ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আপস আর আত্মসমর্পণ এক কথা নয় ॥ বাংলাদেশ সাবধান!

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৩ মে ২০১৭

আপস আর আত্মসমর্পণ এক কথা নয় ॥ বাংলাদেশ সাবধান!

আমরা সবাই আপস করি। আত্মরক্ষার জন্য আপস করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই আপসেরও একটা সীমারেখা আছে। এই সীমারেখা অতিক্রম করে আপস যখন আত্মসমর্পণে পরিণত হয়, তখন তা ধ্বংস ডেকে আনে। আত্মসমর্পণ করেও এখন আর আত্মরক্ষা করা যায় না। পাকিস্তান থেকেই উদাহরণটা টানি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্না ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষিত উদারপন্থী নেতা। গান্ধী যখন খেলাফত আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন, তখন এই বলে জিন্না তাকে সাবধান করেছিলেন যে, ‘এই মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমর্থন দিলে গান্ধী ভারতের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষতি করবেন।’ এই জিন্নাই পরবর্তীকালে তার রাজনীতির কৌশল হিসেবে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ দ্বারা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন। তার এই দাবি তোলার সময় তার বন্ধু এবং ভারতের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ ইউসুফ মেহের আলি তাকে এই বলে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে আপস করলে জিন্না পাকিস্তানকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে পারবেন না। সেটি ধর্ম-রাষ্ট্রে পরিণত হবে। জিন্না তার সতর্ক বাণীকে আমল দেননি। গান্ধী ব্রিটিশ ভারতে প্রথম মহাযুদ্ধের পর খেলাফত পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ভারতের মুসলমানদের স্বাধীনতা আন্দোলনে টানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে তোল্লা দিতে গিয়ে ভারতের মুসলমানদের প্রকারান্তরে পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। জিন্নাও তেমনি ভারত ভাগ দ্বারা একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করতে চাননি। চেয়েছিলেন একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দেন। সেই সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রেরই ক্রমপরিবর্তিত রূপ আজকের হিংস্র মৌলবাদ-কবলিত পাকিস্তান। মৃত্যুর আগে জিন্না তার এই ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি দ্রুত পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভা ডেকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক ন্যাশনাল লীগে পরিণত করা এবং পাকিস্তানের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষকে মিলিয়ে পাকিস্তানী জাতি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তারই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমউদ্দিন প্রমুখ। রোগাক্রান্ত ও অবসন্ন জিন্না তাদের বিরোধিতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। করাচী থেকে বহু দূরে জিয়ারত নামক স্থানে তাকে প্রায় নির্বাসিত অবস্থায় রহস্যময় মৃত্যুবরণ করতে হয়। তার ভাগ্য ভালো পাকিস্তানের বর্তমান পরিণতি তাকে দেখে যেতে হয়নি। আরেকটি উদাহরণ বর্তমান মিসর। বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসার পর প্রেসিডেন্ট নাসের ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মিসরকে একটি শক্তিশালী আরব রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন। সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং নীল নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ তার সরকারের একটি বড় সাফল্য। উগ্র ধর্মভিত্তিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে তিনি কঠোরভাবে দমন করেন। এই দলের নেতা সাইয়িদ কুতবকে সন্ত্রাস প্রচারের দায়ে প্রাণদ-ে দ-িত করেন। এই নাসেরের মৃত্যুর পর তারই সহকারী আনোয়ার সাদাত ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে বসে দেশের নাসেরপন্থী আরব জাতীয়তাবাদীদের তার শত্রু মনে করতে শুরু করেন। তিনি গোপনে ব্রাদারহুডের সঙ্গে আপস করে চলার এবং নাসেরপন্থীদের দমন করার নীতি গ্রহণ করেন। মিসরের বিখ্যাত দৈনিক ‘আল আহরামের’ সম্পাদক মোহাম্মদ হাইকেল ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও উপদেষ্টা (তিনি একবার ঢাকাতেও এসেছিলেন)। তিনি যখন বুঝতে পারলেন, আনোয়ার সাদাত নিজের ক্ষমতার স্বার্থে উগ্র মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস করে চলার নীতি গ্রহণ করেছেন, তখন তিনি ‘আল আহরামে’ তার লেখায় সাদাতকে সতর্ক করে দেন। সাদাত তাতে ক্রুব্ধ হন এবং তাকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকান। এরপর যেদিন প্রেসিডেন্ট সাদাত মুসলিম ব্রাদারহুডের জঙ্গীদের গুলিতে নিহত হন, সেদিন হাইকেল ছিলেন জেলে। তিনি জেলে বসেই খবরটি শোনেন এবং সাদাতকে সতর্ক করে ‘আল আহরামে’ লেখা তার নিবন্ধটি তার সহবন্দীদের পড়ে শোনান। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আপসের সর্প সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট সতর্ক হন। নইলে এই সর্পের দংশন থেকে তিনি বাঁচতে পারবেন না।’ সাদাত নিহত হওয়ার পর হাইকেল কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং তার বন্ধু সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসের ও তার আরব জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সানডে টাইমস-এ একটি ধারাবাহিক লেখা ছাপেন, যেটি পরে বই আকারে বের হয়। তাতে তিনি আভাস দিয়েছিলেন, নাসের পরবর্তী প্রেসিডেন্টদের আপসের নীতি থেকেই একদিন মিসরে উগ্র মৌলবাদীদের উত্থান ঘটবে। তারপর খুব বেশি দিন কাটেনি। ধর্মনিরপেক্ষ আরব জাতীয়তাবাদের পীঠস্থান মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসা সম্ভব হয় এবং ব্রাদারহুড নেতা মুরসি প্রেসিডেন্ট পদে বসে আরব জাতীয়তাবাদ ও নাসেরবাদ মিসরের মাটি থেকে উচ্ছেদ করা শুরু করেন। উগ্র মৌলবাদী ও সেক্যুলারপন্থীদের মধ্যে বিরোধে মিসরে সিভিল ওয়ার দেখা দেয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এবং তার সুযোগ নিয়ে আর্মি ক্ষমতা দখল করে। ধর্মান্ধ রাজনীতির সঙ্গে আপস করে চলার নীতি কামাল আতাতুর্কের তুরস্কেও ভালো ফল দেয়নি। ভারতে নেহেরু থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার উগ্র মৌলবাদীদের সঙ্গে আপসের পথ ধরেননি। নেহেরু তো হিন্দু মহাসভা দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সাহায্য জুগিয়েছিলেন। কিন্তু রাজীব-পরবর্তী কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে আপসের পথ ধরেন। নিজে কপালে লাল তিলক পরতে শুরু করেন। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী দমনে দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাননি। নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি থেকে কংগ্রেসের ক্রমশ পশ্চাৎপসারণ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বিশাল ভোটাধিক্যে ক্ষমতা দখল আজ সম্ভব করেছে। গণতান্ত্রিক ভারতের ভবিষ্যতও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আগেই বলেছি, ক্ষেত্রবিশেষে আপস ভালো। কিন্তু আপসের সীমারেখাটি না মেনে ক্রমশ আত্মসমর্পণের পিচ্ছিল ঢালু পথে পা হড়কাতে থাকলে তার পরিণতি বিপজ্জনক। কিউবায় ভ্যাটিকানের পোপের উস্কানিতে ক্যাথলিক চার্চ যখন সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানের উদ্যোগ নেয়, তখন ফিদেল ক্যাস্ট্রো সাময়িক আপসের পথ ধরেছিলেন। কিন্তু চার্চের দাবির কাছে নতজানু হয়ে ক্রমশ, পশ্চাৎপসারণের নীতি গ্রহণ করেননি। ফলে ধর্মান্ধ ক্যাথলিকরা পোল্যান্ডের অবস্থার পুনরাবৃত্তি কিউবায় ঘটাতে পারেনি। সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ একবার জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে এসেছিলেন। