ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হোসনে আরা শাহেদ

তোহা ভাই

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

তোহা ভাই

তোহা ভাইয়ের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বিশেষভাবে এপ্রিলে তাঁর চিরবিদায়ের দিনটি এলে। এবারও তাই হলো। কাগজে তাঁর ছোট্ট ছবিটি দেখে মন বিষণœ হয়ে উঠল। সেই চেনা মুখ, চেনা মানুষ। মনে হয় এখনও আছেন আমাদের মাঝে, হয়ত একবার শুভেচ্ছা জানাবেন বাংলা নববর্ষের। তোহা ভাই মানে তোহা খান। গুণী সাংবাদিক। গুণী লেখক। সবচেয়ে বড়, সুন্দর মনের মানুষ। বাইরে সতেজ গম্ভীর মনে হয়েছে, আসলে তা নয়। বেশ মিশুক, আলাপ-আলোচনায় আন্তরিক ছিলেন তিনি। কখনও কেউ কাজে গেলে ফিরিয়ে দেননি। কারও সঙ্গে অশোভন ব্যবহার করেননি। মানুষকে ভালবাসতেন তিনি। তাঁর সহৃদয়তার ছোঁয়া বাইরে থেকে বোঝা যেত না। চট্্ করে তাঁকে বুঝে- ওঠা সম্ভবও ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে নিভৃতচারী মনে হলেও নিভৃত জীবনের মানুষ তিনি ছিলেন না। সাংবাদিকতা যার জীবন, তিনি নিরিবিলি থাকতে পারেন না, এ জানা কথা। তিনি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় কাজ করতেন। তাঁর সময়ে ছিলেন শহীদুল্লাহ ভাই (শহীদুল্লাহ কায়সার), সন্তোষ দা (সন্তোষ গুপ্ত), বজলুর রহমানসহ আরও অনেকে। চমৎকার একটা টিম যেন। আহমেদুল কবীর সাহেব মালিক সম্পাদক। ‘সংবাদ’ পত্রিকাটির অফিস তখন দক্ষিণ ঢাকার বংশাল এলাকায়। আমি ছিলাম সে সময়ে ঢাকার শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে, সেই টিকাটুলির হাটখেলায়। ওই প্রতিষ্ঠানটি এককালের নারী শিক্ষা মন্দির। ঐতিহ্যম-িত ওই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাত্রী অগ্নিকন্যা লীলা রায়সহ অন্য কর্ণধাররা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন সেই দেশ-ভাগের সময়। এরপরও যারা ছিলেন, তারাও দেশ ছেড়েছেন কিছুকাল পর পর। প্রতিষ্ঠানটির দশা তখন করুণ। এমনই করে কেটে যায় বহুদিন। একেবারে রিক্ত-নিঃস্ব দশা যখন, এর পুনরুজ্জীবনে পরিবেশ মনোযোগী হয়ে ওঠে। অনেক পালা বদল চলে, চলে অনেক পটপরিবর্তন। ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ শেষে এর দায়িত্ব আমার কাঁধে যখন চাপে, তখন বড় বিপন্ন বোধ করতে থাকি। প্রায় নিঃশেষ প্রতিষ্ঠানটির পুনরুজ্জীবন থেকে শুরু করে এতে কলেজে শাখা সংযোজনের দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায়। এমন এক কঠিন সময়ে আমি স্থানীয় অনেক গণ্যমান্য ও সহৃদয় ব্যক্তিত্বের অকুণ্ঠ সহযোগিতা পাই। এমন এক সময়েই তোহা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। তোহা ভাই অর্থাৎ সাংবাদিক তোহা খানের মেয়ে সে সময় আমাদের প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীÑ মাধ্যমিক বিভাগের কিছুটা ওপরের দিকের ক্লাসে। ওকে স্কুলে আনা-নেয়ার কাজটি তোহা ভাই নিজেই করতেন। সেই সময়ে নতুন কাজে যোগ দেয়া আমার সঙ্গে কন্যার পড়াশোনার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হয়। সে আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে প্রাধান্য পায় প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবস্থা। প্রতিষ্ঠানের নড়বড়ে আর্থিক অবস্থা থেকে শুরু করে বহুমুখী বিপন্নতার কথা, আলোচনায় আনা সম্ভব হয় বিশেষভাবে তাঁর আগ্রহের কারণে। কারণ তিনিসহ আরও কয়েকজন শুভাকাক্সক্ষী অভিভাবকের ইচ্ছা ছিল এ প্রতিষ্ঠানটির পুনরুজ্জীবন লাভ করানো। অথচ বিষয়টি একটু জটিল ছিল কয়েকটি কারণে। সেই সময়ে আশপাশে মেয়েদের স্কুল বেশ কয়েকটি ছিলÑ (আজও আছে) তার মধ্যে একটি সরকারী, তা-ও একেবারে কাছাকাছি, দূরত্ব মাত্র কয়েক গজ, আধমাইলও নয়। স্কুল আরও ছিল একটু দূরে। তবে এত দূরে না, মতিঝিলেই। এত সব কারণে আমাদের এ স্কুলটির প্রয়োজনীয়তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তেমন একটা ছিল না। আমরা সবাই এ কারণে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছিলাম নাÑ শুধু নারী শিক্ষা মন্দিরের ঐতিহ্যের জন্য হা-হুতাশ ছাড়া। যা হোক, দীর্ঘ সে সংগ্রাম এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কেবল এটুকুই বলছি, প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠানের প্রাণ-সঞ্চারে তোহা ভাই কী পরিমাণ সাহায্য করেছেন, তার পুরো বর্ণনা দেয়া সম্ভব না। তিনি নিজ পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্কট-সমস্যা নিয়ে লেখানোর ব্যবস্থা করেন। ‘দৈনিক ইত্তেফাকের আসাফদ্দৌলা ভাই ও সিরাজ ভাইকেও আমাদের প্রতিষ্ঠান নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর চেষ্টায় ইত্তেফাকের সে সময়ের অন্যতম প্রধান রিপোর্টার শফিকুল কবির সাহেব স্কুল সম্পর্কে আমাদের সাক্ষাতকার নিয়ে জীর্ণ স্কুল ভবনের চিত্রসহ তা বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেন। স্কুলের ভবনের ছবি আর স্কুলের তথ্য সংবলিত প্রবন্ধ অন্যান্য পত্রিকায়ও গুরুত্বসহ ছাপা হয়। তোহা ভাইয়ের প্রচেষ্টায় কবি আল মাহমুদ, দাদাভাই, কবি আল মুজাহিদীসহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা সরেজমিনে দেখতে আসেন। এমনি করে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য ও মতামত প্রকাশে আমাদের প্রতিষ্ঠানটির ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ অনেকটাই সহজ হয়। আমরাও সম্মিলিতভাবে পরিচিতি লাভ করতে থাকি। পরবর্তীকালে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির কন্যাকেও ছাত্রী হিসেবে পাই। এর মধ্যে শফিকুল কবির সাহেবের দুই কন্যা সুখন ও কবিতা, সন্তোষ দা-র (সন্তোষ গুপ্ত) কন্যা (নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না), সুভাষ দত্তের (চিত্র পরিচালক) বোন ঝর্না দত্তসহ অনেকের কথা বলা যায়। বলতে চাইছি, আমরা সকলের দ্রুত আস্থা লাভ করতে সমর্থ হই। আমাদের ছাত্রী তাঁর কন্যা আসিয়ার জন্যই সে আমাদের প্রতিষ্ঠানটির জন্য তোহা ভাইয়ের মনে মমতা জন্মেছিল, তা অবশ্যই নয়। ইচ্ছে করলেই তিনি মেয়েকে আমাদের কাছের সরকারী স্কুল ‘কামরুননেসায় নিয়ে যেতে পারতেন। তিনি তা নেননি। এ প্রতিষ্ঠানটিরই প্রাণ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হলেন। কারণ, তিনি ছিলেন মনে-প্রাণে শিক্ষাণুরাগী, ছিলেন মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে আন্তরিক। ১৯২৮ সালে বিপ্লবী কন্যা লীলা রায়ের প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটিকে নবজন্ম দানের লক্ষ্যে তার অবস্থানে থেকে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর প্রভাব ও প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর এমন প্রয়াসে উপকৃত হয়েছে আমাদের প্রতিষ্ঠানটি যার মাধ্যমে আলোকিত হয়েছে ওই এলাকার অসংখ্য সাধারণ পরিবারের হাজারো কন্যা সন্তান। টিকাটুলি-হাটখোলার ওই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ছিল এবং এখনও আছে, ওয়ারী র‌্যাংকিন স্ট্রীট, রামকৃষ্ণ মিশন, মতিঝিল থেকে শুরু করে গে-ারিয়া, সদরঘাট এমনকি নদীর (বুড়িগঙ্গা) ওপারেরও অভিভাবকের সন্তান। আজ সেসব ছাত্রীদের বিশাল একটি অংশ ছড়িয়ে আছে দেশের ও দেশের বাইরে সরকারী, বেসরকারী, প্রাইভেট সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ছোট-বড়, মাঝারি নানা ধরনের অবস্থানে। কৃতিত্বও প্রদর্শন করেছে অনেকে। আজকের এ সময়ে হয়ত এমন করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা উন্নত করা কঠিন কিছু নয়, কিন্তু সে সময়ের সেই ষাটের দশকের শেষ প্রান্ত থেকে সত্তর আশির দশক পর্যন্ত। এ ছিল বাস্তবিকই দুরূহ। এ কারণেই সেই সময়ে এমন সব কাজে যে সাহায্য-সহযোগিতা তার মূল্যায়ন সহজে করা কখনওই সম্ভব নয়। আগেই বলেছি, তোহা ভাই নিছক কর্তব্যের খাতিরে, সৌজন্যবশে বা অনুরুদ্ধ হয়ে এ কাজ করেননি। তিনি করেছেন মনের তাগিদে। বিবেকের তাড়নায় আর নারী শিক্ষার কল্যাণের লক্ষ্যে। তার এমন অবদানের কথা তিনি পরের দিকে কখনও উচ্চারণও করেননি। তিনি প্রচারসর্বস্ব মনের ছিলেন না। দৈনিক সংবাদ অফিসে আমাকে আমার লেখার কাজেও যেতে হয়েছে, গেছি। দেখেছি, তোহা ভাইকে তাঁর ঘরে টেবিলে বসে মাথা নিচু করে লিখে যেতে। সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয়। ঘর ভর্তি মানুষের আসা-যাওয়া, কোলাহল, হৈচৈ, তোহা ভাই লিখে চলেছেন আপন মনে। মনে হয়, কোন দিকেই খেয়াল নেই। সে মুহূর্তে তার ভুবনে তিনি একা। প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে বুঝেছি, সংবাদপত্র অফিসের চিত্রটিই এমনÑ এখানে পিন-পতনের নীরবতা থাকে না। থাকতে পারে না। তোহা ভাই সুলেখক ছিলেন। কিশোরদের জন্য লেখা সুন্দরবনের ওপর তাঁর বইটি সব বয়সের পাঠক টেনেছিল। বইটি কয়েকটি স্কুলে পাঠ্যও ছিল। তোহা ভাই বন্ধুবৎসল ছিলেন। আমাদের যাঁদের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল, আমরা জানি, দুঃখের দিনেও কেমন করে পাশে এসে দাঁড়াতেন তিনি। তাঁর সাহচর্য-ধন্য হয়েছে, আমরা পুরো পরিবার অনেক আনন্দের মুহূর্তেও। ভাল কাজে উৎসাহ যোগাতে যেমন তাঁর জুড়ি ছিল না- তেমনি কাজে হতাশ হলেও উৎস হারাতে দিতেন না। অথচ তাঁকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না তিনি কতটা সংবেদনশীল আর কতটা বন্ধুপ্রিয় আপন। বিত্তবৈভবে আকর্ষণ তাঁর ছিল না মোটেও তাঁর জীবনাচরণ ছিল সহজ, সরল, অনাড়ম্বর। কথায় ও কাজে তিনি ছিলেন এক। তিনি ছিলেন প্রকৃতই সৎ প্রকৃতির। তার আলোকিত মনের। অবশ্য তিনি আলোকিত পারিবারিকভাবেই। সাতক্ষীরার সন্তান তোহা খান প্রকৃতিগতভাবে সংস্কৃতবান। তাঁর ঐতিহ্যম-িত পরিবার সৌরভে গৌরবে সুপরিচিত। তোহা ভাইয়ের মধ্যে পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন পেয়েছি আমরাÑ দম্ভ নয়। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আজ আর তেমন নেই। জীবন মানুষকে ক্রমে দূরেই টেনে নেয়, এ তথ্য আজ সত্য বলে অসহায়ভাবে মানি। জানি না তাঁর কন্যা আসিয়া, আমার ছাত্রী, এখন কোথায়। অনেক আগে পেয়েছিলাম তার সংসার-জীবনে প্রবেশের সংবাদ। জেনেছিলাম আসিয়ার জীবন সঙ্গীও একজন সাংবাদিক। ভাল লেগেছিল শুনে। একজন সাংবাদিকের স্থান আমার কাছে সব সময়ই বিশেষ মর্যাদার। আমার জীবনের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে আমি বিশেষ উপকৃত হয়েছি সংবাদ জগতের কৃতী সন্তানদের দ্বারাই। কারও ঋণ পরিশোধের সাধ্য আমার নেই। আমি আজ আমার এ লেখার মাধ্যমে তোহা ভাইয়ের স্মৃতি ও বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×