ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আলোর মুখ দেখছে সরকারী কর্মচারী আইন

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ মে ২০১৭

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আলোর মুখ দেখছে সরকারী কর্মচারী আইন

তপন বিশ্বাস ॥ সরকারী সেবার জন্য আবেদনকারীকে নির্ধারিত বা যুক্তিযুক্ত সময়ের মধ্যে সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। কোন কারণে সেবা প্রদান সম্ভব না হলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই জানাতে হবে। ইচ্ছাকৃত এই বিধান লঙ্ঘন করলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। বিধান অনুযায়ী এতে শাস্তিভোগও করতে হবে। এসব বিধান রেখে সরকারী কর্মচারী আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। অনুমোদনের জন্য এটি ফের প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সচিব কমিটির অনুমোদনের পর আইনের খসড়াটি আবারও মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। বিগত প্রায় ১১ বছর ধরে বিষয়টি এভাবেই বিভিন্ন কমিটিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে দীর্ঘদিনেও এ সংক্রান্ত আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সরকারী কর্মচারী আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপনের জন্য শীঘ্রই তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। মূলত ২০০৬ সাল থেকে এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর দু’দফায় সরকার বদলের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। আইনের খসড়া নিয়ে দফায় দফায় ঘষামাজা হয়। কমিটি গঠন,সুপারিশ প্রণয়নসহ নানা পর্যায়ে কাজ হয়। এগুলো ওয়েবসাইটেও দেয়া হয়। এসব করতেই পার হয়েছে কয়েক বছর। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি। তারও প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই প্রস্তাবিত খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ সময় আইনের বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। তা পূরণ করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গত বছর ২৪ নবেম্বর মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে তা ফেরত পাঠানো হয়। মন্ত্রিসভা কেন খসড়ায় অনুমোদন দেয়নি? সূত্র জানায়, ওই সময় মন্ত্রিসভা বলেছে, এটা (সরকারী কর্মচারী আইন) ছিল ১৬ ধারার ছোট আইন। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর এটা ৭১টি ধারার অনেক বড় আইন হয়ে গেছে। এজন্য মন্ত্রিসভা বলেছে এটা একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। কারণ এতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল-বিদ্যমান খসড়াটিতে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে, যা সচিব কমিটি ও মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের সময় ছিল না। এতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। কাজেই এটি ফের সচিব কমিটির অনুমোদনের পর মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে হবে। এরপর থেকেই আইনের খসড়ায় ঘষামাজা শুরু হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ কমিটি এ লক্ষ্যে কাজ করে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ইতোমধ্যে খসড়াটি চূড়ান্ত হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে সিটিজেন চার্টার বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ‘সরকারী সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণ’ নামে নতুন অধ্যায় যোগ হয়েছে। এতে ৭১টি ধারা বদলে ৬৬টি করা হয়েছে। পৃষ্ঠার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮-তে। এখন অনুমোদনের জন্য খসড়াটি ফের প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে তোলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে দেয়া পর্যবেক্ষণ পূরণ করতে গত বছরের এপ্রিলে খসড়াটি নিয়ে যৌথভাবে কাজ শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব(বিধি) আবদুল হাকিমকে প্রধান করে আবারও একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি দ্য সার্ভিস (রিঅর্গানাইজেশন এ্যান্ড কনডিশন) এ্যাক্ট-১৯৭৫, দ্য পাবলিক সার্ভেন্টস (ডিসমিজল অন কনভিকশন) অরডিন্যান্স-১৯৮৫সহ বিদ্যমান ৪৬টি আইন, বিধিমালা, অনুশাসন ও আদেশাবলীর প্রয়োজনীয় ধারা প্রস্তাবিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে ৭ পৃষ্ঠার খসড়া আইনটি ২১ পৃষ্ঠায় রূপ নেয়। এতে ১৬ ধারার স্থলে ৭১টি ধারায় পরিণত হয়। বর্তমান প্রস্তাবিত খসড়াটি কাটছাঁটের মাধ্যমে ছোট করা হয়েছে। সরকারের অনুমতি ছাড়াই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার করতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আইনটিতে দুদককে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এর আগে সরকারী কর্মচারী আইনের যে খসড়া মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে তাতে দুদক আইনটি কিছুটা খর্ব করা হয়। খসড়ায় বলা হয়েছিল, সরকারী দায়িত্ব পালন-সংক্রান্ত কোন মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা হওয়ার আগে কাউকে গ্রেফতার করতে চাইলে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দফতরের অনুমতি নিতে হবে। এ নিয়ে অনেক বিতর্কের পর আইন মন্ত্রণালয় খসড়া আইনটি পরিবর্তনের পক্ষে মত দেয়। সে অনুযায়ী খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিয়োগ, কর্মসম্পাদন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে একটি আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তারপরও ৪৫ বছর ধরে এ ধরনের কোন পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়নি। এতদিন আইন ছাড়াই বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে গণকর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি হচ্ছিল। বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও নানা কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। জানা গেছে, ২০০৬ সালে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ নামে গণকর্মচারীদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। কিন্তু এ সংক্রান্ত কয়েকটি বৈঠক করা হলেও কোন খসড়া করে যেতে পারেনি তারা। ওয়ান-ইলেভেনের পর এ উদ্যোগ জোরালো হয়ে ওঠে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনটির একটি খসড়া তৈরি করলেও নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে তা পাস করার জন্য রেখে যায়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। তারা ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা খসড়াকে যুগোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য করতে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের (বর্তমানে জনপ্রশাসন) তৎকালীন যুগ্ম সচিব (বিধি) মোঃ ফিরোজ মিয়ার নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে খসড়া চূড়ান্ত করে ২০১১ সালের মার্চে তা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে মতামত দিতেও সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। আইনের খসড়া নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের। বিষয়টি সুরাহা করতে প্রকৃচিসহ (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তার আগে সব ক্যাডার ও কর্মচারী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে প্রস্তাবিত খসড়া নিয়ে সংলাপের কথা বলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ৩ জুন এবং ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রস্তাবিত খসড়ায় আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে সচিব নিয়োগের বিধান থাকায় এর তীব্র বিরোধিতা করেন সব ক্যাডারের কর্মকর্তারা। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সেখানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী হস্তক্ষেপ করেন। তারা ঘোষণা দেন-সিভিল সার্ভিস আইন নয়, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য একসঙ্গে সরকারী কর্মচারী আইন প্রণয়ন করা হবে।
×