বিজ্ঞাপনেই প্রচার ও প্রসার কথাটা যৌক্তিক তা সে যে কোন পণ্যের বেলায়। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্ক, অনুভূতির আদান-প্রদান সেসব তো জগৎসভাকে ডেকে দেখানোর বিষয় নয়। এতদ্সত্ত্বেও ভার্চুয়াল জগতে প্রতি সেকেন্ডের আপডেট দিতে ব্যস্ত কোটি কোাটি মহৎপ্রাণ। এই মাত্র স্ট্যাটাসের সুবাদে জানা গেল আমরা প্রেমে পড়েছি। পরক্ষণেই আজ আমরা বিচ্ছিন্ন। কচু পাতায় জলের অবস্থানের মতো চঞ্চল সময়েও তো কোন না কোন কবি নির্জনে বসে আপন মনে জুড়ে চলেন অতীত-বর্তমানের স্মৃতির মালা। সেখানে সর্বংসহা আছে কিন্তু অভিযোগ নেই, আত্ম উপলব্ধি আছে কিন্তু লোক দেখানো নেই। যে কারণে এ বছর অমর একুশে বইমেলায় প্রিয়মুখ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘তুমি তুমি নও তুমি তুই’ কাব্যগ্রন্থে কবি উজ্জ্বল চৌধুরী লিখলেন,
তোমার ইশারায় জীবন দিতে চেয়েছি বারংবার
ভাঙতে চেয়েছি প্রচলিত নিয়ম,
জীবনের সাথে পুতুল খেলা খেলেছি হাসিমুখে
কখনও তো অভিযোগ করিনি। [সীমাহীন]
অভিযোগের তীর আমি তুমির মধ্যে এসে না পড়লেও বৃহত্তর স্বার্থে আবার কবি প্রখর। ভাষা আন্দোলন, যুদ্ধ, বিজয় প্রভৃতির প্রশ্নে সরাসরি অংশগ্রহণ কিংবা আত্তিকরণে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে কবির সেকি তীব্র আক্ষেপ।
আমি ভাষা আন্দোলন দেখিনি, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি
আমার স্মৃতিপটে কোন যুদ্ধ বা বিজয় নেই।
আমি গর্ব করে বলতে পারি না মুক্তিযুদ্ধের গল্প
আমি উপভোগ করতে পারিনি বিজয়ের আসল স্বাদ। [স্মৃতিপট]
স্বাদের দিক দিয়ে মনুষত্বের স্বাদ মানবতায় কিন্তু মানবতা আজ অবরুদ্ধ নানান পৈশাচিক উন্মাদনায়। যুদ্ধের দামামা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বর্ণ-গোত্রের বিভাজন প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে বিভাজনের খাদে দাঁড়িয়ে কবি সংশয় প্রকাশ করে লেখেন,
ছিঃ ছিঃ মানবতা!
মানুষ খেলছে রক্তের হোলি
এ কেমন রসিকতা?
ছিঃ ছিঃ মানবতা!
সাদা কালো বর্ণ বিভেদ
মারছে যথাতথা।
ছিঃ ছিঃ মানবতা। [হায়রে মানবতা]
মানবতা তথা মনুষত্ব্যের জাগরণে নারী হৃদয়ের অবদান অনস্বীকার্য। সেই মহানুভবতাকে সংক্ষেপে কিন্তু গভীর দ্যোতনায় কবি উজ্জ্বল চৌধুরী তুলে ধরলেন তার কবিতায়,
কখনো মা, কখনো মেয়ে
কখনো ভগ্নিরূপে
হে নারী তুমি মহান হয়েছ
আপন শক্তি গুণে। [নারী]
যে গুণ, যে দেশপ্রেমের জোরে এক সময় মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেখানে ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ এবং পুনঃস্বপ্ন নির্মাণের প্রত্যাশায় কবির আত্মশুদ্ধি,
সাহস দেখিয়েছ, যুদ্ধ করেছ, রক্ষা করেছ দেশ
ঘাবড়ে যাওনি, চিন্তা করোনি, কোথায় তার শেষ।
তোমাদের আত্মত্যাগেই আমাদের স্বাধীনতা
রাখতে পারিনি আমরা জানি তোমাদের দেয়া কথা। [আমার স্বাধীনতা]
কথায় কথা আসে। কবি উজ্জ্বল চৌধুরীকে বুঝতে হবে তুমি আর তুই দিয়ে জগৎ চলে না। জগৎ চলে আবহমান কালের অগণিত মানুষের পথচলায়। যত মানুষ তাদের তত গল্প, তত তাদের কাব্য ভাষা। উপরন্ত আমরা কেউই আর আঞ্চলিক ভূখ-ে আটকে নেই, অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়েছি বিশ্বায়নে, বিশ্ব ভূখ-ে। ফলে কাব্যে কাব্যের বহুমাত্রিক বিষয়-রুচি এবং ব্যঞ্জনা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সত্তরের অধিক কবিতায় তেমন প্রত্যাশা সবারই থাকে। ভবিষ্য এ কবি উজ্জ্বল চৌধুরী এ দিকটা ভেবে কাব্য সৃজন করবেন এ বিশ্বাস রইল। তিনি তো এ অসীমতাকে পছন্দ করার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন তার কাব্যে, ফলে এতটুকু চাওয়া তো খুবই সহজতর,
আজ আমি নগরের পথ ধরেই চলবো বলে
মন স্থির করেছি...
আমার সাথে পায়ে পা মিলাতে পারো
যদি লক্ষ্যহীন পথে চলতে চাও! [লক্ষ্যহীন]