ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবাদের ভাষা হোক পরিশীলিত -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৫ মে ২০১৭

প্রতিবাদের ভাষা হোক পরিশীলিত -স্বদেশ রায়

রাষ্ট্র যাকে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান (একুশে পদক) দিয়েছে চিকিৎসা শাস্ত্রে তার অবদানের জন্য তাকে এক নম্বর আসামি করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো, চিকিৎসাবিদ্যায় যাদের কোন শিক্ষা নেই তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে। ঘটনার পরদিন থেকে যার সঙ্গেই কথা হয়েছে, তাকেই বলতে শুনেছি, ছাত্ররা না হয় ছোট মানুষ। তারা কিশোর। তাদের রক্ত গরম। প্রক্টর কেস করলেন কীভাবে? তিনি কোন্ বিদ্যার বলে বুঝতে পারলেন ডাঃ আবদুল্লাহ ভুল চিকিৎসা করেছেন? মাঝে মাঝে আমাদের সমাজে এমন কিছু ঘটে যা সত্যি গোটা সমাজের চিন্তা-ভাবনা, মেধা-মননকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো বিদ্যাবুদ্ধি আমাদের নেই। আমরা সাধারণ সাংবাদিক মাত্র। তবে তার পরেও ওই কেসের বাদীকে তার মনের কাছে প্রশ্ন করতে বলব, তিনি কীভাবে বুঝলেন প্রফেসর আবদুল্লাহ ভুল চিকিৎসা করেছেন? আবার যে জজ সাহেব কেস নিয়েছেন, তার প্রতি বিনীত অনুরোধ রাখা যায়, এটা সমন দেয়ার মতো না তদন্ত করার নির্দেশ দেয়ার মতো? জজ সাহেবের নিঃসন্দেহে ক্ষমতা ছিল বাস্তবে এটা যথাকর্তৃপক্ষকে তদন্তের নির্দেশ দেয়ার। কিন্তু আমরা সবাই কেমন যেন হয়ে যাই মাঝে মাঝে। সাংবাদিক প্রয়াত শফিকুল আজিজ মুকুল বলতেন, আমাদের জাতীয় চরিত্রে কখনও ফ্যানের রেগুলেটরকে মাঝামাঝি রাখার অভ্যাস নেই। আমরা হয় ফ্যানকে একেবারে শেষ প্রান্ত অর্থাৎ পাঁচে দেই, না হয় একে দেই। আসলে সুস্থতা আমাদের সমাজে ও জাতীয় চরিত্রে বড় কম। বাঙালীর চরিত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কখনই বড় কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। তিনি শুধু এই বলেননি, রেখেছো বাঙালী করে, মানুষ করোনি। তিনি এও বলেছেন, বাঙালীর মধ্যে ভুলক্রমে দুই একজন মানুষ জন্মিয়া যায়। বাঙালীর মধ্যে মানুষ জন্মে গেলে তাকে দুর্ভোগ কিছু পোহাতে হয়। প্রফেসর ডাঃ আবদুল্লাহর মতো মানুষ হওয়া যথেষ্ট কষ্টের। তিনি রোগীর প্রতি যে মমত্ব দিয়ে সরকারী হাসপাতালের বেডে বা আউটডোরে নয়, নিজের রুমে একের পর এক সাধারণ মানুষ, দরিদ্র মানুষকে দেখেন তা কল্পনা করা যায় না। ডাঃ আবদুল্লাহ কত বড় ডাক্তার, কত বড় মানুষ তা আমার মতো একজন সাংবাদিককে নতুন করে বলার কোন দরকার নেই। রাষ্ট্র তাকে সে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে একজন সাংবাদিক হিসেবে, একজন রিপোর্টার হিসেবে রোগীর ভুল চিকিৎসার দাবি তুলে বহু ভাংচুরের ঘটনা এ জীবনে দেখেছি। যারা ভাঙ্গে তারা তখন উন্মাদ থাকে। তাদের ভেতর স্বজন হারানো বেদনা ক্রোধে রূপ নেয়। আর বাঙালীর যেহেতু ক্রোধ বেশি, যেহেতু বাংলা ভাষায় গোঁয়ার শব্দটি আছে- তাই বাঙালী তার সদ্ব্যবহার করে। আমার জীবনে আমি যতগুলো ভাংচুর দেখেছি বেশিরভাগ ঢাকা মেডিক্যালে। কারণ, একজন রিপোর্টার হিসেবে মৃত্যু বা বিভিন্ন তথ্য কনফার্ম করার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে যেতে হয়েছে। সেখানেও বেশ দুই-তিনটা ভাংচুর আমি দেখেছি আশির দশকে। একটা বা দুটো দেখেছি ন্যাশনাল মেডিক্যালে ও মিটফোর্ডে। সব ক্ষেত্রে যা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে দেখেছি, রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় আনা হয়েছে এবং ডাক্তাররা যথাব্যবস্থা নিয়েছেন। সাধারণত ইমার্জেন্সিতে এসব ঘটনা ঘটেছে। তরুণ ডাক্তাররা চিকিৎসা শুরু করেন প্রথম। তারপরে তাদের শিক্ষকদের বা সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলেন। তরুণ ডাক্তাররা যে চিকিৎসাটি দেন সেটা মূল চিকিৎসা নয়। প্রাথমিক। তখন তারা অনেক কথাও বলেন, যা পরবর্তীতে ঠিক হয় না। যেমন আমার নিজের কথা বলি। তখনও আমাদের ভালবাসার পুরনো ঢাকাতেই বাস করি। খুব ভোরে পেটে প্রচ- ব্যথা উঠলে ন্যাশনাল মেডিক্যাল হাসপাতালে যাই। জুনিয়র ডাক্তাররা সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি হতে বলেন। ভর্তি হলে তারা স্যালাইনসহ আনুষঙ্গিক কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাদের সিনিয়রের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ল্যান্ডফোন ছাড়া তখন অন্য কোন ফোন ছিল না। জীবনের বন্ধুটি তখন ওই জুনিয়র ডাক্তারের পাশে। সে শুনতে পায় এদিক থেকে জুনিয়র ডাক্তার বলছেন, এ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথাও হতে পারে। ডাক্তারের ওই কথা শুনে একজন ওয়ার্ডবয় তাকে বলে, আপা ভাইয়ার অপারেশন করা লাগে কিনা? শেষ পর্যন্ত সিনিয়র ডাক্তার এসে অনেক টেস্ট করিয়ে ক্রনিক ডিসেন্ট্রির ওষুধ দিলেন এবং বললেন, কখনও কখনও এ ধররেন ডিসেন্ট্রি থাকলে এ ধরনের ব্যথা হয়। নিজের এ কথাটি এখানে বললাম এ জন্য যে, সেন্ট্রাল হাসপাতালে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানেও মূল চিকিৎসা শুরু হয়নি। সেখানে ঠিক অমনি জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে কেউ একজন বলেছিলেন, জ্বর ও রক্তক্ষরণ হচ্ছে- চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গু না তো? তবে ওই মেয়েটিকে কোন মূল চিকিৎসা তারা শুরু করতে পারেননি। তার আগেই রোগীটি মারা যায়। কারণ রোগীটি ব্লাড ক্যান্সারের শেষ স্টেজে চলে গিয়েছিল বলে ডাক্তাররা দাবি করেছেন। এমনকি তারা এও দাবি করেছেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা তারা শুরু করেননি। বরং রোগীটিকে মুমূর্ষু দেখে তারা আত্মীয়স্বজনকে খবর দেন। যাহোক, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। প্রয়োজনে আরও তদন্ত কমিটি করা হোক। তবে ইতোমধ্যে সোশ্যাল ফোরামসহ মিডিয়ায়ও দেখেছি, কেউ কেউ দাবি করছেন বিচারপতিদের দিয়ে তদন্ত করাতে। যদি ডাক্তারি পেশা থেকে গিয়ে কেউ আইন পড়ে বিচারপতি হন তাকে দিয়ে করা যেতে পারে। কিন্তু যারা শুধু আইনের ছাত্র তাদের দিয়ে করানো উচিত নয়। এ কথা বলছি, একুশে টিভি মামলার অভিজ্ঞতা থেকে। একুশে টিভিকে টেরেস্ট্রিয়াল সুবিধা দেয়ার বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল। যে বিচারকরা বিচার করেছিলেন তাদের টেকনোলজি সম্পর্কে কোন জ্ঞান যে ছিল না তা পদে পদে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। ফতোয়া বা অন্যান্য শরিয়া আইনের মামলার সময় যেমন বায়তুল মোকাররমের খতিবকে আদালতের পরামর্শক হিসেবে ডাকা হয়, একুশে টিভির মামলায় যদি ড. জাফর ইকবাল, ড. কায়কোবাদ এবং জাকারিয়া স্বপনকে আদালতের পরামর্শক হিসেবে টেকনোলজি বোঝার জন্য ডাকা হতো- ওই মামলার রায় ভিন্ন হতো। তাই চিকিৎসাবিদ্যার