ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবসায়ীদের কারসাজি

শব-ই-বরাত ও রমজান সামনে রেখে অস্থির ভোগ্যপণ্য বাজার

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৪ মে ২০১৭

শব-ই-বরাত ও রমজান সামনে রেখে অস্থির ভোগ্যপণ্য বাজার

এম শাহজাহান ॥ মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রতিকেজি চিনিতে দাম বেড়েছে ৮ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে ছোলার দাম। ৫ টাকা দাম বেড়ে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকায়। ২৫০ টাকা ছুঁয়েছে রসুনের দাম। আমদানি বেশি এবং মজুদ পরিস্থিতি ভাল থাকার পরও বাড়ছে এসব ভোগ্যপণ্যের দাম। পবিত্র রমজান ও শব-ই-বরাতে অতিরিক্ত মুনাফা করতে কারণ ছাড়াই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিলমালিক, পাইকার এবং খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আর এতে ভোক্তাদের পকেট শূন্য হচ্ছে, কষ্ট বাড়ছে তাদের। জানা গেছে, গত এক বছর ধরে ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল। বিশেষ করে মোটা চালের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। গত কয়েক বছরের মধ্যে এই দাম সর্বোচ্চ রেকর্ড অর্জন করেছে। শব-ই-বরাতের আগে ৭২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে চিনি। রোজা শুরু হলে চিনির দাম আরও বাড়বে। এক সপ্তাহ আগে মিলগেটে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৫৩ টাকায়। আর গত কয়েক দিনের ব্যবধানে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৫৯-৬০ টাকায়। এই চিনি পাইকারি বাজার ঘুরে খুচরা দোকানে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭২ টাকায়। ৫০ কেজির বস্তায় দেড় শ’ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে মিল পর্যায়ে। মূলত সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, ঈগলু, টিকে গ্রুপ, দেশবন্ধু এবং এস আলমের মতো আট থেকে দশটি গ্রুপ দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ সাহা জানিয়েছেন, মিলগেটে বর্তমান প্রতিকেজি চিনি ৫৮-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে তা ৬২-৬৩ এবং খুচরা পর্যায়ে ৬৫-৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজির প্যাকেট চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭২ টাকায় এবং খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়। একই অবস্থা বিরাজ করছে ছোলার দামের ক্ষেত্রেও। ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ছোলা। এছাড়া প্রায় সব ধরনের ডালের দাম উর্ধমুখী ধারায় রয়েছে। ভোক্তাদের আশঙ্কা, রমজান মাস জুড়ে ভোগ্যপণ্যের অতিরিক্ত দাম কষ্ট বাড়াবে। ছোলার দাম বাড়া নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোজার প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ছোলার ব্যাপক চাহিদা থাকে। তাই ওই সময় পর্যন্ত দাম বাড়বে। এরপর আবার ছোলার দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ইতোমধ্যে অতিবৃষ্টি এবং হাওড় এলাকায় বন্যার কারণে সবজির দাম বেড়ে গেছে। রাজধানীর বাজারে ৬০ টাকার নিচে কোন সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে, শব-ই-বরাতের সপ্তাহখানেক বাকি থাকতে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় অস্বস্তিতে রয়েছেন দেশের সাধারণ ভোক্তারা। স্বল্প ও নিম্নআয়ের মানুষ দৈনন্দিন হিসেব-মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। যদিও আগামী ১৫ মে থেকে টিসিবি খোলা বাজারে স্বল্পমূল্যে ছোলা, তেল, চাল, আটাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছে। দাম বাড়ার জন্য খুচরা বিক্রেতারা দুষছেন পাইকারি বাজারকে। আবার পাইকারি বিক্রেতারা দুষছেন আন্তর্জাতিক বাজারকে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম এখন নিম্নমুখী ধারায় রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে সরকারের মনিটরিং না থাকার সুযোগে সুবিধাভোগী অসৎ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নেয়ার সুযোগ নিচ্ছে। বাজারে এত কিছু হচ্ছে তারপরেও সরকারের কোন তদারকি বা মনিটরিং নেই। মনিটরিং না থাকলে অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। সরকারী মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়ে যায়। আর এতে দাম বাড়ে জিনিসপত্রের। প্রতিকেজি আমদানিকৃত রসুন বিক্রি হচ্ছে ২৩৫-২৫০ টাকা, মুসর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫-১৩৫ টাকায়। অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর শ্যামবাজার, মৌলভী বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও কাওরানবাজারের বেশ কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার আশায় বিশাল মজুদ গড়ে তুলেছেন। কাওরানবাজারের কিচেন মার্কেটের দোতলায় গড়ে তোলা হয়েছে ছোলা ও চিনির অবৈধ গুদাম। এছাড়া ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ এবং বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের বড় ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্যের মজুদ বাড়িয়ে যাচ্ছেন। ভোক্তা স্বার্থ নিয়ে কাজ করে, কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দাবি, আমদানিকারক ও পাইকারি সিন্ডিকেটচক্র প্রতিবছর কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বাজার অস্থির করে তোলে। বাজার মনিটরিংয়ের অভাবে প্রায়ই ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে। চিনি, ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ এবং রসুনের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানো হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের দাম এখন কম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রমজানে দেশে ছোলার চাহিদা ৬৫-৭০ হাজার টন। এই মুহূর্তে দেশে মজুদ আছে প্রায় আড়াই লাখ টন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতেই ১২ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়। একইভাবে প্রতিমাসেই ছোলা আমদানি হচ্ছে। এ হিসেবে রোজায় ছোলার কোন সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। কাপ্তান বাজারের মুদি দোকানিরা জানান, শব-ই-বরাত ও রোজাকে কেন্দ্র করে অনেকে আগাম ছোলা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে ছোলার দাম একটু বেড়েছে। বর্তমানে ৮৫-৯০ টাকা কেজি দরে ছোলা বিক্রি হচ্ছে। সামনে দাম আরও বাড়তে পারে। কথা রাখছেন না ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্যের আমদানি, মজুদ পরিস্থিতি এবং বাজার মূল্য নিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন ব্যবসায়ীরা। ওই বৈঠকে দ্রব্যমূল্য না বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ এবং রসুনের মতো ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, রমজানে যাতে ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকে তার জন্য সরকার সব ধরনের সহায়তা করবে। দাম না বাড়ালে ব্যবসায়ীদের পুরস্কৃত করা হবে। আপনারা সাপ্লাই চেন ঠিক রাখুন পণ্যের মূল্য অবশ্যই মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। আপনারা কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি করবেন না। কিন্তু মন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হচ্ছে। ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ভোজ্য তেলের চাহিদা ১৫ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে মজুদ আছে তার চেয়ে বেশি। চিনির চাহিদা প্রায় একই পরিমাণ, যার অনেক বেশি বর্তমানে মজুদ রয়েছে। প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক মতোই আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন পণ্যের দামই বাড়ার কথা নয়। ডলারের দাম বৃদ্ধির সুযোগ নেয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, রমজানের পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) অনেক আগেই খোলা হয়েছে। এরই মধ্যে সেসব পণ্য বন্দরে এসেও গেছে। বাজার সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, রমজানে পণ্য বিক্রিতে ব্যবসায়ীদেরও ভাল প্রস্তুতি (আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি) রয়েছে। অথচ এখনই বেড়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। আরও কিছু পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ডলারের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কারসাজির অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, চলতি মাসে রমজান শুরু হবে। হঠাৎ ডলারের মূল্যবৃদ্ধি আমার কাছে কারসাজি বলে মনে হয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করে দর কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এরপর অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে এক দিনের ব্যবধানে ডলারের দাম প্রায় দুই টাকা পর্যন্ত কমে আসে। রমজানের সময় দেশে বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এর মধ্যে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ উল্লেখযোগ্য। পেঁয়াজের দাম এরই মধ্যে দুইদফা বেড়ে গেছে। ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, ডাল, মাছ এবং মাংসসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্য এখন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
×