ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি

পাকিস্তানে যে আইনের শাসন চলছে আজও তা আমরা পাইনি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১ মে ২০১৭

পাকিস্তানে যে আইনের শাসন চলছে আজও তা আমরা পাইনি

জবি সংবাদদাতা ॥ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির কথা বেশি বের হয় কারণ এ দেশে এখনও পূর্ণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি। সংবিধান অনুযায়ী পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই সুপ্রীমকোর্ট নিম্ন আদালত পরিচালনা করতে পারছে, কিন্তু আমরা তা করতে পারছি না তাই কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল তো অনেক ওপরে এমনকি পাকিস্তানের মতো দেশও (সুপ্রীমকোর্টের) উচ্চ আদালতের নিয়ন্ত্রণে নিম্ন আদালত। পৃথিবীর অনেক দেশেই এটা বহাল আছে কিন্তু আমরা সেটি এখনও করতে পারিনি। এ জন্য প্রধান বিচারপতি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। রবিবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জ) কেন্দ্রীয় অডিটমে ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আপনারা আশ্চর্য হবেন যে, পাকিস্তানের সংবিধানকে একসময় বলা হতো আইয়ুব খানের সংবিধান। সে দেশে এখন যে আইনের শাসন চলছে নিম্ন আদালতে এটা আজকেও আমরা পাইনি। আমরা যখন কিছু রায় দেই। তা যদি কারও বিরুদ্ধে যায়। তখনই তারা এমন সব মন্তব্য করেন যা আমাদের কষ্ট লাগে। কোন মতেই আমরা নিজেদের সভ্য হিসেবে দাবি করতে পারব না। যতদিন পযন্ত আমরা সংবিধান ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। সেটা যদি আমার বিরুদ্ধেও যায়, তা আমি মাথা পেতে নেব। প্রধান বিচারপতি বলেন, আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার অধিকার সংবিধান সুপ্রীমকোর্টকে দিয়েছে আর কাউকে দেয়া হয়নি। আর এই সংবিধান সমন্নত রাখার জন্য সময়ে সময়ে সুপ্রীমকোর্ট নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এটাকেই মানতে হবে। সকল কিছুর সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হলে তখনই একটি সভ্য দেশ হিসেবে এই পৃথিবীর বুকে আমরা দাবি করতে পারবো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনাদের মতো সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমন্ত্রণ জানাবো তারা যাতে এই ধরনের আয়োজন করে থাকে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এমনকি ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় বিচারপতিরা, প্রধান বিচারপতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেগুলারলি লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য পত্রিকায় বের হয় না, আপনাদের প্রধান বিচারপতির বক্তব্য পত্রিকায় বের হয়। তার একটাই কারণ। আমরা সেই পর্যায়ে যেতে পারিনি। আমাদের আইনের শাসন আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যা আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশগুলো করেছে। এ সময় তিনি আরও বলেন, আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন পাকিস্তানের নিম্ন আদালতে যে আইনের শাসন চলছে এখন পর্যন্ত আমরা সেটি করতে পারিনি। অথচ পাকিস্তানের আইনকে এক সময় আইয়ুবের সংবিধান বলা হতো। পাকিস্তানী সংবিধান বলা হতো। সেই দেশেই এখন যে আইনের শাসন চলছে আমরা সেটি এখনও করতে পারিনি। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল তো আরও অনেক ওপরে। পাকিস্তানের মতো দেশে উচ্চ আদালত যা বলে নিম্ন আদালতের স্থানান্তরসহ যা বলে পৃথিবীর সব দেশেই বহাল আছে কিন্তু আমাদের সেটি না থাকায় প্রধান বিচারপতি কথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, সাধারণ জনগণ ও সরকার সবাইকে আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে হাবে। সুপ্রীমকোর্ট সংবিধানে আইনের যে ব্যাখ্যা দেয় তা মেনে নিতে হবে। একটা দেশের উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতির মাপকাঠি শুধু টাকা দিয়ে হলে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ অনেক আগেই উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেত। উন্নত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য আইনের শাসন পালন করতে হবে। প্রত্যেককে আইনের শাসন মেনে চলতে হবে। তিনি বলেন, এ দেশের সব ঐতিহাসিক রায় আমার হাতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় আমার হতে হয়েছে। সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনীতে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে তা আমরা পরিবর্তন করেছি। দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য ঐক্যমত হলেই সংবিধান সংশোধন করতে পারে। শুধু দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যই না পুরো সংসদ মিলে যদি সংবিধান বাতিল করে, সেই ক্ষমতা তাদের আছে। কিন্তু সুপ্রীমকোর্ট যদি দেখে, এতে সংবিধান মূল ভিত্তি নষ্ট হয়ে গেছে, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও জনগণের অধিকারে আঘাত হেনেছে। তাহলে সংসদের ওই সিদ্ধান্তকে বেআইনী ঘোষণার ক্ষমতা সুপ্রীমকোর্টের রয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ভবিষ্যতে সংসদ সংবিধানের কোন বিধান বা অন্য কোন আইন সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিল করতে সুপ্রীমকোর্ট পিছপা হবে না। বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, তা সুপ্রীমকোর্টকে জুডিশিয়াল রিভিউ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের এই ক্ষমতা বলেই সুপ্রীমকোর্ট ৫ম, ৭ম, ৮ম ও ১৩তম সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট। এতে কারও কোন দ্বিমত নেই। আমাদের সংবিধানে যে ব্যবস্থা আছে, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। আমি সরকারপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, তিনটি বিভাগ কারও ওপর কেউ যাতে প্রাধান্য না পায়। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার জন্য। এটা আমাদেরও কথা। এটাই হওয়া উচিত। এই যে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবো আমরা। কিভাবে করবো প্রশ্নটা হলো এই আর্টিকেল ৭ বলা হয়েছে, ক্ষমতার উৎস জনগণ। ক্লোজ-২ বলছে যদি কোন আইন অন্য কোন প্রচলিত আইনের পরিপন্থী হয় তাহলে এমনিতেই সেটা বেআইনী হয়ে যাবে। এরপর আছে জুডিশিয়াল রিভিউ। আমাদের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান দিয়েছেন সেখানে জুডিশিয়াল রিভিউর ক্ষমতা একমাত্র সুপ্রীমকোর্টকে দেয়া হয়েছে। এখন একটা আইনের সঙ্গে আরেকটি আইনের যদি পরিপন্থী হয় তাহলে এটা কে ডিকলার দেবে। জুডিশিয়াল ক্ষমতা অনুযায়ী, সব কোর্ট দেবে। কোর্টকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এই কারণেই। বিশ্ববিদ্যালয় ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান খ্রিস্টীন রিচার্ডসনের সভাপতিত্বে এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ বিশ্বদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সেলিম ভূইয়া, আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সরকার আলী আককাস প্রমুখ।
×