ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের পর বছর ঝুলে আছে তদন্ত

শতাধিক চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার ভবিষ্যত অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ মে ২০১৭

শতাধিক চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার ভবিষ্যত অনিশ্চিত

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশের শতাধিক চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তের ভাগ্য চলে যাচ্ছে হিমাগারে। বিগত অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি এমন মামলাও আছে। পুলিশের স্ত্রী থেকে শুরু করে সাংবাদিক দম্পতি, কলেজছাত্রী, নাট্যকর্মী, ব্লগার, এ্যাডভোকেট, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক খুনের ঘটনার দীর্ঘ সময়েও রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়ায় হত্যা মামলাগুলোর তদন্তের ভাগ্য অনিশ্চিত। কোন কোন খুনের মামলার তদন্তকারী অফিসার (আইও) পরিবর্তন করা হয়েছে এক ডজনেরও বেশি বার। এসব চাঞ্চল্যকর খুনের মামলা তদন্ত করছে পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ। খুনের ঘটনার মামলা চাঞ্চল্যকর। অথচ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে না দীর্ঘদিনেও। চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্তেরই যখন এ অবস্থা, তখন অন্যান্য খুনের মামলার তদন্তের অবস্থার হাল কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্লুলেস খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে বারবার। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে গেছে। আবার কিছু কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা প্রকৃত আসামিদের বাঁচানের জন্য তদন্তের গতি কমিয়ে দিয়ে রহস্যের জালে আটকে দেয়া হয়েছে। কোন কোন খুনের ঘটনায় খুনীরা এতই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ধূর্ত যে, খুনের ঘটনা এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, আসলেই ক্লুলেস (সূত্রবিহীন) করে রাখা হয়েছে। এসব ক্লুলেস খুনের ঘটনা তদন্তের একপর্যায়ে এসে হাল ছেড়ে দিয়েছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। আবার এমনও হয়েছে, যিনি একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা তদন্ত করছেন তার কাঁধে আরও একটি চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা চাপিয়ে দেয়ায় তদন্তকারী অফিসার আর কূল-কিনারা করতে পারছেন না। চাঞ্চল্যকর তনু ও মিতু, সাগর-রুনি হত্যা মামলা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। কলেজছাত্রী তনু হত্যার ছয় মাস আর পুলিশ সুপারের স্ত্রী মিতু হত্যার ঘটনা ঘটলেও মামলার তদন্তের অগ্রগতি অদৃশ্য এক জায়গায় গিয়ে থমকে গেছে। তিনটি ঘটনায়ই হত্যাকা-ের নেপথ্য কারণ বের করতে পারেনি পুলিশ। ফলে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার মতো এ দুটি মামলাও আলোর মুখ দেখা থেকে বঞ্চিতই হবে? গত বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে এখন পর্যন্ত তিনবার। প্রথমে থানা পুলিশ, এরপর ডিবিতে এবং সবশেষ মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে। দেশব্যাপী আলোচিত তনু হত্যাকা-ের ঘটনা এক বছর অতিক্রম করলেও তদন্তের অগ্রগতি প্রায় অন্তঃসারশূন্য বলে জানা গেছে। কুমিল্লা সেনানিবাসের বাসার পাশের একটি জঙ্গল থেকে তনুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার পরের দিন কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে তার প্রথম ময়নাতদন্ত করা হয়। ওই দিন অজ্ঞাতদের আসামি করে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন তনুর বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন। গত ৩০ মার্চ দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্তের জন্য তনুর লাশ জেলার মুরাদনগরের মির্জাপুর গ্রামের কবর থেকে উত্তোলন ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গত ৪ এপ্রিল দেয়া হয় প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। ওই প্রতিবেদনে তনুকে হত্যা ও ধর্ষণের আলামত না থাকায় সমালোচনার মুখে পড়ে ফরেনসিক বিভাগ। গত বছরের ১৬ মে তনুর কাপড়ে তিন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়া যাওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আবারও আলোচনায় উঠে আসে প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন। ১২ জুন দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পরে তদন্ত কর্মকর্তা গাজী ইব্রাহীমকে পরিবর্তন করে সিআইডির এডিশনাল এসপি জালাল উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ মামলা তদন্তে গড়িমসি করা হচ্ছে বলে তনুর পরিবারের পক্ষ থেকে বরাবরই অভিযোগ করা হচ্ছে। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়া অব্যাহত আছে। পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে গত বছরের ৪ জুন। চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীরা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটি রহস্যজনক। মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার পরদিন ৫ জুন পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত হন। এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত এসপি বাবুল পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন। কিন্তু মামলাটি ক’জন চিহ্নিত-দাগি অপরাধী গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই শেষ হলো। হত্যার নির্দেশদাতা কে এবং নেপথ্যের ঘটনাইবা কী সেটা রয়ে গেছে রহস্যের অন্তরালে। সাংবাদিক সংগঠনগুলোর শত আন্দোলনের মুখেও চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা ধামাচাপা পড়ে গেছে। তদ্রƒপ এ দুটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাও ডিপ ফ্রিজের দিকে চলে যাচ্ছে। নেপথ্যে কোন অশুভ স্বার্থান্বেষী চক্র আছে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকা-ের পাঁচটি বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আদালতে চার্জশীট (অভিযোগপত্র) জমা দিতে পারেনি তদন্ত সংস্থা। এমনকি খুনী শনাক্ত বা প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়টিও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রাজাবাজারের বাসায় খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর ও রুনি। থানা পুলিশ আর ডিবি পুলিশের হাত ঘুরে পাঁচ বছর ধরে মামলার তদন্ত করছে র‌্যাব। তবে দীর্ঘ সময়ে মামলার তদন্তের অগ্রগতি বলতে শুধু তদন্ত কর্মকর্তা ও তদন্ত সংস্থার পরিবর্তন করা হয়েছে মাত্র। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের শুরু থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশক ও ব্লগারদের ওপর সিরিয়াল হামলা ও হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালের ৩১ নবেম্বর বিকেলে লালমাটিয়ার শুদ্ধস্বর প্রকাশনী কার্যালয়ে ঢুকে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার সুদীপ কুমার ওরফে রণদীপম বসু ও তারেক রহিমকে কুপিয়ে জখম করা হয়। একই দিন প্রায় একই সময়ে রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্লগার ও লেখক অভিজিতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় তার স্ত্রীকেও কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় গোপীবাগের আরকে মিশন রোডের চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় লুৎফর রহমান ফারুক ও তার ছেলেসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন বছর পার হলেও বর্তমান তদন্ত সংস্থা ডিবি কোন কূল-কিনারা করতে পারেনি বলে জানা গেছে। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর বাসার দোতলায় গলা কেটে হত্যা করা হয় বেসরকারী কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। শেরেবাংলা নগর থানায় দায়েরের পর মামলাটি পরে ডিবিতে স্থানান্তর করা হলেও তদন্ত সংস্থা হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি। ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে রাজধানীর খিলক্ষেতের রেললাইন থেকে পুলিশ প্রখ্যাত সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজের লাশ উদ্ধার করে। আলোচিত ওই হত্যা মামলাটি খিলক্ষেত থানা ও ডিবির হাত ঘুরে এখন তদন্ত করছে সিআইডি। কী কারণে আহমেদ মিরাজ খুন হয়েছেন সে রহস্যের জট এখনও খোলেনি। ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ বাসায় অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে মারা যান গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে তমহর ইসলাম। কিন্তু ওই খুনের ঘটনার রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। রাজধানীর মীরহাজিরবাগে ২০০৮ সালের নবেম্বরে পরিবহন ব্যবসায়ী জুয়েল হোসেন ও তার বন্ধু পোশাক ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন টুটুল খুন হন। রহস্যজনক এ জোড়া খুনের তদন্তে দশবার কর্মকর্তা বদল করা হয়। কিন্তু হত্যা রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরের মধ্যে সাংবাদিক সাগর-রুনি, জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে