ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতা-’ ॥ ফাঁসি হলো না সাঈদীর

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৬ মে ২০১৭

‘ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতা-’ ॥ ফাঁসি হলো না সাঈদীর

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু কারাদ- বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। সাঈদীর ফাঁসি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ এবং সাজা থেকে খালাস চেয়ে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের ওপর সোমবার দ্বিতীয় দিনের শুনানি শেষে দুই আবেদন খারিজ করে এ রায় প্রদান করে আপীল বিভাগ। এর ফলে আপীল বিভাগ সাঈদীর মৃত্যুদ- কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ-ের যে রায় প্রদান করেছিল তা বহাল থাকল। এখন স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বাকি জীবন কারাগারেই কাটাতে হবে ৭৭ বছরের যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে। সকাল নয়টা ১০ মিনিট থেকে শুনানি শুরু করে বেলা এগারোটা পর্যন্ত শুনানি চলে। শুনানি শেষের সঙ্গে সঙ্গে আদালত পিনপতন নীরবতার মধ্যে বেলা এগারোটা উভয় রিভিউ ডিসমিস বলে রায় ঘোষণা করা হয়। এ সময় আদালতে সাংবাদিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ প্রায় কয়েক শ’ আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের করা রিভিউ শুনানি শেষে সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরন্দ্রে কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আপীল বিভাগের বেঞ্চ এ রায় দেয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়জে সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। সাঈদীর খালাস চেয়ে তার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং তার মৃত্যুদ- চেয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করেন। এছাড়া আপীল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রসিকিউশনের বিরুদ্ধে আদালত বিরূপ মন্তব্য করায় ওই অংশ বাদ দেয়ার জন্য প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীর পক্ষে এ্যাডভোকেট এএম আমিনউদ্দিন আবেদন করেন। আদালত আবেদন মঞ্জুর করেছে। প্রসিকিউশনের আবেদন মঞ্জুর করার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, বলতে বাধ্য হচ্ছি প্রসিকিউটর পাবলিক সার্ভেন্ট। কিছু নন-প্রাকটিসিং লয়ার প্রসিকিউটর হয়েছেন। কিছু প্রসিকিউটর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির মিটিংয়েও যাচ্ছেন, যাদের (নির্মূল কমিটির) পলিটিক্যাল এজেন্ডা রয়েছে। তারা কিন্তু মিসকন্ডাক্ট (অসদাচরণ) করছেন। এরা পাবলিক প্রসিকিউটরের পজিশন বোঝেন না। এ মামলা নিয়ে আপীল বিভাগে সাতটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো। আর আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ১৭ মামলা। এর সাতটি রায়ের মধ্যে ছয়টিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাশেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সোমবার আপীল বিভাগ চূড়ান্ত রিভিউয়ের রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সাঈদীর সাজা আমৃত্যু কারাদ- বহাল রেখেছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপীলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আপীল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনে খালাস চেয়েছিলেন সাঈদী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ের রায় পুনর্বহাল চেয়েছিল। রবি ও সোমবার শুনানি শেষে আপীল বিভাগ উপরোক্ত রায় প্রদান করে। রায ঘোষণার পর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সাঈদী দেশ, সভ্যতা ও মানুষের জন্য ‘ক্ষতিকর’ ব্যক্তি। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতা ও দুর্বলতার কারণে সাঈদীকে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। সাঈদী যুদ্ধাপরাধীদের শিরোমণি, তার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যথিত।’ সাঈদীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতের রায়, তাই ক্ষোভ-দুঃখ যাই থাকুক না কেন, রায় মেনে নিতে হবে।’ অন্যদিকে তার ছেলে মাসুদ-বিন-সাঈদী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘ন্যায়বিচার পেলাম না, ন্যায়বিচার হলো না। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি, একদিনের সাজাও প্রাপ্য ছিল না।’ ব্যথা ও দুঃখ থেকে যাবে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদ- না হওয়ায় চিরদিনের জন্য মনে ব্যথা ও দুঃখ থেকে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। সাঈদীর রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ খারিজ হওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় এমন মন্তব্য করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালত যে আদেশ দিয়েছে সে আদেশ সবার জন্য শিরোধার্য। তবে আমার মনে একটা ব্যথা রয়ে যাবে। সাঈদীর মতো একটা লোক তার যে দ- পাওয়া উচিত ছিল, সে দ-টা সে পেল না। প্রতিটি ব্যক্তির একটি ব্যক্তিগত আবেগ আছে। যুদ্ধাপরাধী যে কয়জনের ফাঁসি হয়েছে তাদের ভেতরে সাঈদী হলো শিরোমণি। সবচেয়ে বেশি ধূর্ত। আমাদের দেশের জন্য এবং মানব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকারক। অথচ সে লোকটার ফাঁসি হলো না। এটা আমার দুঃখ।’ ফাঁসি না হওয়ায় প্রসিকিউশনের ওপর দোষ চাপিয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যেভাবে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা দরকার ছিল, প্রসিকিউশন থেকে সেটা করা হয়নি বলে আমরা ফাঁসির আদেশ পেলাম না।’ সর্বোচ্চ আদালতের রায় শিরোধার্য জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রিভিউ আবেদন খারিজের পর তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় শিরোধার্য। আমরা বলেছি সেফ হোমে রেখে সাক্ষীদের কিউটার্ড করে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষী সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করে সাজা দিয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম আপীল বিভাগ বিষয়টি বিবেচনা করে সাজা মওকুফ করে দেবে। কিন্তু আপীল বিভাগ সেটি না করে আমাদের দুটি রিভিউ আবেদনই খারিজ করে দিয়েছে। এটা সর্বোচ্চ আদালতের রায়, অবশ্যই এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নাই। আমাদের মনে যতই ক্ষোভ থাকুক, যতই দুঃখ থাকুক; আপীল বিভাগের রায় অবশ্যই শিরোধার্য।’ সাজা বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন প্রসঙ্গে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘মৃত্যুদ- দেয়ার জন্য একটি রিভিউ পিটিশন রাষ্ট্রপক্ষ করেছিল, আমরা বলেছি রিভিউ পিটিশনটি তামাদি হয়েছে এবং আইনগতভাবে এ রিভিউ পিটিশনটি চলতে পারে না। তবে আপীল বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, একবার লাইফ দিলে সেটা পুনর্বিবেচনা করে তাকে মৃত্যুদ- দেয়ার নজির নেই। সে কারণে তারা ওই রিভিউটাও খারিজ করে দিয়েছে।’ ন্যায়বিচার পাইনি আমৃত্যু কারাদ-ের বিরুদ্ধে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তার ছেলে মাসুদ সাঈদী। সোমবার রায়পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। একদিনের সাজাও কাম্য ছিল না। একমাত্র খালাসই ছিল আমার পিতার জন্য ন্যায়বিচার।’ ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির পলিটিক্যাল এজেন্ডা রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের কিছু প্রসিকিউটর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির মিটিংয়ে গিয়ে অসদাচরণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপীলের রায়ে প্রসিকিউটরদের নিয়ে করা বিরূপ মন্তব্যের অংশ বাদ দেয়ার আবেদন করলে প্রধান বিচারপতি এ মন্তব্য করেন। সোমবার সাঈদীর রিভিউতে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় সুপ্রীমকোর্টের সাবেক সম্পাদক আইনজীবী এএম আমিনউদ্দিন আবেদন উপস্থাপন করেন। আবেদনের বিষয়ে এ আইনজীবীর বক্তব্য উপস্থাপন তুলে ধরার সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, কিছু নন-প্রাকটিসিং লয়ার প্রসিকিউটর হয়েছেন। কিছু প্রসিকিউর ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির মিটিংয়েও যান, যাদের (নির্মূল কমিটির) পলিটিক্যাল এজেন্ডা রয়েছে। তারা কিন্তু মিসকন্ডাক্ট (অসদাচরণ) করছেন। এরা পাবলিক প্রসিকিউটরের পজিশন বোঝেন না। তবে আদালত রায়ে প্রসিকিউটরদের বিষয়ে থাকা কিছু মন্তব্য বাদ দেয়ার আবেদনের কিছু অংশ মঞ্জুর করে। উভয়পক্ষের রিভিউ দায়ের গত ৪ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগের বেঞ্চ মামলাটি শুনানির জন্য ১৪ মে রবিবার দিন ধার্য করেছিল। সে অনুযায়ী নির্ধারিত দিনেই শুনানি শুরু হয়ে সোমবার বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আমৃত্যু করাদ-ের রায় পুনর্বিবেচনা করে মৃত্যুদ-ের জন্য আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দ- থেকে খালাস চেয়ে রিভিউ করেছিলেন সাঈদী। আপীল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মোঃ মোবারক হোসেন (মৃত্যুদ-), হবিগঞ্জের সৈয়দ মোঃ কায়সার (মৃত্যুদ-), রংপুরের এটিএম আজহারুল ইসলাম (মৃত্যুদ-), পিরোজপুরের আব্দুল জব্বার (আমৃত্যু কারাদ-), পাবনার আবদুস সুবহান (মৃত্যুদণ্ড), চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান (আমৃত্যু কারাদ-), পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক (মৃত্যুদ-), বাগেরহাটের শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার (মৃত্যুদ-) ও খান আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ও ওবায়দুর হক তাহের (মৃত্যুদ-), কিশোরগঞ্জের এ্যাডভোকেট সামসুদ্দিন আহম্মেদ (মৃত্যুদ-), হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান বড় মিয়া (মৃত্যুদ-) ও মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া (আমৃত্যু কারাদ-), জামালপুরের মোঃ সামসুল হক ওরফে বদর ভাই ও এসএম ইউসুফ আলী (আমৃত্যু কারাদ-), যশোরের সাখাওয়াত হোসেন (মৃত্যুদণ্ড)।
×