই আগে হোক। শাহী জিলাপি। চোখের সামনে ভাজা হচ্ছে। সব সময় দেখা জিলাপির চেয়ে আকারে অনেক বড়। বিশাল। গায়ের রঙটাও আকর্ষণীয়। বেশ কয়েকটি দোকানের পেছনের অংশে ফুটন্ত কড়াই। হাঁটু ভেঙ্গে বসে ডুবোতেলে প্যাঁচ কষছিলেন কারিগররা। কখনও পাঁচ প্যাঁচ। কখনও ছয় থেকে সাতটি। মুরাদ মিয়া নামের এক কারিগর বললেন, সবচেয়ে ছোট জিলাপি হয় আড়াই প্যাঁচের। আর বড় জিলাপি ২০ প্যাঁচের। প্রতিটি জিলাপির ওজন এক কেজি থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয় বলে জানান তিনি। পেছনের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শাহী জিলাপি রাজা-বাদশা গো আমলের। হেগোর তো দিল আছিল বড়। মুখে স্বাদও আছিল। খাওয়াখাদ্য বেশি খাইতে পারত। এত বড় কন? এর চেয়ে বড় জিলাপি কয়েকটা খাইয়া ফালাইত।’ এভাবে নিজের মতো করে বলে যান কারিগর। বলতেও, বোঝা যায়, ভাল লাগছে তার। অবশ্য চকের প্রধান আকর্ষণ নানা রকমের কাবাব। বিখ্যাত সুতিকাবাব, জালিকাবাব, টিকাকাবাব, মুঠি কাবাব, এ্যারাবিয়ান কাবাবÑ কী নেই? তবে চকে আসলে একটি কাবাবের নাম বার বার শুনতে হয়। নামটি ‘বড় বাপের পোলায় খায়।’ প্রতিবারের মতোই দোকানিরা হাঁকডাক করে বিক্রি করছিলেন। তাদের বলাটি এ রকমÑ বড় বাপের পোলায় খায়/ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়। জাহাঙ্গীর নামের এক দোকানি বয়সে তরুণ। বললেন, এলাকার বড়লোকরাই বেশি খাইত। সেজন্য নাম হইছে ‘বড় বাপের পোলায় খায়। আমাগো বাপ-দাদারা এইটা বানাইত। এহন ধরেন আমরা বানাই।’ আরেক দোকানির কাছ থেকে জানা যায় রেসিপি। গরুর মগজ, কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, গিলা-কলিজা-ডিম, আলু, ঘি, কাঁচামরিচ, শুকনো মরিচ, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ২৪ পদের মসলা দিয়ে এটি তৈরি করা হয়! তার পর পিতলের বড় থালায় সবকিছু মাখিয়ে নিয়ে ঠোঙায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছিল। সুতিকাবাবও খুব আকর্ষণীয়। মোটা পাইপের মতো দেখতে। কাবাবের পুরোটা সুতো দিয়ে প্যাঁচানো। মাঝখানে লোহাড় শিক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। একপাশ থেকে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। জানা গেল, ৩০ বছর ধরে সুতিকাবাব তৈরি করেন হান্নান মেম্বার। বললেন, এহন অনেকেই বানায়। মাগার আসলডা পাইবেন আমার কাছে। আমরা পুরানা লোক। কোন কোন দোকানি খাসির রান দিয়ে লেগ রোস্ট তৈরি করে নিয়ে এসেছেন। মাংসের ওপর সালাদ গেঁথে দেয়া হয়েছে। কিছু সময় পর পর উপর থেকে ঢেলে দেয়া হচ্ছে তরল মসলা। ছোট ছোট পাখিও রোস্ট করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘ভিজা রোস্ট।’ কবুতরের রোস্ট আছে। তার চেয়ে বেশি কোয়েল। পাখির এমন কাবাব হতে দেখে কারও কারও খারাপ লাগে বৈকি! তবে বেচা-কেনা থেমে নেই। চকের ‘আনাম খাসিও’ খুব নজর কাড়ে। বিশেষ কায়দায় আস্ত খাসি রোস্ট করে ফেলা হয়। টেবিলের ওপর ভাস্কর্যের মতো বসে থাকে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, জীবন্ত! আসলে তা নয়। দেহের আদল ঠিক থাকলেও এটি সুস্বাদু কাবাব। অবশ্য এবারও প্রথম রোজায় আনাম খাসির দেখা মিলল না। পরবর্তী রোজায় হয়ত পাওয়া যাবে। বাজার ঘুরে আরও দেখা গেল তেহারি, মোরগ পোলাও, কাচ্চি, কিমা পরটার দোকান। শাকপুলি, ডিমচপ, বিভিন্ন ধরনের কাটলেট আছে। দই বড়া, মোল্লার হালিম, নূরানি লাচ্ছি, পনির, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, কাশ্মীরী শরবত, ছানা মাঠাও বেশ চলছে। কিছু খাবার আবার একদমই সাধারণ দেখতে। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন দিতে দেখা যায়। তেমন একটি খাবারের নাম কাচুরি। ছোট পুড়ির মতো দেখতে। ময়দা দিয়ে তৈরি কাচুরি তেলে ভাজা হচ্ছে। কাজটি করছিলেন মাঝবয়সী কারিগর মানিক। জনকণ্ঠককে তিনি বলেন, কাচুরির ভেতরে ঘুমনি সালাদ টক দই ইত্যাদি দিয়ে খেতে হয়। পুরনো ঢাকার মানুষ বহুকাল ধরে মজা করে এই খাবার খাচ্ছেন। রমজান ছাড়া সারাবছর এটি কোথাও পাওয়া যায় না। ৪৫ বছর ধরে কাচুরি তৈরি করছেন বলে জানান মানিক। চকের এখানেওখানে আরও সাজানো আছে দইবড়া, ফালুদা, মাঠা, লাবাং ইত্যাদি পানীয়। আর ছোলা-মুড়ি, তা না থাকলেই নয়। অসংখ্য আইটেমের ইফতার বাজার থেকে যার যা পছন্দ কিনছিলেন। পাশের মসজিতে নামাজ পড়তে আসা আমিরুল ইসলাম ফেরার পথে পছন্দের ইফতার সামগ্রী কিনছিলেন। বললেন, আমরা ছোটবেলা থেকে এই চকের ইফতার দেখে আসছি। এখন তো বয়স ষাট। এখনও আসি। কিছু আইটেম শুধু চকেই পাওয়া যায়। সেগুলো কিনে নিয়ে যাই। সোহেব এসেছিলেন গুলশান থেকে। এতদূর থেকে এখানে? কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আমরা পুরান ঢাকায় ছিলাম। তখন চকের ইফতার দিয়ে রোজা শুরু করতাম। এখনও বাসার মুরব্বিরা চকের ইফতার খুব পছন্দ করেন। তাই এতদূর থেকে পুরান ঢাকায় আসা বলে জানান তিনি।
×