মতো সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল একটি বিদ্যাতে সাধারণ আইনের ছাত্রকে ডেকে কোন লাভ নেই। তবে তার আগে যে ছাত্ররা ভাংচুর করেছে, ডাক্তারদের গায়ে হাত দিয়েছে তাদের সুস্থ হতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, তাদের ক্ষণিকের ক্রোধ আরও কত মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। যেমন এরশাদের শাসনামলে একদিন ঢাকা মেডিক্যালে রোড এক্সিডেন্ট করা এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হয় মুমূর্ষু অবস্থায়। সিট না থাকায় ফ্লোরে তাকে চিকিৎসা দেয়া শুরু করে। তখন সম্ভবত এগুলো ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে হতো। আমরা সাংবাদিকরাও হরতালের ক্যাজুয়ালিটির খোঁজ নিতে সেখানে যাই। ওই সময়ে রোগীটি মারা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে মারপিট শুরু হয়। নিরাপদ আশ্রয় নিতে হাসপাতালের আরও ভেতরের দিকে ঢুকি। গিয়ে দেখি, ভেতরে অনেক দরিদ্র ঘরের মেয়েরা কান্নাকাটি করছে। কারণ জানতে পারি, মারামারির কারণে ডাক্তার আসতে পারছে না আবার তাদের যে স্বজনরা গিয়েছিল ওষুধ আনতে- তারাও ওষুধ নিয়ে ঢুকতে পারছে না। অথচ প্রসব বেদনায় চিৎকার করছে মেয়েরা। ২৩ তারিখ সেন্ট্রাল হাসপাতালে গিয়েছিলাম ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর নিতে। ডাক্তারদের স্ট্রাইক ছিল। অসহায় অনেক রোগীর মুখ দেখলাম। আবার গ্রীন লাইফে এসে জানতে পারলাম, ভাংচুরের দিন সেন্ট্রালে নাকি অনেক রোগী প্রসব বেদনা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ছিলেন। তাদের অসহায় মুখ আমার পরিচিত কারণ আশির। দশকে ঢাকা মেডিক্যালে আমি দেখেছি। বাস্তবে এই ঘটনা যে শুধু ঢাকায় ঘটে তা নয়, বাংলাদেশের নানা হাসপাতালে ও ক্লিনিকে ঘটে। এর মূল কারণটি ভিন্ন, শুধু যে আমাদের জাতীয় চরিত্র তা নয়, পাশাপাশি রয়েছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পেশেনট এডুকেশন বলে কোন বিষয় নেই। অথচ প্রাইমারী ও হাই স্কুল লেভেলে এটা থাকা উচিত। পেশেনট এডুকেশনের ব্যবস্থা থাকলে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণরা যদি সেই শিক্ষা নিয়ে আসত তাহলে তারা অমন করে আফ্রিকার সিংহের মতো লাফিয়ে পড়ত না, বরং ব্রিটিশ ভদ্রলোকের মতো ভেবে দেখতে পারত, কোথায় কি ভুল হয়েছে। ভুল যে ডাক্তারদের হয় না তা নয়। ভুল হতে পারে। প্রতিটি পেশায় কাজ করতে গেলে ভুল হয়। কখনও কখনও ভুলের মাশুল বড় নির্মম। যেমন ধরা যাক, আমাদের ভুল সাংবাদিকতার জন্য যদি কোন ভদ্রলোকের সম্মানহানির কারণ হয় তা কি তাঁর পরিবারের সকলের জন্য মৃত্যুর সমান নয়? তাই সব পেশারই ভুলের মূল্য বড় বেশি। তবে এটা সত্য ওই যে শিক্ষক বাদী হয়ে কেস করেছেন, তিনি যেমন তার ছাত্রদের ভুল শেখাতে চান না কখনও ইচ্ছাকৃত, তেমনি কোন পেশার কেউই ভুল ইচ্ছাকৃত করে না। ভুল একটি এক্সিডেন্ট। কোন্টা ভুল আর কোন্টা ভুল নয় বা না বুঝে কোন কিছুকে ভুল বলা কোন মতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মানায় না। একজন ডাঃ নুরুল ইসলাম, একজন বদরুদ্দোজা চৌধুরী, একজন আবদুল্লাহ বা একজন প্রাণ গোপাল দত্ত কোন জাতিতে হাজার হাজার জন্মান না। তাই প্রতিবাদের ভাষা তেমনই হওয়া উচিত যাতে আমরা যেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে অপমান না করি। [email protected]
×