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইসেন হাওয়ার। এক রবিবারে ছিল ক্রুশ্চেভ ও আইসেন হাওয়ারের বৈঠক। বৈঠক শেষে আইসেন হাওয়ার সোভিয়েট নেতাকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে চলুন চার্চে সানডে প্রেয়ারে যাই।’ ক্রুশ্চেভ হেসে বলেছেন, ‘আমার যেতে আপত্তি নেই। কিন্তু সোভিয়েট জনগণ একটি ৎিড়হম সবংংধমব (ভুল বার্তা) পাবে যে, তাদের নেতার মনে ধর্মানুরাগ দেখা দিয়েছে। এর ফল হবে বিপজ্জনক। রাশিয়ায় চার্চের দরোজা খুলে দেয়ার দাবি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ যখন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় সেøাগান হিসেবে ‘জয়বাংলা’ গ্রহণ করে, তখন দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যেই এ সম্পর্কে মতভেদ ছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়বাংলা সেøাগান না দেয়ার জন্য দলের বৈঠকে একদল প্রবীণ নেতা দাবিও তুলেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, এই সেøাগানে ধর্মভীরু মুসলমান ভোটদাতারা বিরক্ত হবে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। তারা বলেছিলেন, মুসলিম লীগ ইতোমধ্যেই সেøাগান দেয়া শুরু করেছে, ‘জয়বাংলা জয়হিন্দ্/লুঙ্গি ছেড়ে ধুতি পিন্দ্।’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, জয়বাংলা কোন ধর্মীয় সেøাগান নয়। যে কোন ধর্মমতের বাঙালী এ সেøাগান দিতে পারে। এই জাতীয় সেøাগানের প্রশ্নেও যদি আপস করি, তাহলে আমাদের নির্বাচন জয়ের কোন স্বার্থকতা থাকবে না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পেট্রো ডলারের বদৌলতে পলিটিক্যাল ইসলামের অনুসারী বহু দল-উপদল গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে জঙ্গীগোষ্ঠী আছে এবং তারা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের শক্তি বাড়াচ্ছে এবং শক্তিশালী ভোটব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন তারা দেশের বড় দুটি দলকেই (একটি তাদের কব্জায়) ভয় দেখাচ্ছে। এই ভোটব্যাংকের সমর্থন পেতে হলে তাদের মধ্যযুগীয় দাবির কাছে নতজানু হতে হবে। বিএনপি তাদের দাবির কাছে সকল সময়েই নতজানু। জামায়াত তাদের বহুদিনের দোসর। জাতীয় পার্টির জেনারেল এরশাদও নতুন একটি ইসলামি ঐক্যজোট গঠন করে ক্ষমতা পুনর্দখলের স্বপ্নে বিভোর। এখন সকলের দৃষ্টি আওয়ামী লীগের দিকে। আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত যে নীতি অনুসরণ করেছে, যা উগ্র মৌলবাদীদের দমন এবং সাধারণ মৌলবাদী দলগুলোকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার কৌশল অনুসরণ। এটা এক ধরনের সাময়িক আপস, আত্মসমর্পণ নয়। কিন্তু দলটি আপসের সীমারেখা না ডিঙ্গিয়ে নিজেদের মৌলিক আদর্শে অটল থাকতে পারবে, না ভোটের রাজনীতিতে নতজানু হয়ে ক্রমশ পেছনে হটার নীতি গ্রহণ করবে, এই প্রশ্নটি কোন কোন মহল তুলেছেন। আমার ধারণা, আওয়ামী লীগ আপসের রাজনীতির সীমারেখাটি অতিক্রম করবে না। ভাস্কর্য, কওমী মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি দান, পাঠ্যপুস্তকের ধর্মীয়করণ ইত্যাদি ব্যাপারে তারা সতর্ক হবেন। যদি সতর্ক না হন, তাহলে মিসর ও তুরস্কের ঘটনার পরিণতি বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। লন্ডন ২ মে মঙ্গলবার, ২০১৭
×