অজ্ঞাত মহিলা হত্যার রহস্য এখনও অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। এমন চাঞ্চল্যকর অন্তত অর্ধশতাধিক হত্যা মামলার তদন্ত বছরের পর বছর চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু রহস্যের কোন কূল-কিনারা করতে পারছে না তারা। এসব হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদারকি করা হচ্ছে। র‌্যাব, সিআইডি, ডিবি ও থানা পুলিশ চাঞ্চল্যকর এসব হত্যা মামলার তদন্ত করছে। যেসব চাঞ্চল্যকর হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ রাজধানীর টিকাটুলির সিক্স মার্ডার, মোহাম্মদপুরের শিক্ষিকা হত্যাকা-, পরীবাগের তুর্কী এ্যাসোসিয়েটস অফিসে রমজান আলী খুন, এ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু হত্যাকা-ের ঘটনা, মালিবাগে সানরাইজ হোটেলের ভেতর ডিবির ইন্সপেক্টর নুরুল আলম শিকদার ও এসআই আলমগীর হোসেন তালুকদার, পুরান ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আহম্মদ হোসেন হত্যা, মিরপুরে ব্যবসায়ী আফতাব, প্রিন্স গ্রুপের মালিক কাজী শহিদুল হক, ওয়ার্ড কমিশনার মিস্টার, গুলশানে গৃহবধূ তাসমির হোসেন মুন্নী, পুরান ঢাকায় ব্যবসায়ী আজগর, খিলগাঁওয়ে ব্যবসায়ী ইসলাম শিকদার, বিজয়নগরে ব্যবসায়ী নজরুল, সবুজবাগে আজিজুল, মিরপুরে আওয়ামী লীগ নেতা সামাদ খান, মিরপুরে মিসুক সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সান্টু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মনু, ফকিরাপুলে ব্যবসায়ী সোহেল হোসেন টিটু, তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক মিজানুর রহমান ও মিরপুরের কাপড় ব্যবসায়ী আলী আকবর, জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থার মহাসচিব ইদ্রিস আলী বেপারী, বাড্ডায় থাই এ্যালুমিনিয়ামের ঠিকাদার আল আমিন, পুরান ঢাকার মহানগর পুস্তক বাঁধাই সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদ, মতিঝিলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাউসার আলী, ধানম-ির জিগাতলায় বিএনপির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান শিবলী, মোহাম্মদপুরে আবাসন কোম্পানি শেলটেকের কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ, রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা, রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ধানম-িতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ হত্যাকা- অন্যতম। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত যেসব চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার তদন্ত হিমাগারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার মধ্যে রাজধানী ঢাকার রাজাবাজারে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী, গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, খুলনায় তৈয়েবুর রহমান ও তার ছেলে মনির ও উত্তরায় জঙ্গী সংগঠন থেকে ফিরে আসা ফল ব্যবসায়ী মাসুম হত্যার ঘটনা এবং সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতি হত্যাকা-ের ঘটনার রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনার পর মামলা তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্তের ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালতের নির্দেশে তদন্তভার নেয় র‌্যাব। তারা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী নিহত দম্পতির শিশুপুত্র মাহীর সরওয়ারের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে র‌্যাব সদস্যরা। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করে শতাধিক ব্যক্তিকে। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সাগর-রুনির রক্তমাখা জামাকাপড়, বঁটি, মোজা ইত্যাদি আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানো হয়। অভিজ্ঞ ফরেনসিক আলামত সংগ্রহকারীরা ওই ঘর থেকে আরও কিছু আলামত সংগ্রহ করেন ও ডিএনএসহ আলামত পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ভিসেরা পরীক্ষার জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে ওঠানো হয়। এখন শুধু সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-ের বিষয়ে সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। গত সাড়ে তিন বছরে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-ের তদন্তের অবস্থা যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে, রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চাঞ্চল্যকর হত্যার মধ্যে কয়েকটি মামলা ঝুলে আছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। পাঁচ বছরেও হত্যাকা-ের মোটিভই উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি এমন মামলাও আছে। তদন্ত চলছে, শীঘ্রই অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে, এমন কিছু বক্তব্য দিয়েই পুলিশের তদন্তকারী সংস্থাগুলো দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে যেসব হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি তার মধ্যে ২০০৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র হারিসুল ইসলাম বিপ্লব, ২০০৫ সালে তেজগাঁওয়ে এ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বাচ্চু, ধানম-িতে সাবেক শিক্ষিকা কাজী সুহিন নাহার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আফতাব আহমাদ হত্যাকা- ঘটে ২০০৬ সালে ও রমনার ইঞ্জিনিয়ার এসএম শফিক-উল মওলা খুন হন ২০০২ সালে। এসব খুনের ঘটনা এখনও অনুদ্ঘাটিত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মামলার বাদী ও সাক্ষীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা না দিলে মামলার চার্জশীট দিতে বিলম্ব করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাছাড়া মামলা প্রত্যাহার করতে বাদীদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান বাদীরা। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকা-ের মূল আসামিদের বাদ দিয়ে নিরপরাধীদের আসামি করে চার্জশীট দেয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর ভাগ্য ঝুলে আছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির হাতে। অগ্রগতি নেই বেশিরভাগ মামলার তদন্তে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন কারণে মামলার তদন্ত দীর্ঘায়িত হয়। এর মধ্যে বড় বড় ইস্যু তৈরি হওয়া, তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি, তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন, বাদী ও আসামির কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করতে ব্যর্থ হওয়া, আসামি গ্রেফতার করতে না পারা এবং উর্ধতন কর্মকর্তাদের তদন্তের অবস্থা নিয়মিত মনিটরিং না করা অন্যতম। একেকটি নতুন ঘটনার পর পুরনো ঘটনার তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তদন্তে লেগে থাকতে হবে। গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে এ ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনা কমে আসত। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের অদক্ষতা ও অজ্ঞাত কারণে চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রহস্য অনুদ্ঘাটিত রয়ে যাচ্ছে। আসামিরাও চিহ্নিত হচ্ছে না। বিচার পাচ্ছেন না নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। তবে খুনীরা এমন কিছু আলামত রেখে যায়, তাতে খুনীদের শনাক্ত করা খুব সহজ। প্রযুক্তির ব্যবহার করে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে এমন দক্ষতা পুলিশের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। পুলিশের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নেয়া দরকার। অন্যথায় পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা দিন দিন হারিয়ে যাবে। পুুলিশ সদর দফতরের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, মনিটরিং সেলে যেসব মামলা রয়েছে সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে তদন্তকাজ ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকার বাইরে যেসব মামলা আছে সেখানেও একই অবস্থা। বেশ কয়েকটি হত্যা মামলার সঙ্গে সরকারদলীয় এমপি, সন্ত্রাসী, নেতাকর্মী জড়িত থাকায় ও তদন্তে সরকারদলীয় প্রভাব এবং তদন্ত কর্মকর্তাদের বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণে বেশকিছু মামলার তদন্তের ভাগ্যও আগে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লেও এখন সেই নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত অবস্থায় তদন্ত কার্যক্রম চলছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে দেশব্যাপী জঙ্গী তৎপরতার ইস্যুকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বেশি মনোযোগী হয়ে আছে জঙ্গীবিরোধী অভিযানেই। এ কারণে আলোচিত হত্যাকা-গুলোর তদন্ত কার্যক্রমে অনেকাংশে ভাটা পড়ে যাচ্ছে। জঙ্গী দমনের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হলেও চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-গুলোর তদন্ত কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে। তবে ক্লুলেস হত্যাকা-ের মামলাগুলোর তদন্তে বেশি সময় নেবেই।
×