আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে হাওড়ে ফসলডুবিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করতে রবিবার সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণকালে তিনি বলেন, কেউ না খেয়ে মারা যাবে না। দেশের খাদ্য মজুদ সন্তোষজনক। আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে বলেও তিনি দুর্গতদের আশ্বস্ত করেন। আগামী ফসলের জন্য কৃষকদের সার, বীজসহ কৃষি উপকরণ দেয়া হবে বিনামূল্যে। সেচের বিদ্যুতে দেয়া হবে ভর্তুকি। কৃষি ঋণের সুদ অর্ধেক মওকুফ করে দেয়া হয়েছে। এনজিওগুলোকে বলা হয়েছে, কৃষি ঋণ আদায়ে চাপ না দিতে। নারীদের জন্য করা হবে বিশেষ কর্মসংস্থান। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। সর্বোপরি হাওড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে ৩ প্রকৌশলীর সাময়িক বরখাস্তের খবরও আছে। এতে করে দুর্গত হাওড়বাসীকে আশ্বস্ত হওয়ার অবকাশ আছে বৈকি!
বিগত ৩৫ বছরের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে এবারের এপ্রিলে। হঠাৎ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দেশের হাওড়াঞ্চলের অবস্থা হয়েছে সর্বাধিক শোচনীয়। বিশেষ করে সুনামগঞ্জের সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল হয়েছে রীতিমতো দুর্যোগকবলিত। হাওড়াঞ্চলে অতিবৃষ্টির পাশাপাশি পাহাড়ী ঢলও অবশ্য এই অকাল বন্যার জন্য দায়ী। মঙ্গলবারের খবর অনুযায়ী পাকনার হাওড় পুরোপুরি ডুবে যাওয়ায় এ অঞ্চলের ১৪২টি ফসলি হাওড়ের ফসল ডুবে গেছে বলে খবর আছে। সেসব স্থানে ফসল রক্ষায় নির্মিত বাঁধ বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের খবর, সব হাওড় ডুবে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে দেড় লাখ হেক্টর জমির বোরো ধান। এবার জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে হয়েছিল আবাদ। ধান-চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার টন। আবাদকৃত ধানের ৯০ শতাংশই হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। দেড় হাজার কিলোমিটার বাঁধ পুরোটাই প্রায় বিধ্বস্ত এবং পানির নিচে। এ অঞ্চলের আকাশে-বাতাসে এখন কেবলই ভাসছে কৃষকের আর্তনাদ ও হাহাকার। ধানের পাশাপাশি তাদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস মাছ এবং হাঁস-মুরগিতেও লেগেছে মড়ক। পানি হয়েছে মারাত্মক দূষণকবলিত, যাতে জনস্বাস্থ্য পড়েছে হুমকির মুখে। তবে স্বস্তির খবর এই যে, প্রতিদিনের বৃষ্টিপাতে কমে আসছে দূষণের মাত্রা।
আপাতত হাওড়ের ৩ লাখ ৩০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে প্রতিমাসে বিনামূল্যে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা নগদ দেয়ার ঘোষণা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তবে ওই অঞ্চলের ২৪ লাখ পরিবারকেই খাদ্য ও অর্থ ত্রাণ হিসেবে দেয়ার দাবি উঠেছে ‘হাওড়ে মহাবিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন নাগরিকদের’ পক্ষ থেকে। বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তুলনামূলকভাবে ভাল বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে। তদুপরি বর্তমান সরকার একই সঙ্গে জনবান্ধব ও কৃষকবান্ধব সরকার হিসেবে পরীক্ষিত। সুতরাং দুর্গত ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আতঙ্কিত কিংবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কোন কারণ নেই। সরকারপ্রধান সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট, দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। একদা মঙ্গা এলাকা হিসেবে সুপরিচিত উত্তরবঙ্গে বর্তমানে হাহাকার নেই বললেই চলে। হাওড়ের বর্তমান পরিস্থিতিও যে সরকার দক্ষতার সঙ্গেই সামাল দিতে পারবে, এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। তবে ত্রাণের চেয়েও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বেশি প্রয়োজন পুনর্বাসন, বীজ, সার, কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক সহায়তা, যাতে তারা সহজেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, হাওড়াঞ্চল বাংলাদেশের এক অফুরন্ত শস্য ও মৎস্যভা-ার। কাজেই এর সার্বিক সুরক্ষাকল্পে পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ জরুরী ও অত্যাবশ্যক। পানি উন্নয়ন বোর্ড, হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড থাকলেও তাদের তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়। দুর্নীতিও আছে। এ দুটো সংস্থাকে সর্বতোভাবে সক্রিয় ও কার্যকর করে তোলা এখন সময়ের দাবি।
শীর্ষ সংবাদ: